হোটেল ‘ফাঁকা’, হাসপাতালে রোগী কম: বাংলাদেশি পর্যটক না যাওয়ায় কলকাতার একাংশে ব্যবসায় মন্দা
কলকাতার নিউ মার্কেট, মার্কুইস স্ট্রিট কয়েক মাস আগেও ভিড়ে গমগম করত বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষে। কিন্তু গত জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট অস্থিরতা এবং পরিণতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে কলকাতা প্রায় বাংলাদেশি পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। খবর বিবিসির।
বাংলাদেশি পর্যটক না যাওয়ার ধাক্কা লেগেছে কলকাতার কিছু এলাকার ব্যবসায়। এসব এলাকায় হোটেল রুম প্রায় ফাঁকা থাকছে, ব্যবসায় ভাটা পড়েছে, কমেছে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও। এতে হুমকির মুখে পড়েছে এসব খাতের সঙ্গে যুক্ত মানুষের জীবিকা। নিউ মার্কেট এলাকায় বিক্রি কমে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ।
ভারতে বাংলাদেশিদের যাওয়া কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা সেন্টার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর এখনও বাংলাদেশে ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ চালু করেনি। সে কারণে যারা আগে থেকে ভিসা নিয়ে রেখেছেন এবং জরুরি চিকিৎসা করাতে যাচ্ছেন, তারাই ভারতে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছেন।
বাংলাদেশি পর্যটকরা মূলত কলকাতার নিউ মার্কেট, মার্কুইস স্ট্রিট বা মুকুন্দপুর অঞ্চলের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেই থাকেন ও কেনাকাটা করেন। সারা বছরই এসব এলাকায় বাংলাদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।
কিন্তু মাসখানেকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় কেউই কলকাতার ওইসব এলাকায় যাচ্ছেন না বলে জানান নিউমার্কেটের শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অশোক গুপ্তা।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'নিউ মার্কেটের জামাকাপড়ের দোকান বলুন বা অন্যান্য সামগ্রী—এসবের একটা বড় ক্রেতা বাংলাদেশের মানুষ। ভারতীয় ভিসা ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। তাই তারা প্রায় কেউই আসতে পারছেন না। আমাদের বিক্রি প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে গত এক মাসে।'
অবশ্য আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাও নিউ মার্কেটের ব্যবসা কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ।
অশোক গুপ্তার বলেন, 'ওই ঘটনা মানুষকে এতটাই নাড়া দিয়েছে যে বহু মানুষেরই কেনাকাটা করার, উৎসবে মাতার মতো মন নেই। এছাড়া রোজই মিছিল-প্রতিবাদ হচ্ছে। তাই মানুষ এখন এদিকে আসা কমিয়ে দিয়েছে।'
পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বাংলাদেশিরা মূলত মার্কুইস স্ট্রিটের হোটেলগুলোতে ওঠেন। এ এলাকার হোটেল, খাবারের দোকান বা অন্যান্য পরিষেবা—সবই বাংলাদেশি পর্যটক-কেন্দ্রিক। ফলে বাংলাদেশি পর্যটক না যাওয়ায় ওই এলাকার ব্যবসায়ও মন্দা যাচ্ছে।
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসা করাতে কলকাতায় যান।
একটি বেসরকারি হাসপাতাল গোষ্ঠী বিবিসিকে জানিয়েছে, বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা এক মাস আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
প্রায় ফাঁকা হোটেল
কলকাতার কেন্দ্রস্থল মার্কুইস স্ট্রিটের বহু হোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যবসা টিকে আছে মূলত বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপরে নির্ভর করে। এছাড়া এ এলাকায় মানি-এক্সচেঞ্জ, বাসের কাউন্টারসহ বাংলাদেশি পর্যটকদের প্রায় সব ধরনের পরিষেবা পাওয়া যায়।
কিন্তু বাংলাদেশিদের যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ এলাকায় অনেক হোটেল প্রায় ফাঁকা থাকছে। হোটেলগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ ঘর ফাঁকা থাকছে।
মার্কুইস স্ট্রিটের হোটেল মালিকদের সংগঠনের নেতা মনোতোষ সরকার বিবিসিকে বলেন, 'কয়েক মাস আগেও আমাদের হোটেলগুলির ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ অকুপেন্সি রেট ছিল। এখন সেটা নেমে এসেছে মাত্র ৩০ শতাংশে।
তিনি আরও বলেন, 'মার্কুইস স্ট্রিটে তো শুধু হোটেল নয়, বাংলাদেশি পর্যটকদের আরও বহু পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা আছে। তাদেরও মূল ক্রেতা ওদেশের পর্যটকরাই। তারা এখন এতটাই কম সংখ্যায় আসছেন যে সব ব্যবসায়ীরাই মার খাচ্ছে। বাস আসছে বাংলাদেশি পর্যটক নিয়ে, কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে ওই ৩০ শতাংশমতোই আসন ভর্তি হচ্ছে, বাকিটা ফাঁকা থাকছে।'
এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে, তা অনিশ্চিত। সে কারণে অন্য কোনো অঞ্চলের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবছেন মার্কুইস স্ট্রিটের হোটেল ব্যবসায়ীরা।
নিউমার্কেটে বিক্রিতে মন্দা
এদিকে নিউ মার্কেটে বছরভরই বাংলাদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকত। বিশেষ করে পোশাকের দোকানগুলোতে বাংলাদেশি ক্রেতাদের ভিড় দেখা যেত বেশি।
'কিন্তু এক মাস হয়ে গেল, তারা এখন আর ভারতে আসছেন না প্রায় কেউই। আমাদের দোকানগুলোর ৬০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে এই এক মাসে,' বলেন নিউ মার্কেটের দোকান মালিকদের সংগঠনের প্রধান অশোক গুপ্তা।
তিনি বলেন, 'মাস খানেকের মধ্যেই দুর্গাপুজো। পুজো আর ঈদের আগে আমাদের ব্যবসার বড় সিজন। পুজোর সময়ে শুধু যে হিন্দুরা কেনাকাটা করেন, তা নয়। এই সময়ে অনেক নতুন ডিজাইনের পোশাক বাজারে আসে, তাই মুসলমান এবং অবশ্যই বাংলাদেশিরা এই সময়ে কেনাকাটা করতে আসতেন। আবার পাইকারি বাজার থেকে পোশাক কিনে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেদেশ থেকে ব্যবসায়ীরাও আসতেন।
'তবে এ বছর কেউই প্রায় আসছেন না। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তো একটা কারণ। আবার কলকাতায় এখন বহু মানুষ আরজি করের ঘটনা নিয়ে এতটাই মন খারাপ করে আছেন যে তারাও কেনাকাটা করতে উৎসাহ পাচ্ছেন না। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।'
আগামী পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে বাজারের পরিস্থিতি উন্নতি না হলে এবারের কেনাকাটার পুরো মৌসুমটা তাদের ক্ষতি হবে বলে জানান অশোক গুপ্তা।
নিউ মার্কেটের কাছাকাছি আরও যে কটি বড় শপিং মল বা দোকান আছে, সেখানেও একই পরিস্থিতি বলে জানা গেছে।
হাসপাতালেও রোগী কমেছে
বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যান, তাদের একটা বড় অংশ যান চিকিৎসা নিতে। কলকাতা, ভেলোর, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বাইয়ের অনেক বেসরকারি হাসপাতালে বাংলাদেশের বহু মানুষ যান। এসব হাসপাতালে বাংলাদেশিদের জন্য আলাদা সার্ভিস-ডেস্কও থাকে।
কলকাতার যেসব বেসরকারি হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীরা বেশি যান, ওই হাসপাতালগুলো বিবিসিকে জানিয়েছে, গত এক মাসে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোগীর সংখ্যা খুব কম।
মনিপাল হসপিটালস্ গোষ্ঠীর হাসপাতালগুলোতে প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ১০০ জন বাংলাদেশি রোগী যান। কিন্তু সেই সংখ্যা এখন প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।
কলকাতার ইস্টার্ন বাইপাস সংলগ্ন এলাকার হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি রোগীরা বেশি যান। ওইসব হাসপাতালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় পরিষেবা শিল্প। খাওয়ার বা থাকার হোটেল, ওষুধের দোকানসহ সবমিলিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের জীবিকা চলে ওই হাসপাতালগুলোকে কেন্দ্র করে।
এই মানুষগুলোর একটা বড় অংশ নির্ভর করে বাংলাদেশি রোগীদের ওপরে। তাই বাংলাদেশ থেকে পর্যটক বা রোগী যাওয়া স্বাভাবিক হওয়ার আগপর্যন্ত এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।