উত্তপ্ত বিতর্কে মুখোমুখি ট্রাম্প-হ্যারিস; বাক্যবাণে দুষলেন একে অপরকে
যুক্তি পালটা যুক্তিতে শেষ হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের প্রথম নির্বাচনী বিতর্ক। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রথম ও সম্ভবত শেষ মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় বিতর্ক হলেও কমলার প্রথম।
বাংলাদেশ সময় বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল সাতটায় মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম এবিসি নিউজের আয়োজনে এ বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্কের সঞ্চালক ছিলেন ডেভিড মুইর ও লিনসে ডেভিস।
৯০ মিনিটের এ বিতর্কে ডেমোক্র্যাট কমলা ও রিপাবলিকান ট্রাম্প ইউক্রেন ও ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, গর্ভপাতসহ বিভিন্ন বিষয়ে একে অপরকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন এবং বাক্যবাণে নাস্তানাবুদ করেছেন। এমনকি একে অপরের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগও এনেছেন তারা।
বিতর্কের শুরুতেই মঞ্চে প্রবেশ করে ট্রাম্পের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেন কমলা। দুজন করমর্দন করেন। করমর্দন শেষে কমলার বক্তব্য দিয়ে শুরু হয় বিতর্ক।
প্রথম প্রশ্ন ছিল, 'আপনি কি মনে করেন যে আমেরিকানরা চার বছর আগের তুলনায় এখন ভালো অবস্থায় আছে?'
উত্তরে হ্যারিস বলেন, অর্থনীতিতে সবার জন্য সুযোগ তৈরি করতে চান তিনি। বিশেষভাবে নতুন পরিবারগুলোর জন্য আবাসনের খরচ কমাতে চান।
কর কমানোর বিষয়ে ট্রাম্পকে আক্রমণ করে হ্যারিস বলেন, ট্রাম্প আবারও পুরোনো নীতি ফিরিয়ে আনতে চান এবং ধনকুবের ও করপোরেশনগুলোর জন্য ট্যাক্স কাটছাঁট করবেন। তার কর নীতিতে আমেরিকানদের নিত্যদিনের পণ্যের ওপর বেশি কর দিতে হবে।
কমলা হ্যারিস বলেন, তিনি (ট্রাম্প) যখন ক্ষমতা ছাড়েন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসংস্থান অত্যন্ত বাজে অবস্থায় ছিল। আমরা যা করেছি তা হল ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৃতকর্ম পরিষ্কার করা। ট্রাম্পের কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি শুধু ধনীদের জন্য কর ছাড় নিয়ে চিন্তিত।
'প্রজেক্ট ২০২৫'–এর কথাও উল্লেখ করেছেন হ্যারিস। একে 'বিপজ্জনক পরিকল্পনা' বলে অভিহিত করেছেন।
এরপরে ট্রাম্প অভিবাসীদের নিয়ে আরেকটি উদ্ভট মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, স্প্রিংফিল্ড, ওহিওতে অভিবাসীরা পোষা কুকুর খাচ্ছে। মডারেটর ডেভিড মুইর জানান, স্প্রিংফিল্ড শহর প্রশাসক বলছেন যে, এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ নেই। ট্রাম্প বলেন, 'আমি টেলিভিশনে দেখেছি যে, কিছু মানুষ বলছে তাদের কুকুর খেয়ে ফেলেছে।'
ফ্যাক্ট-চেক গ্রুপ বিবিসি ভেরিফাই জানিয়েছে, স্প্রিংফিল্ড কর্মকর্তাদের কাছে এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন নেই।
বিতর্কের শুরুতে নীতিমালা নিয়ে আলোচনা হলেও, হ্যারিসের এক মন্তব্য বিতর্কের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি ট্রাম্পের সমাবেশ নিয়ে খোঁচা মেরে বলেন, ট্রাম্পের সমর্থকরা ক্লান্তি ও বিরক্তি নিয়ে আগেভাগেই তার সমাবেশ ছেড়ে চলে যায়।
ট্রাম্প এই মন্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া জানান এবং দীর্ঘ সময় ধরে তার সমাবেশের উপস্থিতি নিয়ে ব্যাখ্যা দেন।
ট্রাম্প জবাবে বলেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে অসাধারণ সমাবেশ আমি করেছি। অন্যদিকে হ্যারিস তার সমাবেশগুলোতে মানুষজনকে বাসে করে নিয়ে আসেন।
এরপরই বিতর্কের মঞ্চ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, দুজনই আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন।
হ্যারিস ট্রাম্পের অপরাধ ইতিহাস নিয়ে বলেন, 'এটি অদ্ভুত যে, অপরাধের অভিযোগে থাকা একজন এত কিছু নিয়ে কথা বলছেন।' ট্রাম্প এর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এসব মামলাগুলো 'মিথ্যা' এবং বিচার ব্যবস্থাকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ট্রাম্প অভিবাসন, সীমান্ত নীতি, অর্থনীতি, এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে কমলা হ্যারিসের দিকে আঙুল তোলেন। বিশেষ করে ফ্র্যাকিং নিয়ে তার অবস্থান বদলের বিষয়টি তুলে ধরে তার সমালোচনা করেন। এছাড়াও, বাইডেন প্রশাসনের অংশ হিসেবে হ্যারিস কেন উল্লেখযোগ্য নীতিগত অগ্রগতি করতে পারেননি, সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
গর্ভপাত নিয়ে দুই প্রার্থীই একে অপরের দলের নীতিকে দোষারোপ করেন। হ্যারিস এর জবাবে ট্রাম্পকে 'গর্ভপাত নিষেধাজ্ঞা'র জন্য দায়ী করেন এবং তার নেতৃত্বের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
উপস্থাপক ট্রাম্পকে গর্ভপাতের অধিকারে তার অবস্থান পরিষ্কার করার আহ্বান জানান। ট্রাম্প হ্যারিসকে 'মার্ক্সবাদী' বলে বিদ্রুপ করেন এবং ভিত্তিহীনভাবে দাবি করেন যে ডেমোক্র্যাটরা গর্ভাবস্থার নবম মাসেই অনুমতি দিয়ে 'শিশু হত্যা' করতে চায়।
বিতর্কিত মন্তব্যে তিনি দাবি করেন, কিছু অঙ্গরাজ্য নবজাতককে জন্মের পর হত্যার অনুমতি দেয়। এই বক্তব্যের পর উপস্থাপক ট্রাম্পকে সংশোধন করে বলেন, 'আমাদের দেশে এমন কোনো অঙ্গরাজ্য নেই, যেখানে জন্মের পর শিশুহত্যা বৈধ।'
অবশ্য হ্যারিস এবং এবিসি নিউজের উপস্থাপক লিন্ডসে ডেভিস, ট্রাম্পের এ দাবি মিথ্যা বলে ধরিয়ে দেন। হ্যারিস ট্রাম্পের গর্ভপাত নিয়ে অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেন, বিশেষ করে ২০২২ সালে রো বনাম ওয়েড রায় বাতিল করা তিনজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মনোনীত করার জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেন।
হ্যারিস বলেন, 'আপনাকে আপনার বিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে না, শুধু এটা মানতে হবে যে সরকার এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো অধিকার নেই একজন নারীকে তার শরীর নিয়ে কী করতে হবে তা বলার'। তিনি বলেন, 'যখন কংগ্রেস রো বনাম ওয়েডের সুরক্ষা পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি আইন পাস করবে, আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে গর্বের সঙ্গে সেটি স্বাক্ষর করব।'
হ্যারিস ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে হামলার জন্যও ট্রাম্পকে দোষারোপ করেন এবং দাবি করেন যে, ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতিতে দুর্বল ও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'ক্যাপিটালের ঘটনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাকে শুধু একটি ভাষণ দিতে বলা হয়েছিল, আর কিছু নয়।'
ট্রাম্পকে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ এবং হামাসের হাতে আটক বেসামরিকদের মুক্তির বিষয় নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। ট্রাম্প বলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে এ যুদ্ধ কখনো হতো না। হ্যারিসের প্রতি কটাক্ষ করে বলেন, 'কমলা হ্যারিস ইসরায়েলকে ঘৃণা করেন। যদি তিনি প্রেসিডেন্ট হন, আমি বিশ্বাস করি দুই বছরের মধ্যে ইসরায়েল থাকবে না।'
হ্যারিস, যিনি বারবার ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ট্রাম্পের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ট্রাম্প 'বিভক্তি সৃষ্টি করে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন'।
তিনি দাবি করেন, সামরিক নেতারা ট্রাম্পকে 'অপমানজনক' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এ ইস্যুতে হ্যারিস বলেন, 'ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে, তবে এটি কীভাবে করছে তা গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধের অবসান হওয়া উচিত। এটা অবিলম্বে শেষ হওয়া উচিত।' যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে কমলা বলেন, গাজা পুনর্গঠনের জন্য দুই রাষ্ট্রই সমাধান।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি চান কি না ইউক্রেন যুদ্ধ জিতুক। ট্রাম্প বলেন, তিনি এ যুদ্ধের সমাপ্তি চান।
এরপর, তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের খরচ সম্পর্কে কথা বলেন, দাবি করেন ইউরোপের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশি খরচ করছে। তিনি বলেন, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে 'খুব ভালোভাবে' জানেন।
এনিয়ে হ্যারিসের অভিযোগ, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে পুতিনকে ইউক্রেন দখল করে নিতে দেবেন। হ্যারিস বলেন, যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতেন, তবে পুতিন এতক্ষণে কিয়েভে বসে থাকতেন এবং তার নজর থাকতো বাকি ইউরোপের দিকে। তিনি আরও বলেন, 'ইউরোপীয় নেতারাও চান না, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হোন।'
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন