দরপত্র ছাড়াই চেয়ারম্যানের বাংলো সংস্কারে ৮ গুণ বেশি ব্যয় প্রাক্কলন রাজউকের
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে ২,৫০০ বর্গফুটের দোতলা একটি বাংলো নির্মাণে ১.৫ কোটি থেকে ২ কোটি টাকার মতো খরচ হয়।
কিন্তু রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যানের এমন পরিমাপের একটি সরকারি বাংলো সংস্কারেই খরচ ধরা হয়েছে এরচেয়েও বেশি—প্রায় ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। বাংলো সংস্কারের কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে সংস্থাটি। তবে ব্যয়ের প্রাক্কলনটি এখনও অনুমোদন অপেক্ষায় রয়েছে।
জানুয়ারিতে বাংলো সংস্কারের কাজ শুরু করে রাজউক। তারপর কাজের শেষ পর্যায়ে এসে গত সপ্তাহে ওই বিল ধরে ট্রেন্ডার প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে সংস্থাটি।
যদিও প্রথমে এ কাজের খরচ ধরা হয়েছিল ৩০ লাখ ৯ হাজার টাকা। কিন্তু কাজ শেষে ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৮ গুণ।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অভ প্ল্যানার্স-এর (বিআইপি) সভাপতি আদিল মাহমুদ খান বলেন, নতুন করে একটি বাংলো তৈরি করতেই ২ কোটি টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা না। সেখানে সংস্কারে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত না।
তিনি বলেন, 'দেশের এমন পরিস্থিতিতে সরকার যেখানে কৃচ্ছ্রতা সাধন করছে, সেখানে এমন আকাশচূম্বী মেরামত বিল কোনোভাবেই কাম্য না। এটা স্পষ্ট লুটপাট।
'এর সাথে জড়িত রাজউকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের (রিহ্যাব) এক সদস্যও বলেন, রাজউক চেয়ারম্যানের বাংলোর সমপরিমাপের একটি বাংলো নতুন তৈরি করতে খরচ হয় ১.৫ কোটি টাকা। এরপরে আনুষঙ্গিক কিছু খরচ হয়।
'সব মিলে ২.৫ কোটি টাকায় সম্পূর্ণ একটি বাংলো সেটআপ করা যায়।'
রাজউক সূত্রে জানা যায়, গত ৫ এপ্রিল রাজউক চেয়ারম্যান পদে মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকারকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি যোগ দেওয়ার পরে ওই বাংলো পরিদর্শনে যান প্রকৌশলীরা। তারপর বাংলোর বিভিন্ন সংস্কার কাজের জন্য ৩০ লাখ টাকার একটি প্রাক্কলন প্রস্তুত করে রাজউকের প্রকৌশল বিভাগ।
সংস্কারের মধ্যে রয়েছে আড়াই হাজার বর্গফুটের দোতলা ভবনের পুরনো জলছাদ অপসারণ করে ড্যাম্প প্রুফিং ও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, চিলেকোঠার ছাদ ও দেয়াল ভেঙে নতুন করে তৈরি, ভবনে প্লাস্টার ও রং করা, দরজার চৌকাঠ, শাটার, জানালার ট্রে ও গ্রিল বদল।
তবে ১৭ এপ্রিল 'আরবান রেজিলেন্স প্রকল্প: রাজউক অংশ' শীর্ষক প্রকল্পের প্রকৌশলী দল ভবনটি পরীক্ষানিরীক্ষার পর ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে। তারা ভবনটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের সুপারিশ করে।
এ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন-৪) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চেয়ারম্যান বাংলো কম্পাউন্ডে নতুন ভবনের স্থাপত্য নকশা প্রস্তুত করতে রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেন।
এরপর ৯ মে রাজউকের প্রস্তাবিত প্রকল্পের পরিকল্পনা, নকশা ও বাস্তবায়নের জন্য স্থাপত্য শাখার প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদকে আহ্বায়ক করে ১৩টি প্রকল্পের কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে চেয়ারম্যান বাংলোর প্রকল্পের কমিটিও রয়েছে।
ওই কমিটি গত ১৫ মে সভা করে। সভায় বরং বাংলোটি সংস্কার করার সুপারিশ করা হয় এবং ৭ দিনের মধ্যে নকশা ও ড্রয়িং দাখিল করতে বলা হয়। পরে দ্রুত প্রাক্কলন প্রস্তুত করে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে দরপত্রের মাধ্যমে কাজ শেষ করতে বলা হয়।
তবে ওই সুপারিশ না মেনে কমিটির আহ্বায়ক মোস্তাক আহমেদ ও সদস্য সচিব রাহাত মুসলেমীনের মৌখিক নির্দেশনায় রুপসা এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের (এনডিএ) মাধ্যমে ভবনটির সংস্কার কাজ শুরু করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী বাংলোর সংস্কার কাজ না হওয়ায় ৬ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাউছার (বাস্তবায়ন-৪) রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে বাংলোর চলমান কাজের লিখিত নির্দেশনা, কাজের বিস্তারিত পরিকল্পনা ও নকশার অনুমোদিত কপি চেয়ে চিঠি দেন।
এরপর চেয়ারম্যান নির্বাহী প্রকৌশলীকে বাংলোর কাজের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নকশা সরবরাহ শীর্ষক চিঠি প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার চাপে ৯ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী চিঠিটি প্রত্যাহার করেন বলে জানিয়েছে রাজউক সূত্র।
তবে প্রাক্কলনটি এখনও রাজউকের অনুমোদন পায়নি।
যোগাযোগ করা হলে রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কাউছার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কাজের চুক্তি পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেভলোপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিএ) বলেছে, তারা শুধু তাদের ওপর ন্যস্ত কাজ করছে। তবে এ প্রকল্পের ওয়ার্ক অর্ডার বা দরপত্রের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (চলমান দায়িত্ব) মো. আশরাফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, বাংলোর সংস্কার কাজ কোন প্রক্রিয়ায় করেছে, সেটি তার জানা নেই।
'প্রকৌশলী বিভাগ থেকে কাজটি করেছে তো, তাই প্রধান প্রকৌশলী বিষয়টি বলতে পারবেন,' বলেন তিনি।
এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) আবদুল লতিফ হেলালীর কাছে জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং বড় অঙ্কের এই ব্যয় প্রাক্কলন ও দরপত্র না করার তথ্যকে মিথ্যা দাবি করেন। এই প্রতিবেদককে শিক্ষা দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য উপর্যুপরি চেষ্টা করেও রাজউক চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যানি। টিবিএসের এই প্রতিবেদকের পাঠানো খুদে বার্তারও উত্তর দেননি তিনি।