যেভাবে আশুলিয়ার মতো পরিস্থিতি রোধ করছে চট্টগ্রামের পোশাক খাত
চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আশুলিয়ায় শত শত পোশাক করখানা বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রামের পোশাক কারখানাগুলো রয়েছে কর্মমুখর। আগে থেকেই এ সংক্রান্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখায় চট্টগ্রামের পোশাক খাতের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও এরমধ্যে কয়েকটি কারখানায় বকেয়া বেতনের দাবিতে কর্মসূচি পালন হয়েছে— তবে কারখানা বন্ধ রাখা, হামলা কিংবা ভাঙচুরের মতো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
কারখানা মলিক, শ্রমিক সংগঠন, শিল্প পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন— শ্রমিক অসন্তোষের কারণে যাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেটি নিশ্চিত করতে সব পক্ষের ইতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি রয়েছে। কারখানাগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থা নিশ্চিত করতে বিশেষ মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
বিজিএমইএ'র তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত এবং ইপিজেডকেন্দ্রিক প্রায় ৩৫০টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এগুলোতে কাজ করছেন প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক।
বিজিএইএ'র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে পোশাক মালিক, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতাসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয় করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অর্ডার কমে যাওয়ায় সময়মতো বেতন পরিশোধ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে কিছু কিছু গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান।"
দ্রুত সময়ের মধ্যে সেসব গার্মেন্টসের বেতন পরিশোধের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, শিল্প পুলিশ চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (ইন্টিলিজেন্স এন্ড মিডিয়া) রনজিত বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঢাকা এবং আশুলিয়ার মতো পরিস্থিতি যাতে চট্টগ্রামের গার্মেন্টসগুলোতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য শিল্প পুলিশ তৎপর রয়েছে। ৭টি বিশেষ টিম মঠে কাজ করছে।
তিনি বলেন, "কোনো গার্মেন্টসে শ্রম অসন্তোষ সৃষ্টি হলে তাৎক্ষনিক সাড়া দিচ্ছে এসব টিম। আমাদের ইন্টিলিজেন্স আছে। এছাড়া, অন্যান্য সংস্থা এবং বাহিনীর সদস্যরাও তৎপর রয়েছেন।"
বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে কর্মসূচি
গত জুলাই ও আগস্ট মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে ২ সেপ্টেম্বর নগরীর কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকার ওয়েল গ্রুপের পোশাক কারখানা সানজিদ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন।
বিক্ষোভ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য পুলিশ, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ও মালিকপক্ষের আশ্বাসে বিক্ষোভ বন্ধ করে ফিরে যান শ্রমিকরা। কারখানাটিতে প্রায় ১,৩৫০-১,৪০০ জন শ্রমিক কাজ করেন।
এদিকে, শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরিবৃদ্ধি সহ ১০ দফা দাবিতে চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে শ্রমিকরা। তবে পোষাক কারখানায় ভাংচুর, লুটপাট, সড়ক অবরোধ সহ জনমানুষের ক্ষতি হয় এমন কোন কর্মসূচী তারা সমর্থন করেন না।
এদিকে, বাংলাদেশ ওএসকে (ওভেন, সুয়েটার, নিটিং) গার্মেন্টস টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম জেলার যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বলেন, "মজুরি বৃদ্ধিসহ আমাদের ১০ দফা দাবি রয়েছে। এসব দাবি জানিয়ে চট্টগ্রামে আমরা বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। তবে কারখানা বন্ধ, সড়ক অবরোধ কিংবা অন্যকোনো ধ্বংসাত্বক কর্মসূচির পক্ষে আমরা নই।"
তিনি বলেন, "শ্রমিকদেরও আমরা বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। সেজন্য ঢাকা, আশুলিয়ার মতো চট্টগ্রামের গার্মেন্টস সেক্টরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এখনও সৃষ্টি হয়নি।"
শ্রমিকদের ১০ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে— মজুরি পুনঃনির্ধারণ, ৫০ শতাংশ মহার্ঘ্যভাতা যুক্ত করা, স্বল্পমূল্যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু, শ্রমিকদের মজুরি কর্তন বা চাকরিচ্যুতি বন্ধ করা, শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী সকল ধারা ও বিধি বাতিলসহ সমস্ত কালো আইন বাতিল, শ্রমদপ্তর ও কলকারখানা অধিদপ্তরের সকল অন্যায়- অনিয়ম, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা।
পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন পরবর্তী সময়ে রপ্তানি খাত কয়েক দফা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সঠিক সময়ে রপ্তানি পণ্যের শিপমেন্ট করা যায়নি। অনেক গার্মেন্টস মালিককে এয়ার শিপমেন্ট করতে হয়েছে। এতে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন গার্মেন্টস মালিকরা।
এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা আশ্বস্ত হতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন পোশাক করাখানা মালিকরা। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন কারখানায় পোশাকের অর্ডার আসার গতিও কমে গেছে।
বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বন্যাসহ বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে পোশাকের নতুন অর্ডার আসার সংখ্যা ১০-২০ শতাংশ কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে কারখানা মালিকরা বেকায়দায় পড়েছেন।"
"তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চট্টগ্রামের পোশাক মালিকরা খুবই আন্তরিক এবং সচেষ্ট। চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে যাতে কোন ধরনের অপ্রতিকর ঘটনা না ঘটে সেটি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।"
তিনি আরো বলেন, "প্রতিটি কারখানার মালিক নিজ নিজ কারখানায় সময় দিচ্ছেন। তৃতীয় কোন পক্ষের ইন্ধনে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে কোনো ঝামেলা যেন সৃষ্টি হতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা হচ্ছে। ফলে চট্টগ্রামের কারখানার পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।"
চট্টগ্রামের রেনোন অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিকেএমইএ'র ডিরেক্টর মোহাম্মদ শামসুল আজম টিবিএসকে বলেন, "বৈশ্বিক সংকট, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নানামুখী সংকটে চট্টগ্রামের পোশাক মলিকরা জর্জরিত। এরমধ্যে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।"
"বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে কারখানা মলিকদের জন্য যেমন বিপদ, একই সাথে তেমনি শ্রমিকরাও চাকরি হারাবেন। বিষয়টি শ্রমিকরাও বোঝেন। তাই সংকটগুলো আমরা এক সাথে মোকাবেলা করছি। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে সংকট কেটে যাবে," যোগ করেন তিনি।