‘হাহাকার লাগছে! তীব্র হাহাকার!’: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনায় সরব অনলাইন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে মারধরের শিকার হওয়া তোফাজ্জলকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় চোর অপবাদ দিয়ে তাকে আটক করেন হলটির শিক্ষার্থীরা। নিহত তোফাজ্জল বরিশালের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলেন।
হলের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, তোফাজ্জলকে আটকের পর গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত কয়েক দফায় মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে ওই যুবককে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর তাকে পুনরায় পেটানো হয়।
বুধবার দেশের আরেক শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা গণপিটুনিতে নিহত হন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। দেশের বিভিন্ন স্থানে উচ্ছৃঙ্খল জনতা একাধিকবার আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন।
এর আগে সারাদেশে এ ধরনের 'মব জাস্টিস' নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। এবার খোদ দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠের তকমা পাওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে পিটিয়ে খুনের ঘটনা ঘটল।
বলা বাহুল্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা তোফাজ্জলের হত্যা নিয়ে সরব হয়ে উঠেছেন। এমন বর্বরোচিত ঘটনায় কেউ হতাশ, কেউ লজ্জিত, কেউ আতঙ্কিত, কেউবা আবার হত্যাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে এ হত্যাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবেন তা নিয়ে 'অবধারণগত অসঙ্গতি'তে ভুগছেন।
জানা গেছে, তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন। 'ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমসংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রথমে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারান। এর কিছুদিনের মধ্যে খুব অল্পসময়ের ব্যবধানে তোফাজ্জলের মা, বাবা ও একমাত্র বড় ভাই মারা যান,' ফেসবুকে লিখেছেন আরিফুজ্জামান আল্-ইমরান।
তোফাজ্জল তার এলাকার [বরগুনা] উল্লেখ করে তিনি জানান, 'আমি আমাদের এলাকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি এফএইচ হলে গিয়ে তোফাজ্জলকে নিয়ে আসার জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকে ম্যানেজ করতে পারিনি।'
'দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ফেসবুকে দেখি তোফাজ্জল এফএইচ হলের শিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতনে মারা গিয়েছে — আহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়!!!'
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের প্রভাষক বায়েজীদ খান রাজীব প্রশ্ন করেছেন, "ঢাবির ঘটনায় 'মানসিক ভারসাম্যহীন' কাকে বলছেন আপনারা? যে মরেছে না-কি যারা মেরেছে?"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত 'ভাবমূর্তি'তেও প্রভাব ফেলেছে এ হত্যাকাণ্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই নিজের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছেন।
শিক্ষার্থী তাজফিয়া উখরোজ প্রশ্ন করেছেন, "স্কিল নাই, কিছু নাই। কয়েকটা বই মুখস্থ করে আর বড় ভাই-আপুদের ল্যাঞ্জা [লেজ] ধরে 'ঢাবি ঢাবি' চিল্লায়ে আর কত উপরে যাওয়া যাবে?"
এ সময় তিনি 'আপাতত স্কিল ডেভেলপ করতে হবে না, মনুষ্যত্ব ডেভেলপ করেন' বলে পরামর্শ দেন।
সুলতানা মেজহাবিন চৈতী নামক এক ব্যবহারকারীর তৈরি করা একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত ম্যুরাল 'দ্য লাস্ট সাপার'-এর পটভূমি; যিশু ও তার অনুগতদের স্থলে সেখানে বসে খাবারের পাত্রে হাত ধুচ্ছেন তোফাজ্জল। ওপরে লেখা: 'আগে চান্স পেয়ে মানুষ হয়ে দেখান।'
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তোফাজ্জল হল ক্যান্টিনে বসে খাচ্ছেন। ভাত, সবজি, এক টুকরো মুরগি — 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের' ট্রেডমার্ক খাবার। ভিডিওতে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে; একজন তার কাছে খাবার কেমন তা জানতে চান।
ভিডিওটি শেয়ার করে মিরাজ আহম্মেদ হ্যাশট্যাগ দিয়ে লেখেন: 'পিটিয়ে মেরে ফেলার পূর্বে আপ্যায়ন।'
'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড (বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলায় অনেকেই পিছু লাগছে)। মানুষ খুব স্বাদ করে, যত্ন করে শৈল্পিক উপায়ে হত্যা করতে জানে,' তিনি আরও লেখেন।
ছবিটির কিছুটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তৌহিদুল ইসলাম। 'যিশুর সঙ্গে তোফাজ্জলের এই আইডেন্টিফিকেশনে গভীর অর্থময়তা তৈরি হইছে। যিশু খ্রিস্ট এবং ওই ব্যক্তি দুজনেই নিরপরাধ ভিক্টিম।'
'[ফরাসী চিন্তক রেনে] জিরার্দের মতে, সমাজে বা কমিউনিটির ভেতরে যখনই কোনো সংকট দেখা দেয় তখনই মানুষ বলির পাঁঠা [স্কেপগোটিং] খুঁজতে শুরু করে। এভাবে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে কিংবা একটা গোটা কমিউনিটিকে শনাক্ত করে তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে তাদের শাস্তি দেওয়া হয় বা হত্যা করা হয়।
'বিশেষত সমাজের ক্রান্তিলগ্নে এ ধরনের স্কেপগোটিং প্রবণতা বাড়ে। মানুষের ভেতর যে অবিশ্বাস, অস্থিরতা, আতঙ্ক আর ট্রমা তৈরি হয়, সেগুলো এই কালেক্টিভ হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে রিলিজ [মুক্তি] হয়,' তিনি আরও লেখেন।
মুনমুন শারমিন শামস নামক একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, 'এরপর যখন আপনারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ভাতের থালা নিয়ে বসবেন, গ্লাসে ঢেলে জল খাবেন, তখন যেন তফাজ্জলের এ ম্লান, বিষণ্ণ, মনমরা মুখটা আপনাদের চোখের সামনে ভাতের বদলে ফিরে ফিরে আসে।'
'আপনার যেন এই মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণের মৃত্যুর অভিশাপে আর কখনো ভাত মুখে দিতে না পারেন,' আক্ষেপ আর ক্ষোভ ঝরে পড়েছে তার লেখায়।
আজ বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে এ হত্যাকাণ্ডকে 'অমানবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা' হিসেবে অভিহিত করে 'দুঃখিত ও মর্মাহত' হওয়ার কথা জানিয়েছে।
ফেসবুকে শান্ত কৈরী লিখেছেন, 'দেশের দুইটা বড় পাব্লিক ইউনিভার্সিটিতে মব লিঞ্চিং হইসে, ভিডিওতে বুঝাই যাচ্ছে হত্যাকাণ্ড হইসে; আর ভিসি-প্রক্টরের কোনো বক্তব্য নাই। দিব্যি চিল করে প্রোগ্রাম করে বেড়াইতেসে।'
আজহার উদ্দিন অনিক তার ফেসবুকে প্রশ্ন তোলেন, "রিপোর্টে দেখলাম প্রক্টরিয়াল টিম, হাউজ টিউটররা না-কি আরও অনেক আগেই ঘটনাস্থলে এসেছেন, কিন্তু তারা না-কি ছাত্রদের 'থামাতে' পারেন নাই মারধর করা থেকে। আর ইউ ফা** কিডিং মি?"
ঘটনাস্থলে থাকা প্রক্টর, প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্য এবং হলের হাউজ টিউটর/প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবি করে 'দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে' সদ্যগঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির এ সদস্য লেখেন, 'আপনাদের ব্যর্থতার কারণেই একটা মানুষ খুন হয়ে গেছে।'
বিবিসি বাংলার সাবেক একজন সাংবাদিক মীর রায়হান মাসুদ ফেসবুকে লিখেছেন, 'এই যে গণপিটুনি বা উদ্দেশ্যমূলক হত্যার পরে মানুষের আওয়ামী লীগ সরকারকে মিস করা বা অন্য কোনো ইন্ধন পাওয়ার ইশারা — দুপক্ষকেই সন্দেহের নজরে দেখবেন।'
পশ্চিমবঙ্গেল লেখক ও জীবনানন্দ গবেষক গৌতম মিত্র তার ফেসবুক প্রোফাইলে এক পোস্টে তোফাজ্জলের হত্যার নিন্দা করার সময় আরজি করের ঘটনাও স্মরণ করেছেন; তার কাছে মনে হয়েছে, দুটো ঘটনাতেই যেন 'খুব একটা মিল' রয়েছে।
'ঠাণ্ডা মাথায় এই দুটি খুন আমাদের হৃৎপিণ্ডের গতি স্তব্ধ করে দেয়, হাড়ে কাঁপন ধরায়, সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। কেন কেন কেন অকারণ এই প্রতিশোধস্পৃহা??? এই ২০২৪-এও আমরা কত অসহায় ভাবলে কান্না পায়!' তিনি লেখেন।
'হাহাকার লাগছে! তীব্র হাহাকার!' অসহায় ফুটে উঠেছে মেহেরুন নাহার মেঘলার ফেসবুক পোস্টেও। তার মতো আরও অনেকেই হয়তো এ অরাজকতার সময় নিজেদের ভেতরে গুমরে গুমরে মরছেন, আর আশায় বুক বেঁধে আছেন, কোনো একদিন তাদের দেশ আবার 'সুস্থ হবে'।