ক্যান্সার রোগীদের চুল পড়া রোধে সাহায্য করতে পারে এই হেলমেট
ক্যান্সার চিকিৎসা সম্পর্কে প্রায় সবাই জানেন যে চিকিৎসার পর চুল ঝরতে শুরু করে। গবেষণা বলছে, কেমোথেরাপি নিচ্ছেন এমন ৬৫ শতাংশ রোগী চুল পড়ার সম্মুখীন হন। কারণ কেমোথেরাপির ওষুধ, দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া কোষগুলোকে আক্রমণ করে; যার কারণে চুলের ফলিকল কোষগুলোও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।ফলিকল বা বীজকোষ হলো টিউবের মতো লোমকূপ যা চুলের গোড়াকে ঘিরে থাকে। বিশেষ করে স্তন ক্যান্সারের রোগীদের মধ্যে প্রায় ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ চুল হারান।
চিকিৎসা শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আবার চুল গজাতে শুরু করলে, অনেকেই এই ভয়ে চিকিৎসা নিতে রাজি হোন না, বিকল্প পন্থা খোঁজেন। ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ রোগী কেমোথেরাপির সবচেয়ে কঠিন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চুল পড়াকে উল্লেখ করেছেন।
চুল পড়া সীমিত করার একটি উপায় হলো 'স্কাল্প কুলিং' প্রযুক্তি। এতে রোগী একটি হেডগিয়ার পরিধান করেন, যা একটি মেশিনের সাথে সংযুক্ত থাকে এবং মাথার তালুতে ঠান্ডা তরল প্রবাহিত করে। এর ফলে চুলের ফলিকলে রক্তপ্রবাহ কমে যায় এবং ওষুধের প্রভাবও কমে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ বা তার বেশি রোগী চুল পড়া রোধ করতে সক্ষম হন।
তবে স্কাল্প কুলিংয়ের কিছু সমস্যা আছে। লুমিনেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যারন হ্যানন বলেন, "এই মেশিনগুলো বড় এবং স্থায়ীভাবে বসানো থাকে, তাই রোগীদের প্রতি কেমো সেশনের আগে ও পরে দীর্ঘসময় ধরে হাসপাতালে অবস্থান করতে হয়"।
এই সমস্যার সমাধানেই কাজ করছে হ্যাননের প্রতিষ্ঠান 'লুমিনেট'। কেমো-র চিকিৎসা নেয়া রোগীদের জন্য 'লিলি' নামে সম্পূর্ণ একটি পোর্টেবল হেলমেট বা হেডগিয়ার তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
হ্যানন বলেন, চিকিৎসার পর রোগীদের সাধারণত ৯০ মিনিটের জন্য এটি পরিধান করতে হয়। পোর্টেবল হওয়ায় রোগীদের আর দীর্ঘক্ষণ ধরে হাসপাতালে অবস্থান করতে হবে না, বাসায় গিয়ে-ই এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
নতুন হেলমেটটি কুলিংয়ের পরিবর্তে প্রেসার বা চাপ ব্যবহার করে, যার ফলে চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগে কোনো প্রি-কুলিংয়ের প্রয়োজন হয় না, দ্রুত কাজ করে এটি।
হ্যানন জানান, এটি ব্যবহারের সময় রোগীরা আরাম অনুভব করেন। তিনি বলেন, "কুলিং থেরাপি খুব ঠান্ডা এবং রোগীদের জন্য কিছুটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। তাই ব্যবহারকারীদের মধ্যে আরও আরামদায়ক বিকল্প তৈরির জন্য অনেক প্রতিক্রিয়া এসেছে"।
আলতো চাপ
লুমিনেট বর্তমানে ইউরোপে এটির পরীক্ষামূলক কাজ চালাচ্ছে এবং ফলাফল খুবই আশাব্যঞ্জক। কোম্পানির মতে, এটি ব্যবহার করা প্রায় ৭৫ শতাংশ রোগী কোনো চুল পড়ার সম্মুখীন হননি।
হ্যানন বলেন, স্তন ক্যান্সারের রোগীরা ১২টি সেশন শেষ করেও তাদের প্রায় সব চুল ধরে রাখতে পেরেছেন। তিনি আরও বলেন, "যন্ত্রটির কারণে কোনও গুরুতর সমস্যা হয়নি, তাই এটি নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে"।
রোগীদের ওপর প্রভাব
হ্যানন বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসায় চুল পড়া রোগীদের ওপর বড় প্রভাব ফেলে, শুধু তাদের চেহারাতেই নয়, বরং তাদের সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্য এবং অন্যদের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার ক্ষমতার ওপরও। "আমাদের এই উদ্যোগ শুরু করার পেছনে রোগীদের অভিজ্ঞতাই মূল অনুপ্রেরণা ছিল," যোগ করেন তিনি।
স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন এমন এক মায়ের কথা উল্লেখ করেন হ্যারন। তিনি (ক্যান্সার আক্রান্ত মা) বলেছিলেন, চুল পড়া তার জন্য শুধু একটি শারীরিক সমস্যা নয়; বরং তিনি চান তার সন্তানরা বিশ্বাস করুক যে তিনি সুস্থ আছেন এবং তাদের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে না হয় যে তাদের মা অসুস্থ। কিন্তু চুল ঝরে পড়ার কারণে বাধ্য হয়ে তাকে তার অসুস্থতা নিয়ে সন্তানদের কথা বলতে হতো।
নতুন প্রযুক্তির কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
লুমিনেট আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করার পরিকল্পনা করছে। মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) অনুমোদন পেলে তারা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিকভাবে এই প্রযুক্তি চালু করবে।
বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়ার সাথে সাথে এই যন্ত্রটি স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানির মাধ্যমে রোগীদের জন্য পাওয়া যাবে। প্রতিটি হেলমেটের জন্য বীমা কোম্পানির প্রায় ১,৭০০ ডলার খরচ হবে। সে হিসেবে তুলনা করলে, স্কাল্প কুলিং চিকিৎসায় সাধারণত ১,৫০০ থেকে ৩,০০০ ডলারের এর মধ্যে খরচ হয়ে থাকে।
হেলমেটটি মাথার তালুতে আলতো করে চাপ প্রয়োগ করে, ফলে চুলের ফলিকলগুলোর চারপাশের ছোট রক্তনালিগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
হ্যানন বলেন, ফলস্বরূপ, ওই রক্তনালীগুলোর ভেতরের রক্তচাপ বাইরের চাপের তুলনায় কমে যায়, যা চুলের ফলিকলের দিকে রক্তের প্রবাহ কমিয়ে দেয়। এর ফলে দুটি প্রভাব সৃষ্টি হয়: কেমোথেরাপির ওষুধ চুলের ফলিকলে কম পৌঁছে এবং রক্তের প্রবাহ কম থাকায় অক্সিজেনের মাত্রাও কমে যায়। এর ফলে কিছু ওষুধ যদি প্রবেশ করেও, তা কম কার্যকরী হয়।
২০১৮ সালে আয়ারল্যান্ডের গালওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা প্রকল্প হিসেবে লুমিনেটের যাত্রা শুরু। লুমিনেটের অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা হলেন বারবরা অলিভেইরা এবং মার্টিন ও'হ্যালোরান। ২০২১ সালে এটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সম্প্রতি তারা সিরিজ-এ অর্থায়নে ১৫ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছে।
কেমোথেরাপির অভিজ্ঞতা পরিবর্তন
নিউইয়র্ক সিটির মেমোরিয়াল স্লোয়ান কেটারিংয়ের স্তন ও ইমেজিং সেন্টারের নার্স লিডার অ্যান্ড্রিয়া স্মিথ জানান, চুল পড়ার ভয় চিকিৎসার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, চুল পড়ার আশঙ্কায় রোগীরা অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসা গ্রহণে দ্বিধাবোধ করেন। তারা হয় কম কার্যকরী চিকিৎসা বেছে নে, অথবা চিকিৎসায় বিলম্ব করতেন।
প্রায় আট বছর ধরে রোগীদের জন্য স্কাল্প কুলিংয়ে কাজ করছেন স্মিথ। বর্তমানে চুল পড়া রোধে তিনি একটি এফডিএ-অনুমোদিত প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন।
এই ব্যবস্থায় কুলিং ক্যাপগুলো একটি মেশিনের সাথে যুক্ত থাকে। কেমোথেরাপি শুরুর আগে রোগীদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্যাপটি পরিধান করতে হয়, যাতে মাথার ত্বককে আগে থেকেই ঠান্ডা করা যায়। কেমোথেরাপির পর, রোগীদের আরও কিছু সময় ক্যাপটি পরে বসে থাকতে হয়। পরিধানের সময়সীমা রোগীদের নির্দিষ্ট কেমোথেরাপির ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।
"একটি পোর্টেবল ডিভাইস হলে রোগীদের জন্য এটি ভালো হবে। আমি মনে করি রোগীরা এটি পছন্দ করবেন", যোগ করেন স্মিথ।
চুল পড়া এড়ানো ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য একটি 'গেম-চেঞ্জার' বলে মন্তব্য করেছেন স্মিথ। তিনি বলেন, "রোগীরা মনে করেন, চুল না থাকলে মানুষ জানবে যে তারা ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং কেমোথেরাপি করছেন। 'স্কাল্প কুলিং' তাদের সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে, সেই সাথে কিছু চুল ঝরে পড়ার সম্ভাবনাও কমিয়ে দিয়েছে।"
হ্যাননের মতে, লুমিনেটের প্রেসার ভিত্তিক হেলমেটগুলোও প্রাথমিকভাবে একই ধরনের ফলাফল দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, "কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এটি কেমোথেরাপির পুরো অভিজ্ঞতাকেই বদলে দিয়েছে, যা সত্যিই খুব হৃদয়স্পর্শী"।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন