এই তবে রাজউকের উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্পের অবস্থা!
সরকারি চাকরীজীবী জাহাঙ্গীর আলম। দীর্ঘদিন ধরে জমানো ৭০ লাখ টাকায় উত্তরা আবাসিক শহর থার্ড ফেজের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে একটি ফ্ল্যাটের বুকিং দিয়েছিলেন। নির্ধারিত সময়ের দুই বছর পর ২০১৮ সালে 'এ' ব্লকে একটি ফ্ল্যাট তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়।
নিম্মমানের ফিটিংস দিয়ে তৈরি সেই ফ্ল্যাটে নেই পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ। তবু এটি আবাসিক ফ্ল্যাট। ভাড়া বাসায় থাকার সামর্থ্য নেই বলে ইউলিটি সুবিধা ছাড়া এই ফ্ল্যাটেই থাকতে হচ্ছে তাকে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাজউককে বললেই বলে শীগগিরিই বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে। প্রতি মাসেই এ কথা বলে। কিন্তু বিদ্যুৎ আর আসে না। পানির কথা বললে রাজউক জানায়, দ্রুতই ওয়াসা সংযোগ দেবে। পানিও আর আসে না। এই ভবনে এখনো গ্যাস সংযোগও দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, লিফট লাগানো আছে, চালু নেই। মানহীন লিফট শুরুর দিকে একবার চালানো হলেও এখন অকার্যকর। ফ্ল্যাটের মেঝেতে যে টাইলস বসানো হয়েছে, সেগুলো উঠে যেতে শুরু করেছে। রান্নাঘর ও বাথরুমে লাগানো অনেক ফিটিংসও নষ্ট হয়ে গেছে।
উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের ১৮ নম্বর সেক্টরে ২০০৯ সালে ২১২ একর জমিতে ২০ হাজার ১৬০টি ফ্ল্যাট তৈরির উদ্যোগ নেয় রাজউক। ২০১০ সালের ২১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৬ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটিতে ২৪০টি ১৬ তলা ভবনে ১৮,৭৩২টি ফ্ল্যাট তৈরি করার কথা ছিল। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯০৩০ কোটি।
প্রকল্পের 'এ' ব্লকে কেবল ৭৯টি ভবনে প্রায় ৬ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়েছে। বি ও সি ব্লকে বাকি ভবনগুলো কবে নাগাদ নির্মাণ হবে, তার কোনো সঠিক উত্তর রাজউকের কাছে নেই। 'বি' ব্লকের ৭২টি ভবনে ৬,০৪৮টি এবং 'সি' ব্লকের ৭২টি ভবনে ৬,৬০৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কথা।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের 'এ' ব্লকে ৬ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হলেও বিক্রয় হয়েছে ৩ হাজারের মতো। বাকি ৩ হাজার এখনো অবিক্রিত।। ১ হাজারের মতো ফ্ল্যাট মালিককে চাবি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ২০১৮ সালের শেষের দিকে। বসবাস শুরু করেছেন শ' দুয়েক ফ ফ্ল্যাট মালিক।
অবিক্রিত ৩ হাজারের মধ্যে বেশ কিছু ফ্ল্যাট ব্যবহার করা হচ্ছে কোভিডের জন্য। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের এখানে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।
রাজউক প্রতিটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে গ্রাহকদের কাছ নিয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা টাকা করে। প্রকল্পের যে একটি মাত্র ব্লকে ৭৯টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, তার কোনোটিতেই এখন পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ নেই। অল্প কয়েকটি ভবনে পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও সব ফ্ল্যাটে নেই। ৪৭টি ভবনে লিফট থাকলেও সেগুলো বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে।
অ্যাপার্টমেন্ট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি হামিদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রতিটি ফ্ল্যাট ১৬২০ বর্গফুট আয়তনের হওয়ার কথা থাকলেও ব্যবহারযোগ্য অংশ ১২০০ বর্গফুটেরও কম।
তিনি জানান, ভবনগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা একেবারেই নেই। কোনো সীমানা প্রাচীর না থাকায় বহিরাগতরা যখন- তখন ভবনগুলোতে ঢুকে পড়ে। নানা অসামাজিক কাজকর্মও করে তারা। এসব অভিযোগ নিয়ে সমিতি একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনও করেছে।
অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক ও রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ হেলালী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কাজ চলমান। শিগগিরই সব ফ্লাটে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেয়ার কাজ শেষ হবে।
তিনি বলেন, প্রকল্পে গ্যাস সংযোগ দেয়ার জন্য তিতাসের কাছে চাহিদাপত্র দেয়া আছে। কিন্তু আবাসিক গ্যাস সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে যেসব ফ্ল্যাটে লোকজন বাস করছে, সেখানে কমিউনিটি এলপিজি ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে রাজউক।
ফ্ল্যাটের মানহীন কাজ নিয়ে লতিফ হেলালি বলেন, তিনি আগে এ প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ওইসব কাজ যারা করেছেন তারা অবসরে চলে গেছেন। তবে নিরাপত্তার বিষয়টিতে নজর দিচ্ছে রাজউক। এই প্রকল্পে যারা ফ্লাট বুঝে পেয়েছেন, তারা সবাই বসবাস শুরু করলে নিরাপত্তাহীনতা কেটে যাবে।
গ্যাস সংযোগ দেয়া প্রসঙ্গে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী ইকবাল নূরুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই প্রকল্পে গ্যাস দিতে এখনো জ্বলানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়া যায়নি। তাই চাহিদাপত্র অনুযায়ী গ্যাস সংযোগের কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. কাউসার আমির আলী বলেন, অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প এলাকায় কিছু ভবন ও ফ্ল্যাটে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। বাকিগুলোত পর্যায়ক্রমে দ্রুত সংযোগ দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই এলাকায় মাটির নীচ দিয়ে বিদ্যুতের সরবরাহের তার নেয়া হবে। কিন্তু কিছু এলাকায় রাস্তার কাজ শেষ না হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ওয়াসার ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (প্রশাসন) মো. মাহমুদ হোসাইন বলেন, কিছু ভবনে পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা বাকি আছে। সেগুলোর কাজ চলছে।
উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাজউক যে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ, তার একটি একজন প্রতিমন্ত্রী ও অন্যটি একজন সংসদ সদস্যের। তারা নিম্নমানের ভবন তৈরি করেছে। ভবনের ফ্ল্যাটগুলোও নিম্নমানের।
তিনি বলেন, প্রকল্পের বি ও সি ব্লকের কাজও তারা পেয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারেনি।
২০১৬ সালের মধ্যে যে প্রকল্পের যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা, তার তিনটি ব্লকের মধ্যে মাত্র একটি শেষ হয়েছে।
রাজউক চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম জানান, বিভিন্ন জটিলতায় কাজ শেষ করা যায়নি। প্রকল্পের কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী বছরের মধ্যেই সব ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে।