হেফাজত তাণ্ডবের সাক্ষী বিধ্বস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া
সোমবার (২৯ মার্চ) দুপুর ১২টা। সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গণের ভেতর থেকে তখনো ধোয়া বের হচ্ছিল। স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছিল আগুনের তাপ। হেফাজতকর্মীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ'র স্মৃতিবিজড়িত এই স্থাপনা। সঙ্গীতাঙ্গনের মিলনয়তনের সরোদমঞ্চ পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পুড়ে গেছে মিউজিয়ামে রক্ষিত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। এখন শুধু পড়ে আছে আগুনে পোড়া জিনিসপত্রের ধ্বংসাবশেষ।
গতকাল রোববার (২৮ মার্চ) হেফাজতে ইসলামের হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। হেফাজতকর্মীদের চালানো সেই ধ্বংযজ্ঞের চিহ্ন এখন সর্বত্র। বাতাসেও ছড়িয়েছে পোড়া গন্ধ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ভবন, দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গণ, সদর উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, জেলা পরিষদ কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের কার্যালয় ও বাড়ি, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেনের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন হেফাজতকর্মীরা।
এছাড়া হেফজাতকর্মীরা ব্যাংক এশিয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালান। এছাড়াও গতকাল রোববার জেলা সদরে এবং সরাইলের বিশ্বরোড মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে হরতালকারীদের সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হন।
তবে সোমবার সকাল থেকেই স্বাভাবিক রূপে ফিরেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। জেলা শহরের সকল দোকানপাট খুলেছে, যানবাহনের চাকাও ঘুরছে স্বাভাবিক গতিতে। এছাড়া কুমিল্লা-সিলেট এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। ব্যাংক-বীমাসহ সকল প্রতিষ্ঠানেই স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। তবে সবকিছু স্বভাবিক হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে হেফাজতকর্মীদের হাতে আক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাগুলোতে।
সোমবার দুপুরে আগুনে পোড়া স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখা গেছে হেফাজতকর্মীদের চালানো ভয়াবহ সেই তাণ্ডবের চিত্র। হেফাজতের নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগুনে পোড়া ভবনগুলো। ভবনের ভেতরের সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে পড়ে আছে শুধু ধ্বংসাবশেষ। ভবনগুলো এখন দেখতে অনেকটা পোড়াবাড়ির মতো।
খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা
হেফাজতকর্মীদের চালানো গতকালের ধ্বংসযজ্ঞের কারণে খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ভবনের সকল জিনিসপত্র পুড়ে যাওয়ায় থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। থানার সামনে ওসিসহ অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। গতকাল ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধের পর হেফাজতকর্মীদের সাথে প্যান্ট-শার্ট পরা কিশোর-তরুণরাও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ান। এক পর্যায়ে তারা থানায় আগুন দেন। পুলিশের একটি এপিসি ভাঙচুরের পর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় সেটি।
সোমবার দুপুরে থানায় গিয়ে আগুনে পোড়া দুটি গাড়ি ও আসবাবপত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছে। থানার সামনে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন হয়ে পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া এপিসি ও দুটি গাড়ি। এছাড়া ভাঙচুরের শিকার থানার ওসির কক্ষের জিনিসপত্রও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গণ
শহরের জেল রোডের চিত্র আগের মতোই স্বাভাবিক। এই রোডের সকল হাসপাতাল ও রেস্টুরেন্টসহ সব দোকানপাট খুলেছে। কিন্তু জেল রোডে অবস্থিত দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গণের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ভেতর থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া, অনুভূত হচ্ছে আগুনের তাপ।
রোববার দুপুরে কয়েক শ হেফাজতকর্মী লাঠিসোটা নিয়ে সঙ্গীতাঙ্গণে হামলা চালান। হামলাকারীরা সঙ্গীতাঙ্গণে থাকা আলাউদ্দিন খাঁ মিউজিয়াম, মিলনায়তন, সরোদ মঞ্চ ও অফিসকক্ষ এবং প্রশিক্ষণকক্ষ ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করেন। মিউজিয়ামে থাকা আলাউদ্দিন খাঁ'র স্মৃতিবিজড়িত বেশকিছু ফটোগ্রাফসহ কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র পুড়ে গেছে। মিউজিয়ামের ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাঁচ ও পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্রের ছাই। আগুনে পুড়ে সঙ্গীতাঙ্গণের দেয়ালের পলেস্তারাও খসে পড়েছে। পাখাগুলো আগুনের তাপে বাকা হয়ে গেছে। আর মিলনায়তনের ভেতরে পুড়ে যাওয়া চেয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্রের ধ্বংসাবশেষের স্তূপ দেখা গেছে।
পৌরসভা কার্যালয়
আগুনে পৌরসভা কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলার সব ক'টি কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকটি কক্ষে থাকা প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মেয়র ও সচিবের কক্ষে পোড়া আসবাবপত্র পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যে জিনিসপত্রগুলো আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছে, সেগুলোই এখন ভেতর থেকে বের করছেন পৌরসভার কর্মচারীরা। কবে নাগাদ পৌরসভার কার্যক্রম শুরু হবে, সেটি স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
সদর উপজেলা ভূমি অফিস
হেফাজতকর্মীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে সুনশান নীরবতা। কয়েকজন কর্মচারীকে নিয়ে সহাকারী কমিশনারকে কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করতে দেখা গেছে। আগুনে কার্যালয়ের রেকর্ড রুমে রক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ সকল নথিপত্র পুড়ে গেছে। অফিসের সামনে পুড়ে যাওয়া সেই নথিপত্রগুলো পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কিছু নথিপত্র না পুড়লেও আগুন নেভানোর জন্য দেওয়া পানিতে ভিজে সেগুলোও নষ্ট হয় গেছে।
আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন
হেফাজতকর্মীদের চালানো তাণ্ডবের শিকার আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তনটিতে এখন ছাই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মিলনায়তনের কয়েক শ চেয়ার ও দরজা-জানালা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। দেয়ালের পলেস্তারাও খসে পড়েছে। সব ক'টি পাখা আগুনের তাপে বাঁকা হয়ে নিচের দিকে হেলে পড়েছে।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর
হরতাল চলাকালে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে জেলা প্রশাসন আয়োজিত উন্নয়ন মেলার অর্ধশত স্টলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন হেফাজতকর্মীরা। ভাঙচুর-আগুনে বিধ্বস্ত ভাষা চত্বরজুড়ে কেবল ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ। ভাঙচুর ও আগুনে পোড়া জিনিসপত্রের স্তূপ দেখা গেছে সেখানে। ভাষা চত্বরের বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয় ও বাড়ি
হেফাজতকর্মীরা জেলা শহরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের ব্যক্তিগত কার্যালয়টি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছেন। কার্যালয়ে গিয়ে আগুনে পোড়া জিনিসপত্রের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এছাড়া শহরের ফুলবাড়িয়ায় আল মামুন সরকারের বাড়িতেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুনে ঘরের কয়েকটি কক্ষের সোফা, পাখা ও এসিসহ অন্যান্য আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্রগুলো এখনো ঘর থেকে সরানো হয়নি।
জেলা পরিষদ কার্যালয়
হরতাল সমর্থনে হেফাজতকর্মীরা জেলা পরিষদ কার্যালয়েও আগুন দেন। আগুনে জেলা পরিষদ মিলনায়তনের সকল চেয়ার, এসি ও পাখা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জেলা পরিষদের কার্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সরকারি গাড়িটি হেফাজতকর্মীদের দেওয়া আগুন পুড়ে গেছে। ভবনে থাকা সকল আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গণের সাধারণ সম্পাদক মনজুরুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৫৬ সালে এই সঙ্গীতাঙ্গণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০১৬ সালেও একবার মৌলবাদীরা এই সঙ্গীতাঙ্গণে আগুন দিয়েছিল। এবারের আগুনে সঙ্গীতাঙ্গণের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজড়িত শেষ যে কয়েকটি জিনিসপত্র ছিল, সেগুলোও এবার শেষ হয়ে গেছে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এ. বি. এম. মশিউজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমার কক্ষসহ অন্যান্য কক্ষে আগুন দেওয়া হয়েছে। সবকিছু পুড়ে গেছে। রেকর্ড রুমে আগুন দেওয়ার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে গেছে। এতে করে সাধারণ মানুষেরই বেশি ক্ষতি হয়েছে।'
খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গাজী শখাওয়াত হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পুরো থানায় ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে হেফাজতকর্মীরা। অস্ত্রাগারেও হামলা চালিয়েছে। এপিসিসহ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সব ক্ষয়ক্ষতি এখনও নিরূপণ করা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষ পরিদর্শনের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
এদিকে, সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হেফাজতকর্মীদের হাতে আক্রান্ত স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন। হেফাজতের তা-বের ঘটনা তদন্তের পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তাণ্ডবের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সদর মডেল থানায় ৫টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৩টি মামলা পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করেছে। বাকি দুটির মধ্যে একটি ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আরেকটি আনসার ও ভিডিপি কর্তৃপক্ষ দায়ের করেছে। এ মামলাগুলোতে অজ্ঞাত ৭ হাজারেরও বেশি দুষ্কৃতিকারীকে আসামি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ২০টির বেশি ঘটনাস্থল রয়েছে। সবগুলো ঘটনাতেই মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। এখন পর্যন্ত পাঁচটি মামলা হয়েছে। সিআইডি ও পিবিআইর বিশেষজ্ঞ টিম ডাকা হয়েছে। তারা প্রতিটি ঘটনাস্থল ঘুরে আলামত সংগ্রহ করবে। প্রতিটি ঘটনার মামলা বিশেষজ্ঞ টিম তদন্ত করবে।