ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট প্রকল্প এখনো অন্ধকারে
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করা ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এক সময় রপ্তানি করত প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু ১৯৬৮ সালে নির্মিত লাভজনক এই প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হলেও নতুন কোনো প্ল্যান্ট সৃষ্টি হয়নি এই খাতে। ফলে জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি নির্ভরতা।
তেল পরিশোধন লাভজনক হওয়ায় ২০১০ সালে সরকার দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য ৩০ মিলিয়ন পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি-২ নামে নতুন একটি প্ল্যান্ট প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হাতে নেওয়া সেই প্রকল্প গত ১১ বছরেও পিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করতে পারেনি।
বিকল্প প্ল্যান্ট স্থাপনের এই দীর্ঘসূত্রতা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলবে বলে আশঙ্কা খাত সংশ্লিষ্টদের।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়াতে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) ৩০ লাখ টন সক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১০ সালে। কিন্তু ১১ বছর শেষেও ২য় ইউনিটটির কাজ শুরুই করতে পারেনি ইআরএলের পরিচালন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
সম্প্রতি দশমবারের মতো প্রকল্পটির ডিপিপি সংশোধন করে চূড়ান্ত প্রস্তাবণা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা এখনো পাস হয়নি। নতুন করে কবে নাগাদ প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে, সে বিষয়ে কোনো তথ্যও নেই বিপিসি কিংবা ইআরএল কর্মকর্তাদের কাছে।
পাকিস্তান আমলে স্থাপিত ইস্টার্ন রিফাইনারি প্ল্যান্টটির অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল কার্যত শেষ হয়ে গেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা বৃদ্ধি ও পুরনো প্ল্যান্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই প্রায় দ্বিগুণ সক্ষমতার নতুন একটি পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপনের ওই পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয় ২০১০ সালে। ১০ দফায় ডিপিপি সংশোধন সত্ত্বেও প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরুই করতে পারেনি বিপিসি। এতে প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ১৩ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির উর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি খাতের রিফাইনারিদের সুযোগ দিতে বিপিসি'র প্রকল্পটির বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায় থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও কাজ শুরু করতে পারেননি দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। যার কারণে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও বিপিসি ও ইআরএলের নতুন প্রকল্প নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ বলে দাবি করেছেন তারা।
বিপিসি ও ইআরএলের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর জ্বালানির চাহিদা রয়েছে ৫৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। বর্তমানে ইআরএলের জ্বালানি তেলের পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন। ইআরএল ধারণ ক্ষমতার ৯৬ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি পরিশোধন করতে পারে। নতুন প্রকল্পটির ২য় ইউনিট চালু হলে আরও ৩০ লাখ টনসহ মোট ৪৫ লাখ টন তেল পরিশোধন করার ক্ষমতা রাখবে ইআরএল।
২০১০ সালে হাতে নেওয়া প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসাল্ট (পিএমসি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারস ইন্ডিয়া লিমিটেডকে। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিপিসি। ওই অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৭ সালের মধ্যেই ইআরএল-২ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ৭ মে চট্টগ্রামে ইআরএলের সুবর্ণজয়ন্তির অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী আবারও ২য় দফায় কাজ দ্রুত শুরু করার ঘোষণা দিলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি।
এদিকে ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অনলাইনে বিপিসির বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্পের পর্যালোচনা সভায় ইআরএলের ২য় প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। প্রকল্প পরিচালকদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার জন্য প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মন্ত্রণালয় এর দায় নেবে না বলে ওই সভায় জানিয়ে দেন প্রতিমন্ত্রী। প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে ওই সভায় মনিটারিং জোরদার করারও নির্দেশনা দেন।
মন্ত্রীর নির্দেশনার পরে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস্ ব্লেন্ডার্স লিমিটেডের (ইএলবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমানকে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ইআরএলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, ইআরএলের সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আকতারুল হক প্রকল্পটির কাজের অগ্রগতি দেখাতে না পারায় তাকে সরিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
বিপিসি ও ইস্টার্ন রিফাইনারির কর্মকর্তারা জানান, সরকার থেকে প্রকল্পটির কাজ শুরুর জন্য বিপিসি ও রিফাইনারির দায়িত্বপ্রাপ্তদের বারবার নোটিশ করলেও প্রকল্পের কাজ নিয়ে কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেননি তারা। এমনকি ইস্টার্ন রিফাইনারির প্রকল্পের কাজ বাদ দিয়ে বরং এই সময়ে বেসরকারি খাতের রিফাইনারির অনুমোদনের পরিমাণ বেড়েছে বেশি।
সরকারি এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি খাতের রিফাইনারিগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসা করতে হবে। যার কারণে এক দশক পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির কাজ শুরু করতে পারেনি বিপিসি।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান বলেন, 'আমি নতুন দায়িত্বে এসেছি। রিফাইনারিটির ২য় প্রকল্পের কাজ কবে শুরু হবে কিংবা আদৌ শুরু হবে কি না, এই বিষয় সম্পর্কে আমরা গণমাধ্যমকে কোনো ধরনের তথ্য দেব না। কিছু জানার থাকলে বিপিসি বা মন্ত্রণালয় থেকে জেনে নিতে পারেন।'
১৯৬৮ সালে ইআরএল শোধনাগারটির নকশা নির্মাণ করেছিল ফ্রান্সের কোম্পানি টেকনিপ। প্রস্তাবিত ২য় প্রকল্পের কাজটিও টেকনিপকেই দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রকল্পে টেকনিপের নকশা অনুসারে ভৌত কাজ ও যন্ত্রপাতি বসাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২২ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পের কাজ অতিমাত্রায় বিলম্বিত হওয়ার কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে।
এছাড়া এই প্রকল্পে ১০টি প্রসেসিং ইউনিট রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিট সম্পন্ন হলে ইআরএল থেকে ফিনিশড প্রোডাক্ট হিসেবে পাওয়া যাবে এলপিজি, গ্যাসোলিন ইউরো-৫, ডিজেল ইউরো-৫, গ্রুপ-৩ বেসঅয়েল, জেট এ-১, ফুয়েল অয়েল, বিটুমিন ও সালফার। এতে আমদানি করা পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যে ব্যয় সাশ্রয় হবে।
২০১০ সালে প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তীকালে ১৬ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা সংশোধিত ব্যয় ধরে ২য় ইউনিটের প্রকল্প পাস করা হয়। এর পরে প্রকল্পের কাজ শুরু নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কয়েকবার চিঠি চালাচালি হলেও কাজ কার্যত শুরু করা যায়নি।
তবে ২০১৮ সালে প্রকল্পের ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে জমা হলেও এই ডিপিপি কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে। অবশ্য নতুনভাবে প্রকল্পের কাজের আবারও ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বোর্ড। ডিপিপিতে মেয়াদ ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর রাখা হয়েছে।
প্রকল্পের প্রাক্কালিত চূড়ান্ত বাজেট ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৮৩৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। প্রকল্পটি পাসের অপেক্ষায় আছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) ও ইআরএল পর্ষদের পরিচালক সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেন, দশমবারের মতো ইআরএল-২ প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করে নতুন মেয়াদে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্পটি পাস হলে কাজ শুরু হবে। নতুন করে কাজের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না।
উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানি
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ৭৯৩ টন এলপিজি, ৯৬ হাজার ৮২১ টন ন্যাপথা, ৮৭ হাজার ৮৬৬ টন এমএস (পেট্রোল), ৫ হাজার ৮৫৩ টন এইচওবিসি (অকটেন), ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৭ টন এসকেও (কেরোসিন), ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭০ টন এইচএসডি (ডিজেল), ২০ হাজার ২৪৯ টন জেবিও, ৩ লাখ ৩ হাজার ৫১১ টন ফার্নেস ওয়েল (এফও), ৫৮ হাজার ১৬২ টন বিটুমিন এবং ১০ হাজার ২৮৮ টন অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করে।
২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ইস্টার্ন রিফাইনারি ৪৬ হাজার ৫২৭ টন হাই স্পিড ডিজেল (এইসএসডি), ২৬ হাজার ২২৭ টন হাই অক্টেন ব্লেন্ডিং কম্পোনেট (এইচওবিসি) এবং ৫০ হাজার ৫১ টন ফার্নেস ওয়েল (এইচএস) আমদানি করে।
২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯৩ হাজার ৮৬ টন ন্যাপথা রপ্তানি করলেও পরের বছর থেকে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।