ভূমিকম্প: ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা হয় কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না সিলেটে
এমনিতেই ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সিলেট। ফলে এখানে ভূমিকম্প নিয়ে রয়েছে আগে থেকেই আতঙ্ক। সাম্প্রতিক দফায় সেই আতঙ্ক আরও বেড়েছে। তবে আতঙ্ক থাকলেও ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে নেই তেমন কোনো প্রস্তুতি।
সম্প্রতি সংঘটিত ছোট ছোট ভূমিকম্পের কারণে বড় ধরণের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বড় ভূমিকম্প হলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা প্রকাশ করে তারা সিলেটের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলা ও প্রতিটি বহুতল ভবন ভূমিকম্প সহনীয় কী না তা পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিভিন্ন সময় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হলেও এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখনও এসব ভবনে চলছে কার্যক্রম। এতে ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
সর্বশেষ গত ৭ জুন সন্ধ্যায় সিলেটে দুই দফা ভূমিকম্প হয়। মাত্র ৩.৮ মাত্রার এই ভূমিকম্পেই ফাটল দেখা দেয় নগরের বন্দরবাজার এলাকার রাজা জিসি স্কুলের একটি ভবনে। পরদিন প্রকৌশলীরা পরিদর্শন করে জানান, সেই স্কুল ভবনটি ভূমিকম্প সহনীয়ভাবে নির্মাণ করা হয়নি।
এর আগে গত ২৯ মে সকাল ১০টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যে সিলেটে অন্তত পাঁচটি ভূকম্পন অনুভূত হয়। পরদিন ভোরে আবার ভূমিকম্প হয়। যার সবগুলোর কেন্দ্রস্থল সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকায়।
২৯ ও ৩০ মে'র ভূমিকম্পের পর কিছুটা নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ৩০ মে নগরের ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। এরমধ্যে ওইদিনই ৭টি ভবনকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া সব ভবনের জরিপের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তবে বন্ধ রাখার নোটিশ দেওয়া এই ভবনগুলো আরও ৫ বছর আগেই ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিলো সিসিক। পরে অজ্ঞাত কারণে সে উদ্যোগ থেমে যায়। এইসময়ে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ভবনগুলো।
জানা যায়, ২০১৬ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে নগরের ৩টি ভবনকে চিহ্নিত করে সিসিক। এই তালিকায় ছিল অনেক বাসা-বাড়ি, বিপণিবিতান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হোটেল, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা।
সেসময় ওই ভবনগুলো 'অতি দ্রুত' ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় সিলেট সিটি করপোরেশন। মালিকপক্ষ না ভাঙলে নিজেরাই ভবনগুলো ভেঙে দেবে বলে জানায় সিসিক। এরমধ্যে দুয়েকটি ভবন ভাঙ্গার কাজ শুরুও করে সিসিক। তবে এরপরই আটকে যায় কাজ।
পরে সিসিকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভাঙা নয়, মেরামত করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো। কিন্তু পাঁচ বছরে সেই মেরামত কাজও হয়নি।
সে সময় সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, কেবল ৩২টি নয়, নগরীতে আরো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তাদের তালিকা করে নোটিশ দেওয়া হবে। এর মধ্যে শপিং মল, অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেলও রয়েছে। এসব বহুতল ভবনের বেশিরভাগেরই নির্মাণ অনুমোদন নেই।
তবে কিছুদিন তোড়জোড়ের পর স্থিমিত হয়ে পড়ে সেই উদ্যোগ। তালিকা করার কাজও আর এগোয়নি।
এরপর ২০১৯ সালের আরেক জরিপে জানানো হয়- নগরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে ২৫টি। সেগুলো হলো- জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উত্তর পাশের কালেক্টরেট ভবন-৩, জেলরোডস্থ সমবায় ব্যাংক ভবন, একই এলাকায় মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার সাবেক কার্যালয় ভবন, সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজারস্থ সিটি সুপার মার্কেট, জিন্দাবাজারের মিতালী ম্যানশন, দরগা গেইটের হোটেল আজমীর, বন্দরবাজারের মধুবন সুপার মার্কেট, টিলাগড় কালাশীলের মান্নান ভিউ।
এছাড়া, নগরের শেখঘাট এলাকায় শুভেচ্ছা-২২৬ নম্বর ভবন, যতরপুরের নবপুষ্প ২৬/এ বাসা, চৌকিদেখির ৫১/৩ সরকার ভবন, জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশন, পুরান লেনের ৪/এ কিবরিয়া লজ, খারপাড়ার মিতালী-৭৪, মির্জাজাঙ্গাল মেঘনা এ-৩৯/২, পাঠানটুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর বাগবাড়ির একতা ৩৭৭/৭ ওয়ারিছ মঞ্জিল, একই এলাকার একতা ৩৭৭/৮ হোসেইন মঞ্জিল, একতা-৩৭৭/৯ শাহনাজ রিয়াজ ভিলা, বনকলাপাড়া নূরানি-১৪, ধোপাদিঘীর দক্ষিণ পাড়ের পৌরবিপণী মার্কেট ও ধোপাদিঘীরপাড়ের পৌর শপিং সেন্টার।
২৯ ও ৩০ মে ভূমিকম্পের পর সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানশ্যান ও রাজা ম্যানশন মার্কেট ১০ দিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করে সিসিক।
এছাড়া জিন্দাবাজার এলাকার জেন্টস গ্যালারি নামক একটি দোকান ও পনিটুলার একটি আবাসিক ভবনও ১০ দিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি এই বিপণিবিতানগুলো আবার চালু হয়েছে।
পাঁচ বছর আগে উদ্যোগ নিয়েও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো কেন ভাঙা হলো না জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, 'তখন ভাঙার কাজ শুরু হয়েছিল। তবে পরে বিশেষজ্ঞরাই ভবনগুলো না ভেঙে সংস্কারের পরামর্শ দেন। কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন মালিক কর্তৃপক্ষ সংস্কার করেছেনও। আবার কয়েকটিতে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে'।
তিনি বলেন, সিলেটে প্রায় ৭০ হাজার হোল্ডিং আছে। এরমধ্যে সাততলার উপরে ভবন আছে অন্তত ৪০০টি। তবে সিটি করপোরেশনের হিসেবের বাইরেও আরও অনেক বহুতল ভবন আছে। এখন আবার বহুতল ভবনগুলোর ব্যাপারে জরিপ চালানো হবে।
নুর আজিজ বলেন, 'নগরের বহুতল ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় কী না তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা দ্রুতই সে উদ্যোগ নেবো। সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আমাদের পক্ষে ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়। তবে যে ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেগুলোর সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টানিয়ে দেবো'।
সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কাছ থেকে নকশা অনুমোদন না করিয়ে এবং মাটির পরীক্ষা ছাড়াই অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে সিলেটের বেশিরভাগ বহুতল ভবন। এ ছাড়া প্রায় শতাধিক ভবন রয়েছে যেগুলো নির্মাণ করা হয়েছে দীর্ঘদিন আগে। এসব ভবন এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে ফাটল ধরা এসব ভবনে ঝুঁকি নিয়েই চলছে বসবাস।
বছর দশেক আগে বাংলাদেশ, জাপান ও শ্রীলংকার একটি বিশেষজ্ঞ টিম সিলেট নগরীর ৬ হাজার ভবনের উপর জরিপ চালিয়ে একটি গবেষণা রিপোর্ট তৈরি করে। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, সিলেটের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবনই অপরিকল্পিত এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে সাত বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে অধিকাংশ ভবনই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এ কারণে সিলেটের মানচিত্রও পাল্টে যেতে পারে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণের কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হবে নগরীর শাহজালাল উপশহর, আখালিয়া, বাগবাড়ি, মদিনা মাকের্ট প্রভৃতি এলাকা। বাণিজ্যিক ভবন ও ইমারতের পাশাপাশি নগরীতে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
এই গবেষক দলের সদস্য ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম।
তিনি বলেন, 'ভূমিকম্পের দিক থেকে সিলেট মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও ক্ষতিক্ষতি-হ্রাসের কোনো উদ্যোগ বা প্রস্তুতি এখানে নেই'।
জহির বিন আলম বলেন, 'সিলেটে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নগরীর সব ভবনকে ভূমিকম্প প্রতিরোধক করা। এজন্য নতুন ভবন নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষা করতে হবে। মাটির ধরণের উপর নির্ভর করে ভবনকে একতলা বা বহুতল করতে হবে। জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা যাবে না। ভূমিকম্প প্রতিরোধী ডিজাইনে এবং মানসম্পন্ন নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে দালান তৈরি করতে হবে। আর পুরনো দুর্বল ভবনগুলোকে সংস্কার করে শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। সম্ভব না হলে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে কোন অবস্থাতেই ভবন নির্মাণ করা যাবে না'।