অসময়ে বৃষ্টি ও বন্যায় বগুড়ায় সবজির চারা উৎপাদন ব্যবসা ম্লান
সবজির চারা উৎপাদনে 'দেশের সর্ব বৃহৎ' নার্সারি এলাকা হিসেবে প্রসিদ্ধ বগুড়ার শাজাহানপুরের শাহনগর। কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের হিসাবে এখানে উৎপাদিত চারা দেশের ৪০টির বেশি জেলায় যায়। অন্যান্য বছর এখানে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি চারা বিক্রি হলেও এবার মাত্র ১০ কোটি টাকার বিক্রি সম্ভাবনা রয়েছে।
এই হিসাবে শুধু শাহনগরে কৃষকদের প্রায় ৩০ কোটি টাকা লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শাজাহানপুরের কৃষকেরা বলছেন, ১৯৮৫ সালের দিকে প্রথমে শাহনগর বড়পাথার এলাকায় নার্সারি ব্যবসা শুরু হয়। বর্তমানে শাহনগর, বড়পাথার, চুপিনগর, দুরুলিয়া, বৃ-কুষ্টিয়া, খোট্রাপাড়াসহ অন্তত ২০ গ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৫০টি ছোট-বড় নার্সারি। এখানে অন্তত ২৫০ বিঘা জমিতে প্রতি বছর চারা উৎপাদন করা হয়। শাহনগরসহ আশপাশের এলাকায় বছরের পর বছর ধরে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, পেঁপেসহ হাইব্রিড জাতের মরিচের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের। অভাব ঘুচিয়ে অনেকে হয়েছেন সাবলম্বী।
তবে এবার নার্সারি মালিকেরা লোকসানে রয়েছেন। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এবার অসময়ে বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে কৃষিজমি চাষাবাদের অনুপোযোগীতার কারণে এমন সংকট তৈরি হয়েছে।
শাজাহানপুর শহানগর নার্সারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম বলেন, 'এ মৌসুমে আড়াই শতাধিক নার্সারিতে অন্তত ১ হাজার ৭০০ কেজি মরিচের বীজের চারা উৎপাদন হয়েছে। এক কেজি বীজ থেকে গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার চারা উৎপাদন হয়। একই সঙ্গে ১০০ কেজি কপি, ৫০ কেজি টমেটোসহ অন্যান্য বীজের চারা উৎপাদন করা হয়। এসব বীজ থেকে উৎপাদিত চারা অর্ধ শতাধিক টাকারও বেশি বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু এবার নার্সারি মালিকদের অবস্থা খুব খারাপ।
শাহনগরের নার্সারি মালিকরা জানান, শাজাহানপুরে প্রতি বছর অন্তত ২০ কোটি চারা উৎপাদন হয়। গত বছর প্রতি ১ হাজার চারা বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা দরে। গড় বিক্রয়মূল্য ছিল ২ হাজার টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর এখানে চারা বিক্রি হয় ৫০ কোটি টাকার উপরে। কিন্তু এবার একই ১ হাজার পিস জাতের চারা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা করে। এ হিসেবে প্রতি হাজার চারার গড়মূল্য ৫০০ টাকা। এতে চারা বিক্রি হবে ১০ কোটি টাকার।
এই তথ্য অনুসারে, এ বছর প্রতি হাজারে চারায় লোকসানের পরিমাণ ১৫০০ টাকা। ২০ কোটি চারায় ক্ষতির মূল্য দাঁড়ায় অন্তত ৩০ কোটি টাকা।
শাহনগরে উৎপাদিত চারা সাধারণত বাংলা মাসের আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। রংপুরের পঞ্চগড় থেকে বরিশাল, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, সাভারসহ দেশের ৪০টিরও বেশি জেলায় বগুড়ার চারা যায়। কিন্ত এবার শাহনগরে ক্রেতা নেই! বাজারমূল্যে ব্যাপক ধস। এত টাকা মূল্যের চারা ক্রেতার অভাবে নার্সারিতেই নষ্ট হচ্ছে।
ব্যবসায়ী ও কৃষি অফিস বলছে, এবার দেরিতে বন্যার কারণে নদীর চর এলাকায় এখনো চাষাবাদ শুরু হয়নি। আবার বর্ষা মৌসুমের পরে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে জমিও তৈরি হয়নি। বিগত বছরগুলোতে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আগাম শীতকালীন সবজি চারা নিতে দেশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতায় মুখরিত থাকত শাহনগর। কিন্তু এবার চিত্র উল্টো।
উপজেলার নার্সারি পল্লীর কয়েকটি গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, নার্সারি শ্রমিকেরা সবজি বীজতলায় চারা উৎপাদন, বিক্রি ও পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকেই অবিক্রিত নষ্ট চারা তুলে ফেলে নতুন করে বীজতলা তৈরি করছেন। বীজ বপনের ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যেই বীজতলা থেকে চারা তুলে নতুন জমিতে রোপন না করলে চারাগাছে ফুল ফুটে নষ্ট হয়ে যায়।
শাহনগরে আঁখি বীজ ভান্ডার নার্সারি, ভাই ভাই নার্সারি ও ফাহিন নার্সারি বাণিজ্যিকভাবে গ্রিনহাউস চারা উৎপাদন শুরু করেছে। গ্রিনহাউস ঘরে মাটির বদলে কোকোপিট (নারকেল ছোবড়া) প্লাস্টিকের ট্রেতে বসিয়ে চারা তৈরি করছে। এই পদ্ধতিতে রোগবালাইমুক্ত ও উচ্চ ফলনশীল চারা সারা বছর তৈরি করা সম্ভব বলে জানান ভাই ভাই নার্সারির স্বত্বাধিকারি ফেরদাউস জামান উজ্জল।
২৫০ নার্সারিতে উৎপাদিত চারার মধ্যে সিংহভাগই হাইব্রিড জাতের মরিচের চারা। এর মধ্যে আছে বিজলি, বিজলি প্লাস, গ্রিন সুপার, গ্রিন মাস্টার, লুবা, এন.এস-১৭০১ নানা জাতের চারা। এছাড়া পেঁপে, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটোর চারাও উৎপাদিত হয়েছে।
দুই বোন এক ভাই নার্সারির মালিক আবুজার রহমান জানান, এ বছর তিনি সাড়ে চার বিঘা জমিতে ২০ কেজি মরিচ বীজ বপন করেছেন। প্রতি কেজি মরিচ বীজ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায় কিনতে হয়। প্রায় ৮ লক্ষাধিক টাকা খরচ হলেও বিক্রি হয়েছে মাত্র ২ লাখ টাকার চারা। অন্য বীজগুলো বড় হয়ে যাওয়ায় সেগুলো জমিতেই নষ্ট করতে হয়েছে।
উপজেলার দুরুলিয়ার এলাকার তিন ভাই নার্সারির মালিক মোনতেজার রহমান জানান, এ বছর তিনি প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে শীতকালীন আগাম সবজির (যেমন, টমেটো, মরিচ, কপি) বীজ বপন করেন। ২ লক্ষ টাকা খরচ হয় চাষ করতে। কিন্তু সেখান থেকে বীজ বিক্রি করে মাত্র ৮০ হাজার টাকা পেয়েছেন। এ বছর প্রকারভেদে ২০০ থেকে ৬০০ টাকা হাজার দরে চারা বিক্রি করেছেন তিনি। অথচ গত বছর একই চারা তিনি বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা করে।
শাহনগরের দুলাল মিয়া উৎপাদিত মরিচের চারা বিক্রি করতে না পেরে জমিতেই নষ্ট করছেন। তিনি নতুন করে বীজতলায় তৈরি করছেন, আবার বীজ বপন করবেন বলে।
উপজেলার বড়পাথার গ্রামের লাল মিয়া বলেন, 'গত বছর আড়াই বিঘা জমিতে বীজ চারায় ২ লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। কিন্তু এবার লাভ তো দূরের কথা, শ্রমের মূল্যই ওঠেনি। প্রতি বছর এই সময়ে এলাকার ক্রেতাদের ব্যাপক সমাগম দেখা মেলে। এবার দূর-দুরান্তের কোনো ক্রেতা নেই। এমনকি এলাকার ক্রেতাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গত দুদিন ধরে চারা কিছুটা বিক্রি শুরু হয়েছে, সেটার পরিমাণও বেশি নয়।'
নার্সারি মালিক আব্দুল মমিন বলেন, 'এবার মাটিতে তৈরি চারার দাম কম। প্রতি চারা ২০ পয়সা দরেও বিক্রি হচ্ছে। সেখানে ট্রে পদ্ধতিতে একটি চারা উৎপাদেন খরচ হয়েছে ৬০ পয়সা করে। ট্রেতে চারা উৎপাদন স্বল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এবার ক্রেতা না থাকায় নার্সারি ব্যবসায়ীরা খরচের অর্ধেক টাকাও তুলতে পারছেন না।'
শাহনগর সবজি চারা নার্সারি মালিক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, 'করোনা মহামারির কারণে অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো সবজি চারা নার্সারি মালিকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। করোনার লকডাউন আর বৃষ্টিতে নার্সারিগুলোতে অনেক চারার বয়স বেড়ে গেছে। এই চারাগুলো বিক্রি করলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা নার্সারির বীজতলা থেকে চারা তুলে ফেলে দিচ্ছি। এতে আমাদের প্রায় এক থেকে কয়েক কোটি টাকা লোকসান হবে।'
সরকারিভাবে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে অভিমত তার।
এ প্রসঙ্গে শাজাহানপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম বলেন, 'শাহনগরসহ আশেপাশে গড়ে ওঠা নার্সারিগুলো দেশে সবজির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। জুলাই-আগস্ট মাসের বৈরি আবহাওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় সবজির জমি তৈরি করতে পারেননি কৃষকেরা। ফলে চারাও কিনতে হয়নি তাদের। কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো নার্সারি মালিকেরা আগাম সবজির চারা উৎপাদন করেছেন। সময়মতো এগুলো বিক্রি করতে না পেরে তারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।'
'তবে এখন আবার চারা বিক্রি শুরু হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ক্ষতি কিছুটা কমানো যাবে,' যোগ করেন তিনি।