সাম্প্রদায়িক সহিংসতা: জেলায় জেলায় মানববন্ধন, মামলা ও প্রতিবাদ সভা
গত ১৩ সেপ্টেম্বর (বুধবার) কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও হতাহতের প্রতিবাদে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নোয়াখালি, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এছাড়াও রাজধানীতে শুক্রবার জুমার নামাজের পর কিছু মুসল্লি ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়েরকৃত দুই মামলায় খেলাফত আন্দোলনের একাংশের আমির জাফরুল্লাহ খানসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা ও ভাঙচুরের অভিযোগ শনিবার ভোরে পল্টন ও রমনা থানায় এ দুটি মামলা দায়ের করা হয়।
এসব মামলায় ৪ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
সাতক্ষীরায় মানববন্ধন, দ্রুত বিচার আইনে মামলা নিষ্পত্তির দাবি
রোববার (১৭ অক্টোবর) সকাল ১০টায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন জেলা মন্দির সমিতির সভাপতি বিশ্বনাথ ঘোষ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, "যেভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মন্দির, প্রতিমা, হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন ও পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে তা কোন স্বাধীন দেশের সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না"।
তারা আরও বলেন, "২০১২ সালে ফতেপুর চাকদহের সহিংসতাসহ আশাশুনির প্রতাপনগর, দেবহাটার টিকেট, সদরের বাবুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ইতিপূর্বে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় দোষীরা শাস্তি না পাওয়ায় হামলাকারীরা আজও বেপরোয়া"।
মানববন্ধন থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা নিষ্পত্তি করার দাবি জানানো হয়।
মুন্সীগঞ্জে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার রাশুনিয়া ইউনিয়নে দনিয়াপাড়া মহা শোষণ কালী মন্দিরে ছয়টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা হয়েছে। মন্দিরের পুরোহিত বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন।
সিরাজদিখান থানার ওসি (তদন্ত) আজগর হোসেন জানান, মামলায় অজ্ঞাত আসামির নামে মামলা করা হয়েছে।
কুমিল্লায় আগামীকাল গণজমায়েত
কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগামীকাল (১৮ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় গণজমায়েত ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
গণজমায়েতে নেতৃত্ব দেবেন কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহার। গণজমায়েতে আওয়ামী লীগ ছাড়াও কুমিল্লার সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ এবং শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করবেন।
এদিকে কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে কুমিল্লা পূজা উদযাপন কমিটি; শনিবার তাদের উদ্যোগে নগরীর কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করা হয়েছে।
একই সময়ে সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগ-কুমিল্লার আয়োজনে দেশব্যাপী অশুভ শক্তির নারকীয় তাণ্ডবের প্রতিবাদে নগরীর কান্দিরপাড়ে পৃথক নাগরিক সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
শরীয়তপুরে রামঠাকুরের সমাধি মন্দিরে হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ
কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগের জেরে শুক্রবার নোয়াখালির চৌমুহনিতে শ্রীশ্রী রামঠাকুরের সমাধি মন্দিরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়।
ওই ঘটনার প্রতিবাদে ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শনিবার রাত ৮টার দিকে শরীয়তপুরের নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক গ্রামে রামঠাকুরের জন্মভিটায় প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মন্দিরের নির্বাহী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য রাজ রথীন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।
এতে শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণের সেবা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক মুকুল চন্দ্র রায় বলেন, "সম্প্রীতির বাংলাদেশে আমরা এ কেমন নৃশংসতা দেখলাম! ১৯৭১ সালেও শ্রীশ্রী রামঠাকুরের সমাধি মন্দিরে হামলা হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এমন বাংলাদেশ দেখে আমরা শঙ্কিত-আতঙ্কিত"।
বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদের শরীয়তপুরের সদস্য সচিব রূপক চক্রবর্তী বলেন, "আমরা নতুন প্রজন্ম। সম্প্রীতির বন্ধনে সকল মানুষ একত্রে থাকতে চাই। যে সকল দুষ্কৃতিকারীরা সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে সম্প্রীতিতে আঘাত হেনেছেন, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দাবি করছি"।
জানতে চাইলে নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবনি শংকর কর বলেন, "নড়িয়ার পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। এখানে আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক আছেন"।
সিলেটে বিক্ষোভ সমাবেশ, সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর আহবান
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে শনিবার বিকেলে সিলেটে সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন নামে একটি সংগঠন বিক্ষোভ করেছে।
এই বিক্ষোভ কর্মসূচীর ব্যানারে লেখা ছিল, 'দুর্গাপূজা উদযাপনকালে সংগঠিত ঘটনায় আমরা ব্যথিত, লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ'।
বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তাদের কথায়ও ফুটে ওঠে এই লজ্জা আর ক্ষোভ। সকলের কণ্ঠেই একই সুর, "মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই দেশ কোনো বিশেষ ধর্মের নয়। এই দেশে সবার সমান অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে"।
তাণ্ডবের সাথে জড়িত সকলকে চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতেরও দাবি জানান বক্তারা।
বিক্ষোভ সমাবেশের পর রিকাবীজার থেকে নগরের চৌহাট্টা এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত মিছিল করা হয়।
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম বলেন, "কোরআন শরীফ অবমাননার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা আমাকেও ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু এই ঘটনার জের ধরে সারাদেশে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর হামলা চালানো হয়েছে- তা এককথায় বর্বোরোচিত। কোনো সভ্য দেশে বিবেকবান মানুষ এ ধরণের ঘটনা ঘটাতে পারে না"।
এদিকে এই ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার বিকেলে সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিক্ষোভ করেছে জেলার পূজা উদযাপন পরিষদ।
সেখানে বক্তারা বলেন, "দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করে হত্যা ও ধর্ষণের মাধ্যমে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে। মন্দির ও বাসাবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। দেশের রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও জনগণ সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না, যা অত্যন্ত উদ্বেগের"।
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে আজ রোববার বিকেলে নগরে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
মাগুরাতে সন্ত্রাসী হামলার বিচার ও নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবিতে মানববন্ধন
রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় মাগুরা জেলার চৌরঙ্গী মোড়ে প্রেসক্লাবের সামনে কুমিল্লাসহ সারাদেশের পূজা মণ্ডপে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলার বিচার ও চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবিতে গণকমিটি, মাগুরা জেলার উদ্যোগে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন গণকমিটির আহ্বায়ক এটিএম মহব্বত আলী এবং সমাবেশ পরিচালনা করেন সদস্য সচিব প্রকৌশলী শম্পা বসু।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রসঙ্গে সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, "কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননা করার অভিযোগে পূজামণ্ডপে হামলা করা হয়েছে। এ ঘটনার জেরে চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে; হাতিয়ায় এবং বাঁশখালীসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে- যা পূর্বপরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত"।
নেতৃবৃন্দ কুমিল্লাসহ সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার-বিচারের দাবি জানান। একই সাথে ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও শাসকশ্রেণির সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ ও গণতন্ত্র-ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল-ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন।