সৌদি আরবও সমালোচনামূলক চিন্তাকে স্বাগত জানাচ্ছে!
মাহা মোহাম্মদ এত বেশি খুশি কখনও হননি আগে। বলছিলেন, এটা দারুণ সম্মানের। ঘটনাটা এই বছরেরই শুরুর দিকের। লুলু নামের সুপারমার্কেট চেইন জেদ্দায় একটি দোকান খুলল- যার স্টাফরা সবাই নারী। মাহা তার মহাব্যবস্থাপক। সৌদি আরবে এমন দোকান এটাই প্রথম।
তেল সম্পদ ভরা দেশটিতে অনেক কিছুই এখনো বহাল, যা পৃথিবীর অন্য দেশে বিরল। যেমন রেস্তোরাঁয় নারী ও পুরুষের ঢোকার দরজা আলাদা। আত্মীয় নয়- এমন কোনো পুরুষের সঙ্গে নারী কতক্ষণ সময় কাটাতে পারবে, তাও বেঁধে দেওয়া।
পুরুষসঙ্গী বাদে নারীর বিদেশ যাওয়া ও অবস্থান করা ছিল নিষেধ। ২০১৭ সালে মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর থেকে দেশটিতে নতুন বাতাস বইতে থাকল। তবে সে বাতাস কতটা বিষমুক্ত তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন অনেকে। বিশেষত জামাল খাশোগি হত্যার ঘটনায় পূর্ব-পশ্চিমের প্রায় সবাই ভ্রু কুচকেছেন। জামালের বাগদত্তা তো প্রিন্সের দিকেই তীর ছুঁড়ে রেখেছেন।
যাহোক, সালমানের ভিশন-২০৩০ ভালোই নজর কাড়ছে। প্রশংসা পাচ্ছে বলা যাচ্ছে না অবশ্য এখনই। ওই ভিশনের আওতায় যেসব অর্থনৈতিক পরিকল্পণা আছে, তার বাস্তবায়ন সামাজিক সংস্কার ছাড়া করা সম্ভব নয়।
তাই শেষ পর্যন্ত তার সব ইচ্ছা সদিচ্ছায় গিয়ে দাঁড়ায় কি না- তা দেখতেই নজর রাখছেন নানান মহল। তার সামাজিক কর্মসূচীতে নারী পেয়েছে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া একা একা বিদেশ ভ্রমণের ও অবস্থান করার সুযোগ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সালমান চাইছেন আধুনিক এক মধ্যপ্রাচ্য। চাইছেন পুরোনো সংস্কার ও চরমপন্থা থেকে সৌদি আরবকে বের করে আনতে। তিনি ইসলামকে মধ্যমপন্থী করে তুলতে চাইছেন, মানে রক্ষণশীল সব শরীয়া আইনকে তিনি আধুনিক, কমপক্ষে সহনশীল করতে চাইছেন।
২০১৮ সালে বিশ্ব দেখল, সৌদি নারী গাড়ি চালাচ্ছেন। তার পর পরই মক্কায় পুরুষ অভিভাবক ছাড়া একা একাই হজ করতে দেখা গেল নারীদের। এ প্রেক্ষিতে ভয়েস অব আমেরিকাকে এক নারী বলেছিল, অত্যাশ্চর্য ব্যাপার বৈকি! এরপরও কিন্তু সৌদি নারী কি করতে পারে, আর পারে না- দুয়েরই তালিকাই দীর্ঘ।
তাই মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয়-সৌদি সংস্থার গবেষক দুয়া ধাইনি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, 'ঢাক-ঢোলই বাজছে বেশি। ওখানকার (সৌদি আরবের) মানবাধিকার পরিস্থিতি উল্লেখ করার মতো ভালো বলার সময় এখনো আসেনি। যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ সামনে আনেন, দেখবেন পরিবর্তন কিছু এসেছে; কিন্তু তা পার্থক্য গড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। গেল কয় বছরের মধ্যেই কয়েকজন নারী অধিকার কর্মীকে আমরা জেলবন্দি হতে দেখেছি, এমনকি ছাড়া পাওয়ার পরও তাদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।'
নিউ ইয়র্ক টাইমসের কায়রো ব্যুরো প্রধান ভিভিয়ান ইয়ি বলছেন, 'অনেক বাড়িতেই এখনো নারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ অভিভাবকের পরামর্শ মেনে নিতে বাধ্য থাকে।'
তবে পরিবর্তনের একটা হাওয়া বইছে সত্যি। আমাদের নিজেদের মানে বাংলাদশের কথা মনে হলে, এগুলো অনেক আশার কথা। আমাদের কথা বলা কি অনেক সংকুচিত হয়ে আসছে না! অথচ এতদিন সৌদি আরবই পরিচিত ছিল কট্টর ইসলামী মতাদর্শ মুসলিম দেশগুলোয় প্রচারকারী হিসেবে।
পোশাক সংস্কার:
সৌদি আরবের নারীরা ঢিলাঢালা পোশাক পরতে বাধ্য ছিলেন। এই ঢোলা পোশাকের একটা নামও আছে, আবায়া। এ পোশাক ঢোলা তো বটেই লম্বাও হয়ে থাকে। আর এর সঙ্গে মাথায় কালো ওড়না বা নেকাবও পরতে হবে। শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকে এরকম পোশাক এখনো সৌদিতে বলতে গেলে নিষিদ্ধ। সাধারণ্যে খারাপ বলে গণ্য হয় ভারি মেকআপও। তবে সালমান আমলে পোশাকের বিধি-নিষেধ কিছুটা শিথিল হয়েছে। জনসমক্ষে আবায়া পরার আর বাধ্যবাধকতা এখন আর নেই। রক্ষণশীল আরবরা অবশ্য ব্যাপারটিকে ভালো চোখে দেখছেন না। তারা আবায়ার বিকল্প হিসাবে আলখাল্লা আর কিমোনোকে পরীক্ষা করে দেখছেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানাচ্ছে, বর্তমান শাসক ধর্মীয় পুলিশ বাহিনীর গ্রেপ্তারের ক্ষমতা বাতিল করে, পোশাক সংস্কারকে কার্যকর করার পথ প্রশস্ত করেছেন।
পুরুষ সঙ্গীর ব্যাপারে:
সৌদি আরবকে পৃথিবীর অন্যতম একটি লিঙ্গ-বৈষম্যের দেশও ধরা হয়। অল্পকাল আগেও অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে একজন সৌদি নারী কতটা সময় কাটাতে পারে সে ব্যাপারে পরিস্কার নির্দেশনা ছিল। নিয়মবর্হিভুত মেলামেশায় নারী-পুরুষ উভয়েই দণ্ডপ্রাপ্ত হতেন। তবে নারীই পুরুষের তুলনায় হয়রানি হতেন বেশি। এখানেও পরিবর্তন এসেছে, ডিসেম্বর ২০১৯ সাল থেকে রেস্তোরাঁয় নারী-পুরুষের পৃথক প্রবেশপথ তুলে দেওয়া হয়েছে। মেয়েরা এখন রেস্টুরেন্টে যেতে পারছেন। তারা কনসার্টে যেতে পারছেন। তারা খেলাধূলাতেও অংশ নিতে পারবেন- যা এতদিন নিষেধাজ্ঞায় আটকা ছিল।
পারিবারিক জীবনে:
সৌদি আরবে কোনো পারিবারিক আইন নেই। তাই বিবাহ ও তালাকের মতো বিষয় শরীয়া আইন দিয়েই পরিচালিত হয়। নারীকে সেখানে বিবাহ ও তালাকের জন্য পুরুষ অভিভাবকের মতামতের ওপরই নির্ভর করতে হয়।
আর পুরুষের চেয়ে নারীর ক্ষেত্রে এগুলোর প্রক্রিয়াও জটিল। ২০১৯ সাল অবধি তালাকের ব্যাপারে নারীর মতামত নেওয়ার বিষয়ে আরবরা উদাসীন থাকতে পারত, যার মানে দাঁড়াচ্ছে স্ত্রীর ভরণপোষণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকেও মুক্ত ছিল পুরুষরা। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভিভিয়ান জানাচ্ছেন, ক্রাউন প্রিন্স সামাজিক সংস্কারের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; কিন্তু এর পাশাপাশি রক্ষণশীল ও উদার পরিবারগুলোর দূরত্বও কিন্তু বাড়ছে। গত দুই বছরে আমরা বেশ কিছু সংস্কার দেখেছি, তবে আরও বাধা আছে।
সাউদি আরাবিয়ান গ্রাঁ পি:
রাজপুত্রের কাছে আরও চমক ছিল! ফর্মুলা ওয়ানও! ডিসেম্বরের শুরুটা তো তা-ই দেখাল। সৌদি আয়োজনে প্রথমবারের মতো ৫ ডিসেম্বর দেশটিতে চলেছে গাড়িরেসের নামজাদা প্রতিযোগিতা ফর্মুলা ওয়ান।
এর আগে প্রস্তুতি হিসাবে ২০১৯ সালে রিয়াদের কিদায়া বিনোদন কেন্দ্রে একটি স্থায়ী মোটরস্পোর্টস কমপ্লেক্সও তৈরি হয়। সাবেক ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার আলেকজান্ডার উরসকে দিয়ে প্রকল্প পরিকল্পনা যাচাইবাছাই করা হয়েছিল। তারপর গেল বছরের জানুয়ারিতে কিদিয়ার একটি রেস ট্র্যাক আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হয়। অক্টোবরে হয় ফর্মুলা ওয়ান কমিশনের সভা। নভেম্বরেই জেদ্দাকে প্রতিযোগিতাস্থল ঘোষণা করা হয়। জেদ্দার ট্র্যাকটি ইতিমধ্যেই ফাস্টেস্ট স্ট্রিট ট্র্যাকের তকমা পেয়ে গেছে। এতে রেসাররা গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটারের বেশি তুলতে পেরেছেন। আর এটি ফর্মুলা ওয়ান তালিকার দ্বিতীয় দীর্ঘ ট্র্যাকও বটে। লোহিত সাগরের ধারে এ ট্র্যাক।
তবে ফর্মুলা ওয়ান আলোচনায় অন্য কারণে বিশেষত সৌদি আরবে মদ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। আর ফরমুলা ওয়ানের ঐতিহ্য হল, ইভেন্টগুলোয় রেস শেষ হওয়ার পর শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ছুটিয়ে উদযাপন। এটা ফর্মুলা ওয়ানে বহু বছর ধরে চলে আসছে। সৌদি আরবে এই প্রথা কিভাবে উদযাপন হবে তীব্র সংশয় ছিল। কিন্তু সৌদি কতৃর্পক্ষ এখানেও কঠোর আইনে পরিবর্তন এনেছে: শ্যাম্পেনের বদলে এবার উদযাপন স্পার্কলিং ওয়াইন দিয়ে। ওয়াইনের ফোয়ারা ছোটাতে বুঝি বাধা নেই!
দর্শন সম্মেলন:
সস্প্রতি, অল্প কয়েকদিন আগে সৌদি আরবে একটি আন্তর্জাতিক দর্শন সম্মেলন হয়েছে। যার উদ্দেশ্য ছিল সমালোচনামূলক চিন্তা চর্চাকে উৎসাহিত করা। ভিন্নমত প্রকাশ দমনের জন্য সৌদি আরবের কুখ্যাতি অনেকদিনের। সেই সমাজে এ ধরনের একটি আয়োজন বৈপ্লবিক বটে!
তিনদিন ধরে রিয়াদে হয়েছে এ সম্মেলন। আমেরিকান রাজনৈতিক দার্শনিক মাইকেল স্যান্ডলও এতে কথা বলেছেন। তিনি বস্তুত ভাষণ দেওয়ার চেয়ে সৌদি নাগরিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উৎসাহী ছিলেন বেশি এবং তিনি মন খুলে খুন ও খুনীর গল্পও (জামাল খাশোগি হত্যাকান্ড স্মর্তব্য) করতে পেরেছেন। এখন নিজেকে যদি প্রশ্ন করি, আমাদের এখানে এসে কোনো বিদেশি পণ্ডিত কি গুম-খুন, মুক্ত গণমাধ্যম এসব নিয়ে কথা বলতে পারবেন?
সৌদিতে সিনেমা হল খুলে দেওয়া হয়েছে। হয়েছে কনসার্ট। ২০১৮ সালেই নারী-পুরুষ একসঙ্গে কনসার্ট উপভোগ করে। নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরেই আর ২০১৮ সালের জুন থেকে নারীদের গাড়ি চালানোর লাইসেন্সও দেওয়া হয়েছে। এখন আর সৌদি নারীদের স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার নিষেধাজ্ঞাও নেই।
কট্টর অনুশাসনের নিগড়ে বাধা একটি দেশ, একটি মুসলিম দেশ (নিঃসন্দেহে সালমানের অনেক কিছু প্রশ্নের মুখে, কিন্তু একটি কঠোর অনুশাসনের দেশ হিসেবে চিন্তা করুন সৌদি আরবকে), যে অবগুন্ঠন খুলে মুক্ত বাতাস দিতে চাইছে তাদের নাগরিকদের। বিপরীতে সৌদি আরব থেকে উদারতায়, সহিষ্ণুতায় আমরা যোজন যোজন এগিয়ে; তারপরও কেন তাদের এই সমালোচনা গ্রহণ করার উদ্যোগ দেখে আমরা নিজের দিকে তাকাই না?
- লেখক: গণমাধ্যম কর্মী