ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যানের কাজ শুরু করতেই তিন দশক পার
- দেশের কোন জমি, কি কাজে ব্যবহার হবে তা থাকবে এ পরিকল্পনায়
- দেশের সব মহাপরিকল্পনা এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে
- ১৯৯০ সালের জুনে মন্ত্রিপষদ এই ধরণের পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়
- নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে ২০১২ সালে
- ২০১৬ সালে ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান প্রণয়নের দায়িত্ব নেয়, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ
- জিইডির প্রথম সভা হয় ২০১৬ সালের আগস্টে
- সভায় ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়
- ২০১৭ সালের এপ্রিলে ওই কমিটির একমাত্র সভা হয়
পরিকল্পিত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিন দশক আগে উদ্যোগ নিয়েও ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করতে পারেনি সরকার। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও আন্তরিকতার অভাব, জনবল সংকট, এবং অর্থায়ন জটিলতা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
১৯৯০ সালের উদ্যোগ নেওয়ার দুই দশক পর ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান প্রণয়নে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর (ইউডিডি)। ২০১৬ সালে এক সভায় পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগকে এই পরিকল্পনা প্রণয়নে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। তবে নিজেদের আগ্রহে এই দায়িত্ব নেয় পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এর পর একটি সভা ও একটি আন্তমন্ত্রণয় কমিটি গঠন করেই, ২০১৭ সালে ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান প্রণয়নের কাজ থেমে যায়।
জিইডিকে বারবার নাগাদা দেওয়ার হলেও তাদের কাছ কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি বলে জানান পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের কর্মকর্তারা।
তবে আশার কথা পুনরায় ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে গৃহয়ান ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গত ১৩ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব এমডি শহীদ উল্লাহ খন্দকারের সভাপতিত্বে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভাও অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বা সাধারণ অর্থনীতি বিভাগকে নতুন করে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করা হয়।
জিইডির তৎকালীন সদস্য ও বর্তমান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, "জার্মান সরকারের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জিআইজে-এর এই প্রকল্পে অর্থায়ন করার কথা ছিল। কিন্ত একটা পর্যায়ে তারা পিছিয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রমও থেমে যায়।"
তিনি আরও বলেন, "সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ জনবলের অভাবে এ কাজ জিইডির পক্ষে বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এ কাজে সমন্বয়ের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত।"
অন্যদিকে জিইডির গঠিত আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির সদস্য সচিব (জিইডির তৎকালিন কর্মকর্তা) স্থপতি ড. মোঃ তায়বুর রহমান বলেন, "এই পরিকল্পনা প্রণয়নের যে পরিমান জনবল থাকার দরকার, তা জিইডিতে নেই। আর এ কারণেই ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান প্রয়ণের কার্যক্রম আর এগোয়নি।"
৬ষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান পরিকলল্পনা প্রণয়নের কথা বলা হয়। এ কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে পরিকল্পিত শিল্পায়ন, আধুনিক নগরায়ন, সমুদ্র-বন্দর, রেলও সড়ক অবকাঠামোসহ সারা দেশ ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহারই এই প্ল্যান প্রণয়নের প্রধান লক্ষ্য।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, পরিকল্পিত ভাবে ভূমি ব্যবহার করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে, আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে ও পরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
সরকারের আমার গ্রাম আমার শহর পরিকল্পনা, রেলের মহাপরিকল্পনা, সরকার ঘোষিত ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল, এক্সেপ্রেসওয়ে প্ল্যান, নগর উন্নয়নসহ সরকারের সব পরিকলল্পনাই এই ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান এ অন্তর্ভূক্ত হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি ড. আকতার মাহমুদ বলেন, "জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের আয়তন খুবই কম। এ কারণে দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি খুবই মূল্যবান। এ অবস্থায় দেশের প্রতি খন্ড জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হওয়া উচিত। জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হলে আমাদের প্রকৃতির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। প্রতিবছর বাংলাদেশের ১ শতাংশ চাষ যোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। জমির এ রুপান্তর ঠেকানো প্রয়োজন। এছাড়া প্রকৃতি এবং পরিবেশকে সংরক্ষণ করা দরকার। এসব কারণে ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
তিনি আরও বলেন, "পল্লী এলাকায় বা নগরের কত কম জমি ব্যবহার করে বেশি মানুষ বাস করতে পারবে তা এ প্ল্যানে থাকবে । অন্যদিকে ভূমি কনভারশন ঠেকানো হবে। আবার আমাদের নদী, খাল, হাওর , বিলসহ সব ধরণের জলাশয় এবং পাহাড় রক্ষায় নানা ধরণের পদক্ষেপ থাকবে। এ প্ল্যান করা গেলে, কোন জমি কি কাজে ব্যবহার হবে সেটা সুর্নিদিষ্ট করা থাকবে। এক্ষেত্রে একটা আইনও করতে হবে। এধরণের আইন ভারতসহ প্রতিবেশি দেশগুলোও রয়েছে।"
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক ড. খুরশীদ জাবিন হোসেন তৌফিক বলেন, "এই পরিকল্পনা হচ্ছে পরিকল্পিত বাংলাদেশ নির্মাণের পরিকল্পনা। বিশাল এই পরিকল্পনা প্রণয়নের মূল দায়িত্ব নগর পরিকল্পনাবিদদের। এ কারণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরকে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে নগদ উন্নয়ন অধিদপ্তরে লোকবলের সংকট রয়েছে। আবার এ কাজে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে যুক্ত করতে হবে। এ কারণে মূল কাজ নগর পরিকল্পনা অধিদপ্তর করলেও এ কাজে সমন্বয়ের দায়িত্বে পরিকল্পনা কমিশনের ওপর থাকা উচিত।"
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কৃষি জমি থেকে যত্রতত্র শিল্প স্থাপন বন্ধ করে ১৯৯০ সালে দেশব্যাপী জরিপ করার নির্দেশ দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পূর্ত মন্ত্রণালয়, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় এই সমীক্ষা পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়। জরিপের মাধ্যমে নির্ধারিত এলাকা ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় শিল্প স্থাপনের বিধি-নিষেধ আরোপের করার কথাও বলে মন্ত্রিপরিষদ।
এর পর বিষয়টি আরো বড় পরিসরে নিয়ে দেশের সব অবকাঠামোকে এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় নগর পরিকল্পনা অধিদপ্তর। সংস্থাটি ২০১৩ সালে 'কমপ্রিহেন্সিভ ডেভেডমেন্ট প্ল্যান ফর বাংলাদেশ' শিরোনামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে এবং তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। কিন্ত এই প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের যাচাই-বাছাই করতে আরো তিন বছর সময় চলে যায়।
২০১৪ সালের প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর পরিকল্পনা কমিশনের অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় (পিএসসি) প্রকল্পের শিরোনাম পরিবর্তন করে 'জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো সমন্বয় করে সমগ্র দেশব্যাপী ভূমির ব্যবহার পরিকল্পনা' নামকরণ করা হয়। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নগর অধিদপ্তরের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
২০১৬ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় পিএসসি সভায় ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান এ প্রণয়নের দায়িত্ব নেয় জিইডি। ওই বছরের মে মাসে প্রস্তাবিত পরিকল্পনা প্রণয়নে একটি সভা করে জিইডি। ওই সভায় ৬ সদস্যের একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির প্রথম একমাত্র সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে। কমিটির প্রথম সভায় প্রস্তাবিত সমীক্ষা প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জনের বিষয় পরবর্তী সভায় মতামত উপস্থাপন করতে কমিটির সদস্যাদের বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কমিটির আর কোনো সভা হয়নি।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯০ সালের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চেয়েছে মন্ত্রি পরিষদে বিভাগ। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি কাজও শুরু করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর মন্ত্রি পরিষদ থেকে ন্যাশনাল ফিজিকাল প্ল্যান প্রণয়নে আরো গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।