বৈদ্যুতিক গাড়িই কি দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশ দূষণ সমস্যার সমাধান দেবে?
বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে আজকাল। বলা হচ্ছে, পরিবেশ দূষণ কমাতে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে ইভি। বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই ইভির ব্যবহার বাড়াতে উৎসাহিত করা হচ্ছে সবাইকে।
স্থানীয়ভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের আশায় ভারত গত বছর টেসলাকে বিনামূল্যে হাজার একর জমি, কর্পোরেট করে রেয়াত এবং চীনের চেয়ে সস্তা উৎপাদন খরচের প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে ভারতে বিনিয়োগ করবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত করেনি টেসলা।
ভারতের মতোই বেসরকারি ইভি শিল্পের বিকাশ ঘটানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানও। বাংলাদেশ সরকার বৈদ্যুতিক গাড়িবান্ধব নীতিমালাও নিচ্ছে। নিচ্ছে দেশে গাড়ি উৎপাদনের প্রচেষ্টাও।
তবে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, এসব দেশের সরকারের এই উৎসাহের পেছনে মূল কারণটা আর্থিক লাভ। পরিবেশগত উপকারিতার দিকটা এসব দেশের সরকারের কাছে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি বলেই মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আরবান মোবিলিটি বিশেষজ্ঞ শ্রেয়া গাডেপাল্লি বলেন, 'সাধারণত এক যাত্রী নিয়ে চলা কারের চেয়ে বাস দশগুণ বেশি দক্ষ। [কিন্তু] বাসের চেয়ে কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি।
'সরকারগুলোর ধারণা, গাড়ি উৎপাদন অর্থনীতির জন্য ভালো। এসব গাড়ির ক্ষতিকর প্রভাব তারা বুঝতে পারছে না।'
গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেলে—তা যদি বৈদ্যুতিকও হয়—তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সড়কে যানজট ও দুর্ঘটনা বেড়ে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখন এ দুটি সমস্যাই অত্যন্ত তীব্র।
ভারতে প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি (কার) আছে ২২টি করে। নেপালে প্রতি ১ হাজার নাগরিকের বিপরীতে গাড়ির সংখ্যা ১০টির কম, আর মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৬৬টি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৯৮০ ও ৮৫০।
এদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় দূষণের অন্যতম উৎস হলো গণপরিবহন। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর বায়ুদূষণের ৬০ শতাংশই হয় যানবাহনের কারণে। এই ৬০ শতাংশ দূষণের সিংহভাগের জন্যই গণপরিবহন দায়ী।
ঢাকার ৮৪ শতাংশ ডিজেলচালিত বাসই জাতীয় নিঃসরণ মানদণ্ড পূরণ করতে পারে না। বাংলাদেশ ও নেপাল উভয় দেশের সরকারই বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৈদ্যুতিক গাড়িকে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বিবেচনা করছে। কিন্তু ছোট পরিসরের কিছু পাইলট প্রকল্প ছাড়া কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত গণপরিবহনকে বৈদ্যুতায়নের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিতে পারেনি।
যেসব প্রাইভেট কারের মালিক ইভিতে স্থানান্তরিত হতে চান, তাদেরকে কর প্রণোদনাও দিচ্ছে নেপাল, পাকিস্তান। নেপাল সরকার সম্প্রতি ইভিতে ২৫ থেকে ৮০ শতাংশ কর কমিয়েছে। কিন্তু কাঠমান্ডুতে ডিজেলচালিত বাসের চেয়ে বৈদ্যুতিক বাসের মূল্য এখনও অনেক বেশি।
অন্যদিকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ লাখ বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল ও রিকশা এবং ১ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ি, ভ্যান ও ছোট ট্রাক সড়কে নামানোর লক্ষ্য নিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু দেশটির পরিকল্পনায় বৈদ্যুতিক বাস নেই।
এর একটা কারণ হতে পারে, পাকিস্তানে মোটরসাইকেলের বাজার অনেক বড়। মোটরসাইকেল আমদানি ও বিক্রির ওপর বিশাল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাই গণপরিবহনকে বিদ্যুতায়নের আওতায় আনার পদক্ষেপ নিলে মোটরসাইকেলের ব্যবসা হুমকিতে পড়ে যেতে পারে।
পাকিস্তানভিত্তিক গাড়ি রিভিউয়ার হারুন রশিদ বলেন, 'পাকিস্তানে আমি বৈদ্যুতিক বাহনের দিকে যাত্রার আন্তরিক কোনো উদ্যোগ দেখছি না।'
তিনি বলেন, সবার যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত না করে ব্যক্তিগত বৈদ্যুতিক গাড়ি বাড়ানোর ফল ভালো হবে না।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণপরিবহনে বৈদ্যুতিক গাড়ি/বাস যুক্ত করার পথে বড় একটা বাধা হলো বাস কার্টেল সিস্টেম।
উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে গণপরিবহনের বাস চালানোর ব্যবস্থা বেশ জটিল। এই জটিল ব্যবস্থার কারণে বৈদ্যুতিক বাসের দিকে এগোনো দুরূহ বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিন হাসান।
তিনি বলেন, 'রুট পারমিট সিস্টেমের আওতায় সরকার কার্টেলদের রুট পারমিট দেয়। কার্টেলগুলো এরপর ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের কাছে রুট পারমিট বিক্রি করে দেয়। অর্থাৎ তারা বাস থেকে প্রতিটা পয়সা লাভ বের করে নিতে চায়, কিন্তু খুব বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। এ কারণে অধিকাংশ বাসের অবস্থা বেহাল এবং [এই বাসগুলো] বাংলাদেশের শহর-নগরে প্রচুর দূষণের সৃষ্টি করে।'
নেপালের শহরগুলোরও একই দশা। নেপালের গণপরিবহনও কার্টেল সিস্টেমে চালানো হয়। এই কার্টেলগুলোর কাছে পরিবেশের চেয়ে লাভটাই মুখ্য।
কর্মকর্তারা বলছেন, দূষণ কমানোর জন্য ব্যক্তিগত বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর কর কমানো হচ্ছে। কিন্তু সরকারগুলো গণপরিবহনকে বিদ্যুৎচালিত করার জন্য কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
এসব দেশের সরকার ইভির পরিবেশগত সুফল বেসরকারি বাসচালকদের জানানোর জন্য বলতে গেলে কিছুই করেনি। এ কারণে বেসরকারি বাস অপারেটরগুলো নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারছে না কিংবা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে দ্বিধা করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত নিজস্ব পরিবহন কোম্পানি চালু করে বৈদ্যুতিক বাস আমদানি করা। তাহলেই কেবল বৈদ্যুতিক যানবাহনের পরিবেশগত সুফল ঘরে তোলা যাবে।
- সূত্র: রেস্টঅভদ্যওয়ার্ল্ড