ধোলাইখালের নায়ক: কারিগর থেকে কোটিপতি
কী লাভ হবে লিখে? বাদল ভাই জানতে চাইলেন।
বললাম, আপনার বেশি কিছু লাভ হবে না তবে যারা নতুন প্রজন্ম তারা লাভবান হতে পারে। মানে আপনার ইতিহাস জেনে তারা অনুপ্রাণিত হতে পারে।
তিনি বললেন, বসেন।
বসার জায়গা বলতে দুটি টুল। সারা ঘরে সাতজন লোক কাজ করছে। দুইজন তার মধ্যে ওয়েল্ডিং মেশিন (ঝালাই দিয়ে জোড়া লাগানোর যন্ত্র) চালাচ্ছে। অন্যরা লেদমেশিন (কুঁদকল) ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেদের প্রয়োজনমাফিক কাটিং বা ড্রিলিং করছে। লোকগুলোর একজন বাদল ভাইয়ের ছোট ছেলে। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছেন। পড়ার ফাঁকে বাবাকে সাহায্য করেন। বসার টুলগুলোও খালি ছিল না। একজন উঠে জায়গা দিলে আমি লজ্জায় পড়লাম। বললাম, আপনারা কাজ শেষ করুন, আমি পরে বসছি।
বাদল ভাই বললেন, এমন করলে সারাদিনেও বসার জায়গা পাবেন না।
এর মধ্যেই পোশাক পরা দুই সেনা সদস্য এলেন। পরে জেনেছিলাম তারা মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় কোনো নির্মাণকাজে যুক্ত আছেন। কোনো মেশিন সারাই করতে এসে থাকবেন। এর মধ্যে একজন স্যাম্পল (নমুনা) নিতে এলো, আরেকজন কয়েকটি ৫০০ টাকার নোট বাদল ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, পুরায়া দিলাম ভাই, কাইল কিছু কম ছিল।
ঘরের চেহারা
পুরো ঘর ভরা লোহা-লক্কর। ঘরের দেয়ালের রং কালচে। ফ্যান আছে দুটি। বাতি জ্বলছিল তিনটি। বাতির সুইচগুলো পুরোনো আমলের। তিনটি লেদ মেশিনের একটি ইংল্যান্ডের, অন্যটি জাপানের, আরেকটি বাদল ভাইরা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছেন। সবগুলো মেশিনে একই রকম কাজ করা যায় না। বাদল ভাইয়ের ভাষায়, কোনোটা নরম্যাল কাজ করে কোনোটা হাই। এমন আরো দুইটি ওয়ার্কশপ আছে বাদল ভাইয়ের। ধোলাইখালের মুখে কলতাবাজার মাদ্রাসার নিচে।
বাদল ভাইয়ের পুরো নাম কাজী মোহাম্মদ বাদল। বাড়ি ধামরাইয়ে। তারা ৫ ভাই ১ বোন। তিনিই সবার বড়। ১৯৭৩ সালে বাদল ভাই ধোলাইখাল আসেন। তখন তার বয়স ১৩।
এবার ধোলাইখালের কিছু কথা
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, পুরানো ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিতি একটি বাণিজ্যিক-আবাসিক এলাকা ধোলাইখাল। আগের ধোলাইখাল থেকেই এ নামকরণ। আগে খালটি ছিল শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লালবাগ দুর্গ, আহসান মঞ্জিল ও বড় কাটরা, ছোট কাটরাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে ওঠে এর চারপাশে। অনেক বড় ব্যবসায়ী, নবাব পরিবার ও শহরের অভিজাত ব্যক্তিরা এ এলাকায় বসতি নিয়েছিলেন।
ঢাকার প্রথম মুঘল সুবাদার ইসলাম খান ১৬০৮ থেকে ১৬১০ সালে এ খাল খনন করেন। উদ্দেশ্য ছিল শহর সুরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ সুবিধা। ফরাশগঞ্জ ও গেন্ডারিয়াকে বিভক্ত করেছিল এ খাল। বালু নদী থেকে শুরু হয়ে খালটি দুটি শাখায় প্রবাহিত হতো। একটি উত্তর দিকে, অন্যটি এখনকার শাহবাগ থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে ডানে শহরের মধ্য দিয়ে তেজগাঁও এলাকা অতিক্রম করে। শাহবাগ ও কারওয়ান বাজারের মধ্যে সংযোগ ঘটাতে এর ওপর আম্বার সেতু তৈরি হয়েছিল।
তারপর ১৮৩২ সালে ওয়াল্টার নামের ঢাকার এক কালেক্টর খালটির ওপর একক স্প্যানের একটি ঝুলন্ত সেতু তৈরি করান। উদ্দেশ্য ছিল নারায়ণগঞ্জ যাওয়া সহজ করা। ১৮৬৭ সালে খালে চলাচলকারী যানবাহনের ওপর টোল আরোপ করা হয়। ১৮৬৭ থেকে ১৮৭২ মেয়াদে খালের মধ্য দিয়ে শহরে প্রবেশকারী বড় দেশি নৌকা ও অন্যান্য যানবাহনের কাছ থেকে বার্ষিক গড়ে ১৩ হাজার টাকা টোল আদায় করা হয়। সময়ের বিবর্তনে ময়লা আবর্জনা দিয়ে খালটি স্থানে স্থানে ভরাট হয়ে যায়। খালটি একসময় সাঁতার ও নৌকাবাইচের আদর্শ জায়গা ছিল। খালের দুই ধারে মেলাও বসত।
এখন এটি একটি ব্যস্ত ব্যবসায়িক কেন্দ্র। পাঁচ হাজারেরও বেশি দোকান আছে ধোলাইখালে। গৃহে ব্যবহারের সরঞ্জাম, যন্ত্রাংশ মেরামত ও তৈরির ছোট কারখানা আছে এখানে। এমনই তিনটি কারখানার মালিক আমাদের এই বাদল ভাই।
আলাপ হলো শুরু..
বললাম, তাহলে শুরু করি বাদল ভাই?
এর মধ্যে বাদল ভাইয়ের ছেলেটি বলল, এক হাজার টাকা দিন। বিজয়নগরে খুঁজব, না পেলে ঠাটারী বাজার থেকে করিয়ে আনব। বাদল ভাই টাকা দিয়ে বললেন, এখনো শুরু করেন নাই?
বললাম, 'না রেকর্ডার অন করি নাই।' তারপর প্রস্তাব করলাম, ভাই ধারে কাছে কোনো নীরব জায়গায় বসলে সুবিধা হতো।
বাদল ভাই: এখানে কোনো নীরব জায়গা নাই। এর মধ্যেই যেটুকু হয়, মানতে হবে।
সম্মতি দিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি ঢাকায় কেন আসলেন?
বাদল ভাই: বাবা তামা-কাঁসার ব্যবসা করতেন। কিন্তু একাত্তরে ব্যবসা পুরা বইসা গেল। আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। অটো প্রমোশন পেয়ে ফাইভে উঠে গেছি। বাবা আর লেখাপড়া টানতে পারছিলেন না। বোনগুলো সব আমার ছোট। আমার এক খালা থাকতো এখানে মানে ধোলাইখালে। তার মারফত প্রথম ঢাকায় আসি। এসে একটা মিষ্টির দোকানে কাজ নেই। তিনমাস থাকি। কিন্তু দোকান মালিকের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ধামরাই ফিরে যাই। খালা পরে আবার ধরে নিয়ে আসে। একটা ওয়ার্কশপে কাজ পাই। প্রথম প্রথম সাধারণ কাজ করতাম। মোটরগাড়ির পার্টস রিপেয়ারিং।
থাকতেন কোথায়, খেতেন কোথায়?
বাদল ভাই: খালার বাসাতেই থাকা-খাওয়া।
বলতে বলতে কান্না করে ফেললেন বাদল ভাই। কিছু সময় বিরতি নিয়ে বললেন, ছিঁড়া গেঞ্জি পইরা ঘুরছি। সেই আমি এখন গাড়ির মালিক। প্রথম ওয়ার্কশপটার নাম ছিল মুন। মাসে পেতাম ৭০-৮০ টাকা। আমার প্রথম ওস্তাদের নাম নূরুল ইসলাম। ৭-৮ বছর কাজ করছি তার সঙ্গে। তবে মাঝখানে ঊনআশি সালে ডাক পেয়েছিলাম মুন্নু সিরামিকসে। ওয়ার্কশপে বেতন বেড়ে তখন ৩০০ টাকা। কিন্তু মুন্নু সাহেব আমার কাজ দেখে খুশি। তিনি বেতন ধরলেন ৩০০০টাকা। আমি অবশ্য তিন সপ্তাহের বেশি থাকিনি। কারণ সেখানে কাজ ছিল সহজ। আমার কাছে কর্মর মূল্যই বেশি, টাকার চেয়ে। আমার ছেলের গল্প বলি। বড় ছেলেটা ডাক্তার হয়েছে। আমাকে এসে বলল একদিন, এক ক্লিনিক থেকে ডাক পেয়েছি। ভালোই সুযোগ-সুবিধা তবে তারা প্রতিদিন ৮-১০টা টেস্ট লিখে দেওয়ার শর্ত দিয়েছে। আমি স্ট্রেইট বললাম, যেও না বাবা। তোমার কাজ মানুষের সেবা করা, মানুষকে বিপদে ফেলানোর জন্য তোমারে ডাক্তার বানাই নাই।
ছেলে শুনল আপনার কথা?
বাদল ভাই: শুনবে না কেন? আমি কখনো অসততা করি নাই। মিথ্যা বলি নাই। আমার এখানকার কর্মীরা মিথ্যা বলে না। কাজে ফাঁকি দেয় না। আমি নিজে তো কোনোদিন ফাঁকি দেই না। আমি কাজ ভালোবাসি। নতুন নতুন কাজ নিতে পছন্দ করি।
তাহলে আপনি ওস্তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন?
বাদল ভাই: ওস্তাদ তো শেখায় না, সে পথ দেখায়। আসল শিক্ষক তো প্রকৃতি। দেখেন মাছের চলন দেখেই কিন্তু সাবমেরিন বানানোর বুদ্ধি পেয়েছে মানুষ। তারপর ফাইটার বিমান বা কোবরা হেলিকপ্টারও মানুষ কিন্তু পাখির চলন দেখেই বানিয়েছে। আমিও পথেপথে অনেক কিছু শিখি। আচ্ছা একটা গল্প বলি, খুব ছোট তখন আমি। আমার এক চাচা থাকতেন করাচিতে। মাঝেমধ্যে বাড়ি আসতেন। ঘরে তালা ঝুলিয়ে যেতেন। তালাটি তিনি ছাড়া আর কেউ খুলতে পারত না। তালায় চাবিও ছিল না। আমার কাছে সেটা খুব রহস্যের ছিল। পরে জানলাম, সেটা হলো নাম্বার তালা। আমার সেই থেকে ইচ্ছা নিজে একটা নাম্বার তালা বানাব। ওয়ার্কশপে এসে কাগজে ডায়াগ্রাম আঁকলাম। লেদ মেশিন চালানো ততদিনে ভালোই আয়ত্ত্ব করেছি। আমি একটা তালা বানিয়ে ফেললাম। ওস্তাদ দেখে তো অবাক। থাপা (থাবা) মাইরা কইল, এইটা আমি নিলাম। আমার তো কোনো আপত্তি নাই। আমি বানায়াই খুশি।
তারপরের কথা বলুন..
বাদল ভাই: বিরাশি সালে আমি ফোরম্যান হয়ে গেলাম। এটা কিন্তু কোনো পরীক্ষা দিয়ে না। ওয়ার্কশপ মালিক যখনে বোঝে ছেলেটা কারখানা চালাতে পারবে তখন তাকে ফোরম্যান বানায়। ভালো বেতন ধরে। আর সেই বছরই আমি বিয়ে করে ফেললাম। পরে তিরাশি সালে নিজে একটা কারখানা করি। নিজেরা লেদ মেশিন বানাই। সেই মেশিনটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
আপনি কি নিজেকে সফল মনে করেন?
সফল কি না বলতে পারব না। আমার দশটা বাড়ি নাই। একটা বাড়ি করেছি ছয়তলা। প্রথম দুইতলা ডুপ্লেক্স। গাড়িও একটাই। টয়োটা করোলা। ২০০৬ মডেল। নিজে ঠিকঠাক করে নিছি। ভালো গাড়ি এই করোলা। হেভি দম। তবে যা করছি তার সবই কষ্টের উপার্জন। আমি কারুর টাকা বাকি রাখি না, কাউকে ঠকাই না। সারা দেশের লোক আমাকে ভালো মেকানিক বলে চেনে। ছেলেকে ডাক্তার বানাইছি, মেয়ের বিয়ে দিছি। আমার টাকায় কোনো ভেজাল নেই।
আপনার সাফল্যের মূলমন্ত্র কি?
বাদল ভাই: সততা। সৎ মানুষের কষ্ট কম। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা অল্পেই সব পেতে চায়। আমি বলি, অল্পে পাওয়া ধন নিবা কেন? তাতে কোনো আনন্দ নেই। দেশটা একটা বিশৃংখলায় পড়ে গেছে। সব কি সরকার এসে করে দিবে? নিজেদের কিছু করতে হবে না?
আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন?
বাদল ভাই: আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলের ঘরে নাতি আর মেয়ের ঘরে দুই নাতনি। ছেলেদের নাম মিলন, সোহাগ। মেয়েটার নাম রাখছি পিয়া। সবগুলো নামের মধ্যেই দেখেন মোহাব্বত আছে। ছেলেটাকে ২৭ বছরে বিয়ে দিছি। নাতির খুব শখ আমার।
আপনি বড় কোন কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেন?
বাদল ভাই: বিশ্বাস বিল্ডার্স, জননী, নোমান গ্রুপের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কাজ করেছি। সেনানিবাসে কাজ করি।
কী ধরণের কাজ?
বাদল ভাই: অটোমোবাইলের সব কাজ। এছাড়া এক্সকাভেটর, ড্রিল মেশিন রিপেয়ার করি। গাড়ির পার্টস রিপেয়ার বা তৈরির কাজ তো শুরু থেকেই করি।
বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করেছেন?
বাদল ভাই: চট্টগ্রাম রোডের চীনা টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে কাজ করেছি। আমার সঙ্গে কাজ করে তারা খুশি হয়েছে। দেশে ফিরে গিয়ে চা পাঠাইছে। জাপানিদের সঙ্গে কাজ করেছি বিমানবন্দরে। অয়েল ট্যাংকার রিপেয়ার করেছি। তারাও খুব খুশি ছিল। বার বার কাজ নিয়া আসছে।
আপনি যেসব কাজ করেন তাতে দেশের কেমন উপকার হয়?
বাদল ভাই: দেখেন আমাদের মূল্যায়ন কম। ধরেন দক্ষিণ কোরিয়া থেকে একটা ক্যাটারপিলার আনা হইছে, কোনো একটা জায়গায় অসুবিধা ধরা পড়ল। এখন যদি যন্ত্রের সেই অংশটা জাহাজে করে কোরিয়া পাঠায় তাহলে খরচ কত হবে। ৪-৫ লাখ টাকা হয়ে যেতে পারে। আমরা সেই কাজ ৭০-৮০ হাজার টাকায় করে দিই। আপনিই হিসাব করেন কতটা লোকসান এড়ানো গেল। আমার এখানে ১৬ জন কর্মী। প্রায় ৬০-৭০ জন মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়। কিন্তু আমাদের মূল্যায়ন নাই।
এতে কি আপনার কষ্ট হয়?
বাদল ভাই: নাহ কষ্ট পাই না। আমি কাজ ভালোবাসি। কাজ খারাপ হলে কষ্ট পাই। ছেলেদেরও বলা আছে, কাজের পেছনে ছোটো, সাফল্য তোমার কাছে আসবে।
একদম ব্যতিক্রমী মানে নতুন কিছু কখনো করেছেন?
বাদল ভাই: আয়ত্ত্বের মধ্যে নাই এমন কাজ করি না। তাহলে চাপ বাড়ে।
কেমন খাবার পছন্দ করেন?
বাদল ভাই: সাধারণ। ভাত-মাছ-ডাল। একটা খাবার আনন্দ করে খাই তা হলো, হাসের গোশত আর ছিট রুটি।
কী ধরণের পোশাক আপনার পছন্দ?
বাদল ভাই: আমার পছন্দ গোল গলা গেঞ্জি। তবে যখন অনুষ্ঠানে যাই তখন সাফারি স্যুট পরি।
কারখানায় কতক্ষণ কাজ করেন?
বাদল ভাই: ১৩-১৪ ঘণ্টা। শুক্রবার ছুটি আছে।
আপনার কোনো শখ আছে?
বাদল ভাই: দাবা খেলতে পছন্দ করি। একবার ক্লাবের কম্পিটিশনে সেকেন্ড হইছিলাম।
আমাদের দেশে গাড়ি তৈরির কারখানা করা সম্ভব?
বাদল ভাই: আমাদের মেধা আর দক্ষতা আছে তবে দেশের লোক দেশি জিনিসপত্রে ভরসা কম করে। ভরসা করলে গাড়ি তৈরির কারখানা আমরা করতে পারব।