জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান থেকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রত্যয় শিক্ষার্থী ও পরিবেশবিদদের
মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, ঢাকার বুকে একটুকরো সবুজ ভূমি। এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ। প্রাকৃতিক পরিবেশে আশ্রয় পেয়েছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, এখানে ৪৫ প্রজাতির ফড়িং ৭৬ প্রজাতির প্রজাপতি, ১০ প্রজাতির উভচর, ১৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৪০ প্রজাতির পাখি ও ১২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসবাস এই উদ্যানকে ঘিরে। কিন্তু ভালো নেই এই উদ্যানের প্রকৃতিক পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীরা।
শনিবার বাংলাদেশের প্রকৃতিপ্রেমী সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রকৃতি নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন মিলে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আয়োজন করেছিল সচেতনতামূলক বিশেষ আয়োজন ওয়াইল্ড ওয়াক। যেখানে জনসাধারণকে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, দূষণমুক্তকরণের বিষয়ে সচেতন করা হয়।
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ সারা বাংলাদেশ এবং ধরিত্রীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শিক্ষার্থীরা শপথ গ্রহণ করেন। পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা, প্রাণিকল্যান ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজ করতে বদ্ধপরিকর হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী ও পরিবেশবাদী সংগঠন (বেঙ্গল ডিসকাভার, ডীপ ইকোলজি এন্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন, সেভ ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড নেচার, বাংলাদেশ এনভারনমেন্টাল এন্ড বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন এলাইয়েন্স, আন্তর্জাতিক সংস্থা এওয়ারনেস ৩৬০ ডিগ্রি) ছিল এই আয়োজনের সহআয়োজক। আর সার্বিক সহযোগিতায় ছিলো জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান কর্তৃপক্ষ।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সদস্যরাও এখানে অংশগ্রহণ করেন।
সকালে বন্যপ্রাণী সার্ভের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে এখানে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা বন্যপ্রাণী ও জীব বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি উদ্যানে উপস্থিত সাধারণ জনগণকে জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করেন। উদ্যানে জীববৈচিত্র্যের নিরাপত্তার পরিপন্থী সকল কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয় সকলকে। পাশাপাশি সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক ব্যবহার শূন্য করা এবং এক মাসের মধ্যে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানকে সম্পূর্ণ প্লাস্টিকদূষণমুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
ওয়াইল্ড ওয়াক শেষে শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন এবং সেখানে নিজেদের প্রত্যাশা তুলে ধরেন। তারা জীববিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে বইয়ের মুখস্থবিদ্যার পাশাপাশি প্রয়োগগত বিষয়গুলো তুলে ধরার আহ্বান জানান। কোর্সগুলো আরও বস্তবসম্মত এবং উন্নত বিশ্বমানের করার ওপর গুরুত্ব দিতে দাবি জানানো হয়। বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের জোর দাবি জানানো হয়। বিষয়সংশ্লিষ্ট চাকরিগুলোর পরিধি আরও বৃদ্ধির দাবিও জানানোর পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসংশ্লিষ্ট বিষয় স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়ে আলাদা বিভাগ থাকলেও বাংলাদেশে মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পর্যায়ে বন্যপ্রাণী জীববিদ্যা প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শাখার একটি অংশ। বর্তমানে দেশে ও বিদেশে অনেক সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশে এই বিষয়টি উপেক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে হাজারো শিক্ষার্থীর এই বিষয়টিতে পড়ালেখা করার আগ্রহ থাকলেও সুযোগ পায় না। তাই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণী জীববিদ্যা বিষয়টি আলাদা বিভাগ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানান তারা।
আলোচনা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন প্রাণিবিদ্যা প্লাটফর্মের মডারেটর মো. মোস্তফা আদনান।
আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালক মো. শওকত ইমরান আরাফাত, প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক আফতাব উদ্দীন সুজন, পাখিবিদ ও আলোকচিত্রী মো.তারিক হাসান, বন্যপ্রাণী বিষয়ক লেখক সরওয়ার পাঠান, লেখক ও সেভ ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড নেচার-এর সাংগঠনিক সম্পাদক বাপ্পী খান, বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ আশিকুর রহমান সমী, ডিপ ইকোলজি এন্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং প্রাণী সংরক্ষণবিদ মাহফুজুর রহমান, বন্যপ্রাণীবিষয়ক সাংবাদিক ও লেখক চিফ আমিনুল ইসলাম মিঠু প্রমুখ।
আলোচকরা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানকে প্রাকৃতিক পরিবেশে সমৃদ্ধ, দূষণমুক্ত, প্লাস্টিকবর্জ্যমুক্ত, জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীর বসবাসোপযোগী এক উদ্যানে পরিণত করার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলাশয়গুলোকে আরও জীববৈচিত্র্যের বসবাসোপযোগী করার জন্য তুলে ধরা হয়। উদ্ভিদ উদ্যানে প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষকদের প্রবেশ ফি কমানোর জন্যও দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি উদ্ভিদ উদ্যানে দূষণকারী ব্যক্তিকে উপযুক্ত জরিমানা করার দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশে প্রতি জেলায় এমন একটি উদ্যান রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালক শওকত ইমরান উদ্যানটিকে শিক্ষার্থী এবং সকল পরিবেশবাদী ও গবেষকদের নিয়ে একটি আদর্শ সংস্থায় পরিণত করার প্রচেষ্টার কথা এবং কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার কথা ব্যক্ত করেন।