ইতিহাস গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। চার বছর আগে হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর তার এ ফিরে আসা যুক্তরাষ্ট্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এডিসন রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার (৬ নভেম্বর) ৭৮ বছর বয়সি ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ২৭০টির বেশি ইলেক্টোরাল ভোট অর্জন করেছেন।
উইসকনসিনের সুইং স্টেটে জয়ের পর ট্রাম্পের জয় প্রায় নিশ্চিত হয়। বুধবার সকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিট) পর্যন্ত ট্রাম্প ২৭৯টি ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছেন, যেখানে হ্যারিসের ভোট ২২৩। এখনও বেশ কয়েকটি রাজ্যে ভোট গণনা চলছে।
জনপ্রিয় ভোটেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় ৫০ লাখ ভোটে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন।
ফ্লোরিডার পাম বিচ কাউন্টি কনভেনশন সেন্টারে সমর্থকদের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেন, 'আমেরিকা আমাদের একটি দৃঢ় এবং অভূতপূর্ব ম্যান্ডেট দিয়েছে।'
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পূর্বে ওয়েস্ট পাম বিচে নির্বাচনি পর্যবেক্ষণ অনুষ্ঠানে ভাষণে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন রিপাবলিকান ট্রাম্প।
ভাষণে ট্রাম্প বলেন, 'এটি আমেরিকার মানুষের জন্য একটি অসাধারণ বিজয়, যা আমাদের আবার আমেরিকাকে মহান করতে সাহায্য করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি সীমান্ত বন্ধ করতে যাচ্ছি এবং আমাদের দেশের সবকিছু ঠিক করতে যাচ্ছি।'
ট্রাম্পের রানিং মেট, সিনেটর জেডি ভ্যান্স সমর্থকদের সামনে বলেন, 'আমরা আজকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পুনরুত্থান দেখলাম।'
২০২০ সালের নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি তার সমর্থকদের ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালানোর পর মনে করা হয়েছিল, ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবন প্রায় শেষ। তবে তিনি রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখে শেষ পর্যন্ত কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করেন।
ট্রাম্প তার প্রচারণায় বারবার দাবি করেছিলেন, 'অবৈধ অভিবাসনের কারণে দেশে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে,' — যদিও এর পক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (হ্যারিসের সাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) সমর্থকেরা জড়ো হলেও কমলা হ্যারিস তাদের উদ্দেশে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য রাখেননি। তার প্রচারণা ক্যাম্পেইনের সহ-সভাপতি সেড্রিক রিচমন্ড মধ্যরাতের পর সমর্থকদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং জানান, হ্যারিস পরে বক্তব্য দেবেন।
'এখনো ভোট গণনা বাকি আছে,' সে সময় বলেছিলেন রিচমন্ড।
সিনেটে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস-এর নিয়ন্ত্রণে কোনো দলই এখনও পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
চাকরি ও অর্থনীতি
রয়টার্স/ইপসোসের জরিপ অনুযায়ী, ভোটারেরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা হিসেবে চাকরি ও অর্থনীতিকে দেখেছেন। দ্রুত মজুরিবৃদ্ধি, শেয়ার বাজারের রেকর্ড উল্লম্ফন ও কম বেকারত্ব হার সত্ত্বেও অনেক আমেরিকান জীবনযাত্রার খরচ নিয়ে অসন্তুষ্ট। বাইডেন প্রশাসনকে দোষারোপ করে বেশিরভাগ ভোটার মনে করেন, হ্যারিসের চেয়ে এ সমস্যা সমাধানে ট্রাম্পের প্রতি তাদের আস্থা বেশি।
ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক হিস্পানিক সম্প্রদায় এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোও মুদ্রাস্ফীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবার ট্রাম্পের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ, শ্বেতাঙ্গ এবং অ-কলেজ শিক্ষিত ভোটারদের মধ্যেও তার শক্ত ঘাঁটি অটুট ছিল।
দুবার অভিশংসিত এবং একাধিক ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হলেও কম জনসমর্থনের মধ্যেই ট্রাম্প এ বিজয় অর্জন করেছেন। তার এ জয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন নীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ, কর ব্যবস্থা এবং অভিবাসন নীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন মিত্রদের বাণিজ্য সংঘাত বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া কর্পোরেট কর হ্রাসের প্রতিশ্রুতি এবং নতুন বাজেট কাটছাঁট মার্কিন ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন বন্ধে ট্রাম্প গণ-নির্বাসন পরিচালনার পরিকল্পনা করেছেন। তার প্রতিপক্ষ শিবিরের শঙ্কা, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পদক্ষেপ নেবেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ: ঐতিহাসিক মুহূর্ত
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি ফৌজদারি মামলা কাঁধে নিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন এবং ওভাল অফিসে বসবেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা চলমান।
ক্যাপিটল হিলের হামলার ঘটনা ছাড়াও নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছে তার। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় পর্নোগ্রাফি তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের মুখ বন্ধ রাখতে এক লাখ ৩০ হাজার ডলার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এ অর্থ দেওয়ার বিষয়টি গোপন রাখার জন্য ট্রাম্প তার ব্যবসায়িক সংস্থার নথিপত্রে জালিয়াতি করেছিলেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। নভেম্বরের শেষের দিকে তার মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে।
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসলে ট্রাম্প প্রশাসন পুনর্গঠন ও তার দৃষ্টিতে অননুগত বেসামরিক কর্মচারীদের বরখাস্ত করতে পারেন বলে জানিয়েছেন। তার মেয়াদে জাতি, লিঙ্গ, প্রজনন অধিকার এবং শিশুদের শিক্ষাক্রম নিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথম মেয়াদে তার কিছু চরম সিদ্ধান্ত প্রায়ই তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। বিশেষ করে, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ২০২০ সালের নির্বাচনি ফলাফল প্রত্যাখ্যানের প্রস্তাবে সাড়া দেননি।
২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে ২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি ঘোষণা করা হবে। এরপর ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স শপথ নেবেন।
দীর্ঘ প্রচারণা জুড়ে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আনুগত্যকেই তিনি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবেন। তার দুই কট্টর সমর্থক বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ইলন মাস্ক এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রকে তার প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে চান ট্রাম্প।
বিজয় ভাষণে ট্রাম্প ইলন মাস্কের প্রশংসা করেন। মাস্ক ট্রাম্পের প্রচারণায় প্রায় ১২ কোটি ডলার জোগান দিয়েছেন।