ইভ্যালি: টাকাগুলো সব গেল কই?
গ্রাহকদের সাথে শত শত কোটি টাকার প্রতারণা করেছে ইভ্যালি। কিন্তু, প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে বর্তমানে আছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা। সম্পত্তির মধ্যে আছে- দুটি এসইউভি, অন্যান্য কয়েকটি মোটরযান ও সাভারে একখণ্ড জমি্- যার দাম মাত্র ৭-৮ কোটি টাকা।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে- বাকী সব টাকা কোথায় গেল?
উত্তর সন্ধানে গ্রাহকদের কাছ থেকে ই-কমার্স কোম্পানিটির অগ্রিম নেওয়া অর্থের সন্ধান শুরু করেছেন তদন্তকারীরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান শাখার ডেপুটি কমিশনার মো: আসাদুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ও চেয়ারপার্সন শামীমা নাসরিনের ব্যাংক একাউন্টসমূহ ও সম্পদের তথ্য পেতে ইতোমধ্যেই তারা হাইকোর্টে আপিল করেছেন।
তিনি জানান, হাইকোর্ট অনুমতি দিলে, বাংলাদেশ ব্যাংক, যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের রেজিস্ট্রারার, সিটি করপোরশনসমূহ ও অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকে এসব তথ্য পাবে পুলিশ।
পুলিশের উপ-পরিদর্শক ও তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, "টাকার সন্ধান জানতে আমরা রাসেল-নাসরিন দম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু, তারা আমাদের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি।"
"এজন্যই আমরা এখন তাদের ব্যাংক হিসাবগুলোর তথ্য চেয়েছি," যোগ করেন ওয়াহিদুল।
এদিকে পুলিশের বিশ্বস্ত একটি সূত্র টিবিএস'কে বলেছে, "প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময় রাসেল আমাদের বলেছেন, অনেক টাকা বিজ্ঞাপন ও প্রমোশনে খরচ করা হয়েছে। কিছু অংশ খরচ হয়েছে আকর্ষণীয় মূল্যছাড়ে।"
"কিন্তু, এসব খরচ বাদ দিলেও, বিপুল পরিমাণ টাকার এখনও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাহলে টাকা গেল কোথায়? বিষয়টি আমরা গুরুত্ব-সহকারে দেখছি"- বলেন ওই কর্মকর্তা।
সূত্রটি আরও বলেছে, "বেশ কয়েক কোটি টাকা প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের সময় রাসেল তাদের নাম বলতে পারেননি। তবে তিনি বলেছেন, বিশাল রকমের মূল্যছাড়সহ সব প্ল্যান করেন শামীমা নাসরিন। রাসেল শুধু স্ত্রীর বুদ্ধি অনুসরণ করে, দেশের ই-কমার্স খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি গড়ে তোলেন।
এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গ্রাহকদের দেওয়া অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হলে ইভ্যালিসহ সকল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে না জেনে, মানুষজনকে লেনদেনে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েও সতর্ক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
কামাল বলেন, "লোভনীয় অফারের কথাই ধরুন, দামি যে গাড়ির দাম হয়তো ১০০ টাকা, তারা বলছে ৫০ টাকায় দেবে। তাই বিনিয়োগের আগে সবারই ভাবা উচিত, এক্ষেত্রে কতখানি ঝুঁকি রয়েছে এবং কী ধরনের পণ্য পাবেন। প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি, সেটাও ভাবতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করে যদি নিশ্চিত না হন, তাহলে এমন কোম্পানিতে আপনার বিনিয়োগ না করাই ভালো।"
এদিকে রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) গুলশান থানায় ইভ্যালি সিইও, চেয়ারপার্সন ও এর কয়েকজন ব্র্যান্ড প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা করতে আসেন সাদ এম. রহমান নামের এক গ্রাহক। তবে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও নবাবগঞ্জবাসী এ তরুণের মামলা নেয়নি পুলিশ। থানার পরিদর্শক (অপারেশন) শহিদুজ্জামান তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগ করেন এ তরুণ।
তারপর পুলিশের পরামর্শেই তিনি ধানমন্ডি থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু, সেখানেও কয়েক ঘণ্টা ধরে চেষ্টার পরও মামলা করতে পারেননি। সেখানকার কর্মকর্তারা, তাকে এক সপ্তাহ পর আসতে বলেন।
ধানমন্ডি থানার এক কর্মকর্তা বলেন, "যেসব মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির বড় দেনা রয়েছে, এখন আমরা শুধু তাদের মামলা নিচ্ছি।"
এর আগে গত ৩০ মে সাদ টিবিএস'কে জানান, ইভ্যালিতে তিনি ৩ লাখ ১৮ হাজার টাকার মূল্যছাড়ে একটি মোটরসাইকেল কেনার অর্ডার দিয়েছিলেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "সরকার তাদের কেন ব্যবসা করার অনুমতি দিল? মূল্যছাড়ে মোটরসাইকেল কেনাটাই কী তাহলে আমার অপরাধ? এখন পুলিশও মামলা নিচ্ছে না।"
যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও অর্থ ফেরত পাওয়ার মামলা করতে, গুলশান থানায় এখন সাদের মতো অনেক গ্রাহকই আসছেন।
এর আগে, একজন গ্রাহকের করা মামলার প্রেক্ষিতে রাসেল-শামীমা দম্পতি গ্রেপ্তার হওয়ার দুদিনের মাথায়, গত শনিবারে একজন সবরাহকারীও এ দম্পতিসহ ইভ্যালির আরও ২৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেছেন।
মহানগর পুলিশের ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত সহকারী-কমিশনার ইহসানুল ফেরদৌস টিবিএস'কে জানান, ইতোমধ্যেই এ মামলায় রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তারা আরও সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করবেন।
ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মাসুম রোববার সকালে জানান, "কামরুল ইসলাম চাকলাদার নামের একজন পণ্য সরবরাহকারী শনিবার রাতে ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন। তিনি মোট ৩৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন।"
মামলার অভিযোগপত্রে তিনি, ইভ্যালির ১২ জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেন এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামী করেছেন।
উল্লেখ্য, গত বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে আরেফ বাকের নামের এক গ্রাহক রাজধানীর গুলশান থানায় গিয়ে ইভ্যালির সিইও রাসেল এবং তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন। এর কয়েকঘণ্টা পর, এ দম্পতির মোহাম্মদপুরের বাসভবনে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেন র্যাব সদস্যরা।
ইতঃপূর্বে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে ই-কমার্স ফার্মটির বিপুল অংকের আর্থিক অনিয়ম জনসম্মুখে আসে।