ই-কমার্সের মোড়কে পঞ্জি ব্যবসা: কীভাবে ‘লোভ সংবরণ’ করবে গ্রাহক?
পড়াশোনা শেষ করে চাকরির অসম প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারছিলেন না লক্ষীপুরের তরুণ রাশেদ খান। ফলে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পুঁজি নিয়ে নেমেছিলেন ব্যবসায়।
বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে ঢাকার দোকানগুলোতে বিক্রির জন্য দিতেন তিনি। তবে মহামারি এসে থামিয়ে দেয় তার উপার্জনের একমাত্র পথটিকে। করোনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধার দেনা করেও যখন কোনোভাবে উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন ই-কমার্সে বিনিয়োগের বুদ্ধি দেন তার এক বন্ধু। সেই পরামর্শে গত ১৭ জুন ই-কমার্স কোম্পানি কিউ-কমে ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকার একটি মোটরসাইকেল ৩৯% ছাড়ে অর্ডার করেন তিনি।
একইদিনে টাকাও পরিশোধ করেন। কথা ছিল- মূল্য পরিশোধের ৩০ দিনের মধ্যেই তিনি পণ্য হাতে পাবেন। তবে কিউকমের সেই অঙ্গীকারের ৯৭ দিন পেরিয়ে গেলেও মোটরসাইকেলের দেখা তিনি আর পাননি। নানাভাবে চেষ্টা করেও কোম্পানিটির কারও সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে পারেননি। মহামারির করাল গ্রাসে ব্যবসার পুঁজি হারানো তরুণ রাশেদ এখন কিউকমের হাতে 'প্রতারিত' হয়ে অথৈ জলে পড়েছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। পরিবারের হাল ধরতে চেয়েছিলাম। পারিনি। এই রাষ্ট্রতো আমাদের হারিয়ে যাওয়া অর্থের দায় নেবে না, তাই ব্যর্থ একজন মানুষের মতো নিজের নিয়তিকেই দোষারোপ করছি।'
রাশেদের মতো অনেক তরুণই ই-কমার্সের আদলে ব্যবসা করা কিছু কোম্পানির লোভনীয় সব বিজ্ঞাপণ আর ছাড়ে আকৃষ্ট হয়ে সেগুলোতে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
মহামারিতে ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যবসা
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক তরুণ শিক্ষার্থীই নিজেদের টিউশন হারিয়ে কর্মহীন হয়ে যান। চাকরির পরীক্ষাগুলো স্থগিত হয়ে যাওয়ায় অনেক চাকুরিপ্রার্থীই তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। আবার ছোটখাট উদ্যোক্তাদের ব্যবসাগুলোও স্থবির হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটা অর্থনৈতিক সংকটের শুরু হয়। আর এই সংকটকে কাজে লাগিয়েই ফুলেফেঁপে ওঠে ই-কমার্সের নামে পঞ্জি স্কিমের ব্যবসাগুলো।
ক্যাশব্যাক আর ডিস্কাউন্টের লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই লাখ লাখ মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানে পণ্যের অর্ডার করতে শুরু করে।
শুরুতে তারা কিছু গ্রাহককে কাছে পণ্য সরবরাহ করে। তবে কয়েকদিনের মাথায় বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েও যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ নিয়ে টালবাহানা শুরু করে। অন্যদিকে মার্চেন্টদের টাকাও পরিশোধ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে।
ই-কমার্সের নামে লোভনীয় এসব অফারে তরুণদের আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, "যে পরিমাণ তরুণ চাকরির পরীক্ষা দেয় তারা সবাই তো চাকরি পায়না। খুব সামান্যই চাকরি পায়। তাহলে বাকি তরুণরা কোথায় যাবে? কেউ কেউ এনজিওতে যাচ্ছে, প্রাইভেট সেক্টরে যাচ্ছে। কিন্তু সবাইতো চাকরি পাচ্ছে না। ফলে ই-কমার্স তাদের ভরসা হয়ে গিয়েছিল।"
তিনি বলেন, "এখন সব অনলাইনেই হবে। মহামারির কারণে আমরা যেহেতু স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করতে পারিনি, সেখানে যা কিছু হবে তা ই-কমার্সেই হবে। এখন ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবসা যেমন হবে, তেমনি পর্ণোগ্রাফি, এবিউজডের মতো সমস্যা সংকটও হবে। তরুণরা কেনো আকৃষ্ট হবে না? বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারা যখন দেখছে এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমি কিছু করতে পারি, তারা তো সেদিকে যাবেই।"
এসব ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠার পেছনে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দায় দেখছেন অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
তিনি বলেন, "ইভ্যালিকে কেন্দ্র করে এখন আমরা ব্যবস্থা নিতে দেখছি। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা দেখি যে বেশিরভাগ বিষয় অ্যাডহক ভিত্তিতে করা হয়। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।"
"যখন দেখছি, বিশ্ব ই-কমার্সে চলে যাচ্ছে, আমরা গড়তে চাচ্ছি ডিজিটাল বাংলাদেশ, সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতেই করা হচ্ছে, তখন আমাদের ব্যবসার ক্ষেত্রগুলো অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ঠ সংস্থাগুলো কেনো আগে থেকে নীতিমালা তৈরি করে না? যে কারণে এতো ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটছে।"
তিনি বলেন, "হাজার হাজার কোটি টাকা হাপিস করে দেওয়ার পর, বলছে আমার তো টাকা নাই, কোত্থেকে দেবো? এই যে অ্যাকাউন্টিবিলিটির জায়গাটা সেটা নিশ্চিত করতে কিন্তু দুদক আছে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ আরও সংস্থা আছে। কিন্তু তাদের কাজের কোনো সমন্বয় নেই।"
'লোভ সংবরণ' কীভাবে করবে?
বুধবার মন্ত্রীসভার একটি বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, দেশের ই-কমার্স খাতে প্রতারণার দায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে। কারণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েই তারা কার্যক্রম শুরু করেছে।
একই দিনে ঢাকার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ইভ্যালি এবং ই-অরেঞ্জের মতো সাইটগুলোর ঘটনা রোধ করতে সবাই যেন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে 'কম দামে পণ্য কেনার লোভ সংবরণ' করেন।
অথচ ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ বা ধামাকা'র মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর শুরু থেকেই সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা দেখা যায়। সরকারের দায়িত্বশীল পদে থাকাদেরও এসব ব্যবসার পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানও এসব ই-কমার্সের স্পন্সর নিয়ে নানা সময়ে অনুষ্ঠান করেছে।
এছাড়াও বড় ক্রিকেট তারকা, শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা এসব প্ল্যাটফর্মের লোভনীয় অফারের প্রচারণায় অংশ নেন। যেকারণে পণ্যের অর্ডার করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন সাধারণ গ্রাহকরা।
ড. সাদেকা হালিম বলেন, "যে পরিমাণ তরুণ চাকরির পরীক্ষা দেয় তারা সবাই তো চাকরি পায়না। খুব সামান্যই চাকরি পায়। তাহলে বাকি তরুণরা কোথায় যাবে? কেউ কেউ এনজিওতে যাচ্ছে, প্রাইভেট সেক্টরে যাচ্ছে। কিন্তু সবাইতো চাকরি পাচ্ছে না। ফলে ই-কমার্স তাদের ভরসা হয়ে গিয়েছিল।"
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ও বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) একেএম ফাহিম মাশরুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে গ্রাহকরা একধরণের সিগন্যাল পেয়েছে, যে সরকার কখনো এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে যাবে না। গ্রাহকরা দেখেছিল, এই কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে স্পন্সর করছে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা অনুষ্ঠানে স্পন্সর করছে, মন্ত্রণালয়ের প্রোগ্রাম স্পন্সর করছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই গ্রাহকদের ভাবনায় আসবেই এই কোম্পানিগুলো টিকে থাকবে, টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবে না।"
এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা বলেন, "গত কয়েকবছরে বেকারত্বের সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। উচ্চ শিক্ষা শেষে প্রায় ৭০ ভাগই বেকার থাকছে। তাদের তো কিছু না কিছু করতে হবে। অনেকেই ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু সব নিয়ম মেনে ব্যবসা করে তো রাতারাতি সাফল্য পাওয়া যাবে না। অনেকেই এটা শর্টকার্ট করতে চায়। এই সকল তরুণরাই রাতারাতি বড়লোক হতে ১৯৯৬ সালে শেয়ার মার্কেটে গিয়েছিল। সেই শেয়ারমার্কেট থেকে আজকের ইভ্যালি, সবকিছুকেই তরুণরা ব্যবসা হিসেবেই নিচ্ছে।"
দেশে ব্যবসার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে সরকার 'ব্যর্থ হয়েছে' বলে মনে করেন ফাহিম মাশরুর।
তিনি বলেন, "দেশে চাকরিরও তেমন সুযোগ নাই। ব্যবসা করাটাও ডিফিকাল্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে যারা ছোট উদ্যোক্তা তাদের মহামারিকালে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বড় কোম্পানিগুলো কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছে, সরকারের প্রণোদনা পেয়েছে কিন্তু যারা ছোট উদ্যোক্তা তারা সরকার থেকে টাকা পায়নি। তাই তারা ভেবেছে, আমাদের তো কিছু না কিছু করতে হবে। তখন তারা রিস্ক নিয়েই ই-কমার্সে বিনিয়োগ করেছে।"
'এটা কোনো ব্যবসার মডেল হতে পারেনা'
গ্রাহকের টাকা নিয়ে নয়-ছয় করা এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেমেছে সরকার। ইতোমধ্যেই ই-কমার্সের আদলে বাংলাদেশে পঞ্জি ব্যবসার অগ্রদূত ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামিমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্গলা রক্ষাকারী বাহিনী।
অন্যদিকে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, কোম্পানির চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমান উল্লাহ এক গ্রাহকের করা ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।অন্যদিকে ধামাকা শপিংয়ের প্রধান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জসীম উদ্দিন চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেছে সিআইডি।
তবে এসব পঞ্জি ব্যবসার বিরুদ্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তৎপর হলেও এখনো এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যপদ বাতিল করেনি ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইভ্যালিসহ আরও কয়েকটা কোম্পানির বিরুদ্ধে আমরা অ্যাকশন নেবো। আমরা আসলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। স্থগিত করলেই তো হবে না, কাস্টমারের টাকাটা তো ফেরত দিতে হবে। তারা আমাদের কাছে ২ মাস সময় চেয়েছিল। তবে এই সময়ের মধ্যে যেহেতু প্রবলেমগুলো সলভ করতে পারছে না, পারার সম্ভাবনাও যেহেতু দেখছি না, সেকারণে দুই-একদিনের মধ্যেই আমরা একটা সিদ্ধান্ত নেবো"
তিনি বলেন, "প্রথমে তো বোঝার উপায়ই ছিলো না। তাদের ফান্ডিং কোত্থেকে আসছে সেটা বোঝার সুযোগ থাকে না। কাস্টমারের টাকা নিয়ে অন্যদের ডিস্কাউন্ট দেওয়া অল্প সময়ের জন্য হতে পারে, তবে লং টার্মের জন্য এটা ব্যবসার মডেল হতে পারে না। যে কারণে ২০১৮ সালেই আমরা এসক্রো সার্ভিসের কথা বলেছিলাম। যারা পঞ্জি স্কিমের ব্যবসা করছিল, গত দুই মাসে তাদের অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এই কাজটা ই-ক্যাবই করেছে।"
তমাল বলেন, "যারা পঞ্জি স্কিমের ব্যবসা করছে তারা নিজের টাকায় ব্যবসা করছে না। পাবলিকের টাকায় আরেকজনকে ডিসকাউন্ট দেয়। সুতরাং তাদের টাকার মায়াও নাই। অন্যদের কতোদিনের মধ্যে পণ্য দিতে হবে, কী করতে হবে এগুলো তাদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেও নাই।"