ক্রমবর্ধমান চাহিদার মুখে সিনথেটিক সুতা উৎপাদনে ঝুঁকছেন স্পিনাররা
বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিনথেটিক ও মিশ্র সুতা উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছেন দেশের সুতা উৎপাদনকারীরা।
কটন সুতার ওপর নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকতে নোমান গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, ম্যাকসনস গ্রুপ, স্কোয়ার গ্রুপ এবং সাশা ডেনিমের মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো এখন সিনথেটিক ও মিশ্র সুতা উৎপাদনে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
দেশের টেক্সটাইল ও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে স্পিনিং মিলগুলো ২০২০ সালে এক লাখ টন পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবার আমদানি করে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) মতে, ২০১৫ সালেও আমদানির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ টন।
সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে ১০ থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০টি। অ্যাকটিভওয়্যারের মতো দামি ও উচ্চমানের গার্মেন্টস পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সিনথেটিক ও মিশ্র সুতা এসব মিলে উৎপাদিত হচ্ছে বলে জানান বিটিএমএ কর্মকর্তারা।
মিশ্র সুতার মধ্যে থাকছে কটন, পলিয়েস্টার, নাইলন, উল, ভিসকস ইত্যাদি।
ইন্টারন্যাশনাল টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার ফেডারেশনের (আইটিএমএফ) মতে, বৈশ্বিক ফ্যাশন ও কাপড়ের বাজারের প্রায় ৭৮ শতাংশই দখল করে রয়েছে কৃত্রিম তন্তুর তৈরি পোশাক। বাকি অংশে রয়েছে কটনের তৈরি বিভিন্ন কাপড়।
অন্যদিকে আইটিএমএফের মতে, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৭০ শতাংশই কটনের তৈরি। বাকি ৩০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে সিনথেটিক ফাইবার উৎপাদিত পোশাক সামগ্রী।
২০২০ আলে বৈশ্বিক সিনথেটিক ফাইবারের বাজার মূল্য ছিল ৫৯.৯৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সাল থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত এই বাজারের চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্যমতে, ২০২৮ সালের মধ্যে সিনথেটিক ফাইবারের বাজার মূল্য ৯৯.৭৮ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রাজীব হায়দার মুন্না দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, স্পিনিং মিলারদের অনেকেই তাদের উৎপাদন ক্ষমতার একাংশ সিনথেটিক সুতা উৎপাদন উপযোগী করে তুলছে। অন্যদিকে, অনেকে সিনথেটিক ও মিশ্র সুতা উৎপাদনের জন্য নতুন ইউনিট স্থাপনে বিনিয়োগ করছেন।
বাজারের চাহিদার ওপর সকল উদ্যোগ নির্ভর করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "গার্মেন্টস মালিকদের সিনথেটিক ও মিশ্র সুতার চাহিদার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সুতা উৎপাদনকারীরা এধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।"
এক বছরের মধ্যে সিনথেটিক সুতার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ স্পিনিং ও টেক্সটাইল শিল্পগোষ্ঠী নোমান গ্রুপ শতাভাগ সিনথেটিক সুতা উৎপাদন ইউনিট স্থাপনে বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানে এই ইউনিটে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলছে।
নোমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের নির্বাহী পরিচালক (স্পিনিং) মোহাম্মদ এনামুল করিম বলেন, "আমাদের নতুন ইউনিটে দৈনিক ১০০ টন সিনথেটিক সুতা উৎপাদন করা যাবে। চলতি মাসের শেষে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে এই ইউনিট।"
এছাড়া, মিশ্র ও কটন সুতা উৎপাদনের জন্য আরেকটি স্পিনিং মিলের নির্মাণকাজ শুরু করার কথাও জানান তিনি। ওই কারখানায় দৈনিক ১২৫ টন সুতা উৎপাদন করা যাবে।
"প্রাথমিকভাবে নতুন ইউনিটে আমাদের ২৫ টন মিশ্র সুতা উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। বায়ারদের চাহিদা অনুসারে আমরা উৎপাদন বৃদ্ধি করব," বলেন তিনি।
নির্মাণাধীন ইউনিটে ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এখানকার উৎপাদন চালু হবে। কারখানায় এক হাজার ৫০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলেও জানা গেছে।
বর্তমানে, নোমান গ্রুপ দৈনিক প্রায় ৪৫০ টন কটন ও মিশ্র সুতা উৎপাদন করে থাকে। অন্যদিকে, বিভিন্ন স্পিনিং মিল মিলিয়ে বর্তমানে দেশে দৈনিক প্রায় পাঁচ হাজার ৫১১ টন সুতা উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে।
স্থানীয় সুতা উৎপাদনকারীরা রপ্তানিমুখী নিট সুতার ৮০ শতাংশ এবং ওভেন সুতার ৪০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম বলে জানায় বিটিএমএ। সিনথেটিক ও মিশ্র সুতার অধিকাংশ চীন থেকে আমদানি করা হয় বলেও জানায় তারা।
এনভয় গ্রুপও সিনথেটিক মিশ্র সুতা উৎপাদনে ১২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। প্রতিষ্ঠানটির নতুন ইউনিটে দিনে ১২ টন সুতা উৎপাদিত হবে।
এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দীন আহমেদ বলেন, "রপ্তানিকৃত সুতার বিকল্প হিসেবে কটন ও সিনথেটিকের মিশ্র 'এক্সপেন্ডেড সুতা' উৎপাদনের জন্য আমাদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছি।"
বিশ্বব্যাপী সিনথেটিক সুতার চাহিদা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি এধরনের সুতা উৎপাদনে
খরচ কম হওয়ার পাশাপাশি তা টেকসই বলেও মন্তব্য করেন।
"অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে গত কয়েক বছর ধরেই তুলার দাম অস্থিতিশীল। আর তাই, দিনদিন কটন সুতা উৎপাদন খরচ বাড়ছে," ব্যাখ্যা করেন তিনি।
"সুতরাং, কটন সুতা উৎপাদন করে আমরা মুনাফা ধরে রাখতে পারব না," বলেন তিনি।
এনভয় গ্রুপের মতোই ডিবিএল গ্রুপের অঙ্গসংস্থা মাটিন স্পিনিং মিলও সিনথেটিক সুতা উৎপাদনের বিশেষ ইউনিট স্থাপনে ১৮৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে মাটিন স্পিনের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, নতুন এই বিশেষ সুতার ইউনিট প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ১০ টন পর্যন্ত বৃদ্ধি করবে। এছাড়া বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
ডিবিএল গ্রুপের মতো দেশের শীর্ষ ১০ স্পিনিং মিলের অন্যতম ম্যাকসনস গ্রুপও মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন তিনটি স্পিনিং ইউনিটে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেট্রো স্পিনিং লিমিটেড একটি ইউনিটে ৩৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। অন্যদিকে, অপর দুই ইউনিটে ম্যাকসনস যথাক্রমে ২৫৪ কোটি টাকা ও ৩৮৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সূত্র।
স্কোয়ার টেক্সটাইলসও ৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চলেছে। এছাড়া, মোজাফফার হোসেইন স্পিনিং মিলস ইতোমধ্যে উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
এদিকে, ভবিষ্যতে ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সাশা ডেনিম ঢাকার রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় আটটি প্লট ইজারা নিতে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সঙ্গে চুক্তি করেছে।