নাবিকরা আর সমুদ্রে যেতে চায় না, ভেঙ্গে পড়তে পারে বিশ্ব বাণিজ্য
পৃথিবীর মহাসাগরগুলো জুড়ে চলাচলকারী পণ্যবাহী ট্যাংকার জাহাজ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধমনী। চলমান বিশ্ব মহামারির মাঝে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে এই বাণিজ্যপথের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। কিন্তু করোনার মহামারি এখন নতুন হুমকি সৃষ্টি করেছে এই অতি-জরুরি বাণিজ্যের কাঠামোতে।
সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছে দূরপাল্লার বিমান চলাচল বন্ধ থাকায়। এর ফলে প্রায় দুই লাখ নাবিক কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছেন না। এছাড়াও, অনেক বন্দর বন্ধ থাকায় তাদের কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়টিও হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। এই অবস্থায় যারা ইতোমধ্যেই বাণিজ্যিক জাহাজে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের সিংহভাগ ধর্মঘট করে বসতে পারেন। ইতোমধ্যেই স্তিমিত বিশ্ব বাণিজ্যের সচল মাধ্যমটিকে যা পুরোপুরি থামিয়ে দেওয়ার মতো হুমকি তৈরি করছে।
মহামারির মাঝে জরুরি পণ্য, জ্বালানি, ওষুধ সরবরাহে ইতোমধ্যেই বিপুল সংখ্যক অভিজ্ঞ নাবিক তাদের কাজের চুক্তিপত্রে উল্লেখিত মেয়াদের চাইতেও বেশি সময় একটানা কাজ করে চলেছেন। কিন্তু, এভাবে মাসের পর মাস সমুদ্রযাত্রার ধকল এবং বাড়ি ফিরতে না পারার মানসিক চাপ এখন প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তাদের মধ্যে। জাহাজ পরিবহন শিল্প সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কোম্পানিগুলোই এই উদ্বেগজনক তথ্য জানিয়েছে। বাণিজ্যিক জাহাজে মানসিক বিষাদে আক্রান্ত নাবিকেরা বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারেন বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অভিজ্ঞ নাবিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন- ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন বলছে, গত মঙ্গলবারই জরুরিভিত্তিতে করা জাহাজে থাকার নির্দেশভিত্তিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে।
সংগঠনটি এখন নাবিকেরা যেন ছুটিতে বাড়ি ফিরতে পারেন, তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সকল আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে। দক্ষ নাবিকেরা আইনি উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মন্দায় আচ্ছন্ন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এ পদক্ষেপ ঘোর সঙ্কটের সূচনা করতে পারে।
তবে নাবিকদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার বিষয়টিও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। সরকারি শিপিং অফিসের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় চার হাজার নাবিক ও স্টাফ বিভিন্ন দেশে আটকা পড়ে আছেন। আকাশপথের পরিবহন সচল না হলে আরও অনিশ্চয়তা বাড়বে তাদের পরিবারে।
তাছাড়া বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ৬টি জাহাজের ১৫৬ জন নাবিক, অফিসার ও স্টাফ বিভিন্ন দেশে আটকা পড়ে আছেন। আকাশপথ সচল না হওয়া পর্যন্ত তাদের জাহাজ থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বিএসসি কর্তৃপক্ষ।
আন্তর্জাতিকভাবে যখন দক্ষ নাবিকের সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তখন চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশি অনেক নাবিক এখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন। কিন্তু তাদেরকেও পরিবার রেখে দূরে থেকে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার ধকল সইতে হবে। যাদের অনেকেই গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে সমুদ্রে আছেন।
বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য জাহাজে মালামাল পরিবর্তনের মতো কোনো সহজ ও কম খরচের বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ৮০ শতাংশই হয় সমুদ্রপথে। এ তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের বৈশ্বিক উন্নয়ন ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্মেলন-আঙ্কটাড।
নাবিকদের জন্য আরেক বড় সমস্যা হচ্ছে, সংক্রমণ প্রতিরোধে অধিকাংশ দেশের বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। জাহাজ থেকে নামতে দেওয়া হচ্ছে না বন্দরে। অধিকাংশ বন্দরেই বন্ধ আছে পানশালাসহ নাবিকদের বিনোদনের অন্যান্য ব্যবস্থা। গভীর অবসাদে বিস্তীর্ণ সমুদ্রে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
এই অবস্থায় নতুন কর্মীদের নিয়ে আসার মাধ্যমে পুরনোদের ছুটি দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। তবে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায়, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে নতুন নাবিকদের নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব।
গত মার্চে প্রথম বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে শিপিং কোম্পানি এবং ইউনিয়নগুলো এক সমঝোতার মাধ্যমে নাবিক পরিবর্তনের কার্যক্রম বন্ধ রাখে। কিন্তু, সেটা ছিল একটি বড় সমস্যার স্বল্পমেয়াদি সমাধান।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কন্টেইনার পরিবাহী জাহাজ কোম্পানি মায়েরস্ক জানায়, তাদের মোট সাড়ে ৬ হাজার নাবিক এবং ক্রু'র মধ্যে ৩৫ শতাংশ চুক্তির মেয়াদ পার হয়ে যাওয়ার পরও সাগরে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
মার্কিন বার্তা সংস্থা সিএনএন'কে পাঠানো এক ইমেইলে কোম্পানির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা পল লারসন জানান, ঠিক কবে আটকে পড়া এসব নাবিক বাড়ি ফিরতে পারবেন, তা তারা জানেন না। দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি এবং সে কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এখন আমরা আস্তে আস্তে লক্ষ্য করছি।
'নাবিকদের নিরাপত্তা, সংশ্লিষ্ট শিল্পের মানদণ্ড নিয়মনীতি রক্ষা এবং মানবিক কারণে ক্রুদের ঘরে ফেরার দাবি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা সম্ভব নয়, বলেই জানান তিনি।
আবার দেশ ও কোম্পানিভেদে জাহাজের নাবিকদের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগের ঘাটতিও আছে মালিকপক্ষের মধ্যে।
ব্রিটিশ নাবিক রিচার্ড বার্নস জানান, তিনি সৌভাগ্যবান কারণ একটি মানসম্পন্ন ইউরোপীয় কোম্পানির জাহাজে চাকরি করছেন। তাছাড়া পশ্চিমা নাবিকেরা বাড়তি সুযোগ-সুবিধাও পান। সেই তুলনায় ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, চীন এবং ভিয়েতনামের নাবিকেরা খুবই দুর্দশার মধ্যে দিয়ে এখন দিন অতিবাহিত করছেন বলে জানান তিনি।
এই অবস্থায় নতুন নাবিকদের নিয়ে আসতে দূরপাল্লার বিমান পরিবহন সচল করার জোর আহ্বান জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের মহাসচিব স্টিভ কটন।
ইতোমধ্যেই সাহায্য চেয়ে আটকে পড়া নাবিকেরা তার সংগঠনের কাছে প্রতিদিন শত শত বার্তা এবং টুইট পাঠাচ্ছে বলে জানান তিনি। সকল দেশের সরকার এই অচলাবস্থা নিরসনে উদ্যমী না হলে নাবিকেরা কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে, বলে হুঁশিয়ার করেছেন স্টিভ কটন।