ফ্ল্যাট ক্রয়ের কঠিন সময়
ব্যাংক কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের জন্য ঢাকা শহরে মধ্যবিত্তের নিজ বাড়ির স্বপ্নটি প্রায় পূরণ হওয়ার কাছেই ছিল। ২০১৭ সালেই মালিবাগ এলাকায় স্নিগ্ধা হোমে ১১শ' বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট বুকিং দেন তিনি। এজন্য নির্ধারিত মূল্যের সব টাকার কিস্তিই পরিশোধ করেন, চলতি বছরের মার্চ নাগাদ দিয়েছেন মোট ৬০ লাখ টাকা।
চুক্তি অনুযায়ী, ডেভেলপার কোম্পানি তামান্না প্রপার্টিজের পক্ষ থেকে গত এপ্রিলেই ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময় নির্ধারিত ছিল, কিন্তু তখনই বিশ্বজুড়ে হানা দেয় কোভিড-১৯ মহামারি। মুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় গতানুগতিক জীবন ও ব্যবসাবাণিজ্য। এরপর মে মাসে কোম্পানিটির তরফ থেকে শরিফুল ইসলাম একটি নোটিশ পান, নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়ায় অতিরিক্ত আরো ৬ লাখ টাকা দেওয়ার দাবি করা হয় সেখানে।
অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার ছয় মাস পরই ফ্ল্যাটের কাজ শেষ করে হস্তান্তর করা হবে বলে নোটিশটিতে উল্লেখ করা হয়।
শরিফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শুধু আমাকে নয়। স্নিগ্ধা হোমের এরকম আরও ১৪ জন ফ্ল্যাট ক্রেতাকে একই নোটিশ দিয়েছে তামান্না প্রপার্টিজ। বাধ্য হয়েই আমাদের টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।'
মোদ্দা কথা, বুকিংয়ের জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ক্রেতারাও কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান দর বৃদ্ধির ভার বইছেন।
যেমন; গৃহনির্মাণের একটি অতি-প্রয়োজনীয় উপকরণ ইস্পাতের দাম গত ছয় মাসেই ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
চলতি বছরের মার্চেই প্রতিটন রড ৫২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আবাসন খাতের ঠিকাদার ও ডেভেলপারদের বর্তমানে প্রতিটন রড ৭৪ হাজার টাকা দরে কিনতে হচ্ছে।
ঢাকা-ভিত্তিক ইস্পাতের ডিলার মেসার্স আমান স্টিল কর্পোরেশনের মালিক মো. আমানুজ্জামান বলেন, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ইস্পাত ও সিমেন্টের দাম ক্রমাগত বেড়েছে।
'চলতি বছরের মার্চের পর থেকেই সবকিছুর দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া শুরু করে। দাম বাড়ার কারণে আমাদের অর্ডারের পরিমাণও কমছে'- বলেন তিনি।
একইসময়, সিমেন্টের ব্যাগপ্রতি দাম ৩০ টাকা, পাথরের টনপ্রতি তিন হাজার টাকা এবং বালুর দাম বেড়েছে ট্রাকপ্রতি দুই হাজার টাকা।
এছাড়া, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতিটি ইটের দাম দেড় টাকা, অটোব্রিকস আড়াই টাকা, সিরামিক ব্রিকস পাঁচ টাকা ও কনক্রিট ব্রিকস ৮ টাকা করে বেড়েছে। ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে ফ্লোর ও ওয়াল টাইলসের দাম।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, গত ছয় মাসে প্রায় সব নির্মাণ উপাদানেরই দাম ২০-৩০ শতাংশ বেড়েছে। 'আমরা রড ও সিমেন্টের উৎপাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারাও অসহায়। তবে সরকারি নজরদারির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।'
তার সঙ্গে একমত পোষণ করে রিহ্যাব পরিচালক নাইমুল হাসান বলেন, 'এসব পরিচিত উপাদান ছাড়াও, একটি বাড়ি নির্মাণে আরো প্রায় ৩০০ রকম সামগ্রী প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে প্রায় ১০০ ধরনের সামগ্রীর দাম বেড়েছে।'
গৃহনির্মাণের সবচেয়ে সাধারণ উপাদান ইস্পাত ও সিমেন্ট। স্থানীয় বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা নিয়ে পণ্য দুটির উৎপাদকদের কাছে জানতে চাইলে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের বিপুল মূল্য বৃদ্ধিকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) এর হেড অব কমিউনিকেশন ত্বকি মোহাম্মদ জোবায়ের টিবিএসকে জানান, গত এক বছরে রড ও ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। যেমন- মাইল্ড স্টিল রড উৎপাদনের একটি প্রধান কাঁচামাল ফেরো-সিলিকনের দাম টনপ্রতি এক লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে তিন লাখ ৫২ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। অন্যদিকে, সিলিকো- ম্যাঙ্গানিজের দাম টনপ্রতি এক লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ফেরো-ম্যাঙ্গানিজের দাম টনপ্রতি এক লাখ ২৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে।
ইস্পাত শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কাঁচামাল স্ক্র্যাপ স্টিল স্থানীয় বাজারে প্রতিটন ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা একবছর আগের তুলনায় ২০ হাজার টাকা বেশি। ফলে ভোক্তা পর্যায়েও ইস্পাতের মূল্য বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
ইস্পাত প্রস্তুতকারক কেএসআরএম- এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার জাহান রাহাত জানান, মহামারির কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রের বিচ্ছিন্নতায় কাঁচামাল আমদানি বন্দরগুলোর পণ্য ও জাহাজ জটে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে সিমেন্টের ক্লিঙ্কার সহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম ও জাহাজে পরিবহন ভাড়াও টনপ্রতি ২০ ডলার করে বেড়েছে গত তিন মাসে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ জানান, বাংলাদেশের মাসিক সিমেন্ট চাহিদা ৪০ লাখ টন। সিমেন্ট ক্লিঙ্কার কয়লা থেকে তৈরি করা হয়। গত তিন মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামও প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল কেনা আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জাহাজে পণ্য পরিবহনের খরচও ৫০ শতাংশ বাড়ার কথা বলেছেন তিনি।
অতিরিক্ত খরচে বাধ্য হচ্ছেন ফ্ল্যাট ক্রেতারা:
স্নিগ্ধা হোমের আরেক ক্রেতা আরশাদুর রহমানকেও অতিরিক্ত ৬ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, 'ডেভেলপার কোম্পানির সাথে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে জটিলতা এড়াতে টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি।'
যোগাযোগ করা হলে, তামান্না প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বুলবুল আহমেদ অবশ্য বলেছেন, 'ফ্ল্যাট ক্রেতাদের সাথে আলাপ করেই অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে।'
রাজধানীর গুলশান-বারিধারা এলাকায় চার কোটি ৫৫ লাখ টাকায় ১৮শ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনার সময় একই বিড়ম্বনার শিকার হন ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ খোন্দকার।
আবাসিক ভবনটির ডেভেলপার কোম্পানি তার কাছে অতিরিক্ত ১৮ লাখ টাকা দাবি করে।
আবদুর রশিদ বলেন, 'কোম্পানির দাবি অনুসারে টাকা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ইতোমধ্যেই ১১ লাখ টাকা দিয়েছি।'
রশিদ ও শরিফুলের মতো আরও অনেক ক্রেতা বর্তমানে বুকিং দেওয়া ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
রিহ্যাবের তথ্যানুসারে, ঢাকায় বর্তমানে ৫০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণাধীন রয়েছে, এসব ফ্ল্যাটের মালিকদের এখন অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে।
আকার ও নির্মাণ উপকরণ প্রভেদে এসব ফ্ল্যাটের দাম এখন ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
নির্মাণ কাজেও অনিশ্চয়তা:
সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে সাধের বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ইউসুফ আলী সরদার। করোনায় বন্ধ হয় সাত তলা ভবনটির নির্মাণ কাজ। তার ওপর নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে চরম দুর্ভোগে পড়েন তিনি।
তিনি বলেন, 'আমার বাজেটের সব টাকা শেষ, কিন্তু এখনও অর্ধেক কাজ শেষ করতে পারিনি।'
গত কয়েক মাসে ইউসুফ আলীর মতো ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাতাদের পাশাপাশি বড় বড় ডেভেলপার কোম্পানিগুলোও বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান নাভানা রিয়েল এস্টেটের বর্তমানে ১৭টি প্রকল্পে দুই হাজারের বেশি অ্যাপাটমেন্টের কাজ চলমান। এরমধ্যে অধিকাংশই গত দুই বছরের মধ্যে কিস্তিতে বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দুই বছর আগের মূল্যের সঙ্গে খরচ সমন্বয়ে দাম বৃদ্ধির পথে হাটছে কোম্পানিটি।
নাম না প্রকাশের শর্তে নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আগে চুক্তি করা ফ্ল্যাটগুলোতে লোকসান দিয়ে কাজ সম্পন্ন করছে কোম্পানি।
রিহ্যাব পরিচালক নাইমুল হাসান বলেন, 'নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে বেকায়দায় পড়েছে হাউজিং ডেভেলপার ব্যবসায়ীরা। যেসব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে, সেগুলোর দাম নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির আগের হিসাবেই নির্ধারণ করা। কিন্তু, এখন দাম বাড়ার কারণে যে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, তা সমন্বয় করা যাচ্ছে না। ফলে কোম্পানিগুলো মুনাফা করতে প্রতিকুল অবস্থায় পড়েছে।'
তিনি বলেন, সরকারের একটি মনিটরিং সেল থাকা উচিত, যারা নির্মাণ সামগ্রীর অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি মনিটরিং করবে। সে অনুযায়ী বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে।
রড সিমেন্টের কাঁচামালের দাম বৈশ্বিক বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই এর দাম নিয়ন্ত্রণে দেশে শুল্ক-কর কমানো উচিত বলে মনে করছেন বাংলাদেশ সিমেন্ট বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) কো-চেয়ারম্যান এবং অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. শহীদুল্লাহ।
তিনি বলেন, 'প্রতিযোগী বাজার ব্যবস্থার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানই রড-সিমেন্টের অতিরিক্ত দাম রাখছে না। বৈশ্বিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত এসব খাতের কোম্পানি। এখন সরকারকে শুল্ক-ভ্যাট কমিয়ে এখাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।'