মন্দার সময়ে প্রবৃদ্ধি দেখছে দেশের রিয়েল এস্টেট খাত
গ্রাহকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে রাজধানীতে। তারপরও ঢাকায় 'বিক্রয়ের জন্য ফ্ল্যাট' সাইন দেখতে পাওয়া যেন বিরল ঘটনা, বিশেষ করে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে। এর পরিবর্তে সদ্যনির্মিত ফ্ল্যাটগুলোতে 'টু লেট' সাইনই বেশি ঝুলতে দেখা যায়।
এ পরিস্থিতি এমন কিছু 'গ্রে এরিয়াকে'ই নির্দেশ করে যেখানে ব্যক্তির উপার্জনকে লুকোনোর উপায় হিসেবে বিনিয়োগকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে।
অনেকে সন্দেহজনক পথে অর্জিত অর্থ রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করতে আইনি ফাঁকফোকর ব্যবহার করেন। ক্রয়মূল্য কম দেখিয়ে — প্রায়ই প্রকৃত লেনদেনকৃত মূল্যের এক চতুর্থাংশেরও কম দেখিয়ে — তারা সম্পত্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে সফলভাবে তাদের অর্থ পাচার করেন। এ স্কিমটি বোঝা যায় যখন কোনো নতুন রিয়েল এস্টেট প্রকল্প শুরুর পর কালোটাকার মালিকেরা দ্রুত সেখানে ফ্ল্যাট বুকিং দিতে শুরু করেন।
'তারা দর কষাকষি পর্যন্ত করেন না,' বলেন একটি বিশিষ্ট রিয়েল এস্টেট কোম্পানির একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা। তার প্রতিষ্ঠান গুলশান এলাকায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েক ডজন প্রকল্প সম্পন্ন করেছে।
দুদিন আগে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক জিডিপি উপাত্তে দেশে ফ্ল্যাটের ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিকটি উঠে এসেছে। রিয়েল এস্টেট খাত বিদায়ী অর্থবছরে ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে সেখানে। এ বৃদ্ধি গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরে উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য, পরিবহন এবং আর্থিক ও বীমা কার্যক্রমসহ অনেক খাত উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের তথ্যও রিয়েল এস্টেট খাতের এ প্রবণতার পক্ষেই ইঙ্গিত দিচ্ছে৷ চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে, যা আগের তিন বছরের ২১ হাজার কোটি টাকা, ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং ১১ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়েছে।
তবে প্রকৃত লেনদেনের মূল্য অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যানের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি বলেই বিশ্বাস করা হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চাহিদার ঊর্ধ্বগতি এবং তা টিকিয়ে রাখতে সন্দেহজনক এসব আর্থিক কূটকৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে: ঢাকার রিয়েল এস্টেটের উত্থান কেবল আবাসন চাহিদার কারণ নয় বরং ব্যাপক দুর্নীতিরও প্রতিফলন যা বাজারকে বিকৃত করে চলেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের বাইরে সম্পদ অর্জন করেন, যার একটি বড় অংশ রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ করা হয়।
'সরকার গত বাজেটে এ খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের বিধান বাতিল করলেও কালো টাকা বিনিয়োগের জন্য অলিখিত সুযোগ রেখেছে। এবং এই কালো টাকা বেশিরভাগই বিলাসবহুল আবাসন বা ব্যয়বহুল জমি কেনার জন্য বিনিয়োগ করা হয়,' বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, দ্রুত নগরায়নের কারণে আবাসন মার্কেটের আকারও বাড়ছে। এছাড়াও দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে, তার একটি বড় অংশই বিনিয়োগ করা হয় রিয়েল এস্টেট খাতে।
রিয়েল এস্টেট বাজারের আকার
আন্তর্জাতিক বাজার গবেষক সংস্থা স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইনসাইটস-এর তথ্যমতে, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট বাজার ২ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ২ দশমিক ০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের আবাসিক রিয়েল এস্টেট ব্যবসা বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৪ থেকে ২০২৮ সাল নাগাদ এ বাজার বার্ষিক ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ হারে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে ২০২৮ সালের মধ্যে দেশের রিয়েল এস্টেটের বাজার দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৫৩ ট্রিলিয়ন ডলারে।
এ খাতের অংশীদারদের মতে, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন, সাশ্রয়ী মূল্যের ও বিলাসবহুল উভয় ধরনের আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধি, কালো টাকা বিনিয়োগ এবং এ খাতে বিপুল রেমিট্যান্স বিনিয়োগের কারণে রিয়েল এস্টেট বাজারের আকার অবিশ্বাস্য হারে বাড়ছে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর মতে, দেশের রিয়েল এস্টেট খাতে জমি ক্রয়ে বিনিয়োগ, আবাসিক বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় এবং বাণিজ্যিক স্থান কেনার জন্য বিনিয়োগের মতো বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। এর প্রায় ৯০ শতাংশ আবাসিক বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ।
রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর দেশের আবাসন খাত গড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির দুই বছরে বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা কমেছিল।
তিনি বলেন, গত তিন বছরে আবারও এ খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের বিনিয়োগ হিসেব করে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের আবাসন খাতের প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইনসাইটস এটির গবেষণায় বলেছে, ২০২০ সালে রিয়েল এস্টেট বাজারের আকার ছিল ২.১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ২.২৮ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ২.৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩ সালে ২.৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার হয় এটি। আবাসিক রিয়েল এস্টেট এ বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৩–২৪ সালের বাজেটের আগে ফ্ল্যাট এবং প্লট কেনার উপর টোটাল গেইন ট্যাক্স এবং ফি ছিল ১০–১২.৫ শতাংশ, যা ২০২৩–২৪ সালের বাজেটে ১–২ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। তবে আবাসন খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা বলছেন, রিয়েল এস্টেট সম্পত্তির জন্য একটি ক্রমবর্ধমান চাহিদা রয়েছে, বিশেষ করে শহুরে এলাকায় এ চাহিদা বেশি। গ্রাহকেরা ক্রমশ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং স্কুল, হাসপাতাল ও শপিং সেন্টারের মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোতে সহজে আসা-যাওয়া করা যায় এমন সুবিধাসহ সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন খুঁজছেন।
এছাড়া গেটেড কমিউনিটি এবং হাই-রাইজ অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের প্রতিও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এসব আবাসন কমপ্লেক্স ব্যক্তিকে নিরাপত্তা এবং গোষ্ঠীগত জীবনযাপনের অনুভূতি দেয়।
রিহ্যাবের নির্বাহী কমিটির প্রাক্তন সদস্য নাইমুল হাসান টিবিএসকে বলেন, রিয়েল এস্টেট বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো উল্লম্ব জীবনযাত্রার জনপ্রিয়তা। শহুরে এলাকায় সীমিত জমির কারণে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য হাই-রাইজ ভবন নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করছেন ডেভেলপারেরা।
নাইমুল হাসান বলেন, আরেকটি প্রবণতা হলো মিশ্র-ব্যবহারের উপযোগী আবাসনের উত্থান, যেখানে আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং বিনোদনমূলক স্থানগুলো একই কমপ্লেক্সে থাকে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ দ্রুত নগরায়নের সম্মুখীন হচ্ছে, জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উন্নত চাকরির সুযোগ এবং উচ্চতর জীবনযাত্রার খোঁজে গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
'মানুষের এ প্রবাহ শহরাঞ্চলে আবাসন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের চাহিদা তৈরি করেছে, যা রিয়েল এস্টেট বাজারকে প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে,' নাইমুল বলেন।
তিনি আরও বলেন, 'ভিশন ২০২১' এবং 'ভিশন ২০৪১'-এর মতো সরকারি উদ্যোগগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের উপায় হিসেবে রিয়েল এস্টেট খাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
'এসব পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন প্রকল্প নির্মাণ এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা,' নাইমুল বলেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, রিয়েল এস্টেট খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকার বাজার অনুসন্ধানে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।