সুদের হার কমায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে রিয়েল এস্টেট
দেশের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর হাতে থাকা রেডি অ্যাপার্টমেন্ট প্রায় শেষ। অথচ কয়েক বছর আগেও এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছিল।
এ শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের জুলাই থেকে অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় এবং নিবন্ধন খরচ কমিয়ে আনায় ২০২০-এর দ্বিতীয়ার্ধের পর থেকে কোম্পানিগুলোর অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি বেড়ে গেছে।
এছাড়া ব্যাংক আমানত ও গৃহঋণের বিপরীতে সুদের পরিমাণ অল্প হওয়ার কারণেও অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা বেড়েছে। অনেকে এখন অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়ার চেয়ে কিনে নেওয়ার দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
বিক্রি হয়ে গেছে প্রায় সব রেডি ফ্ল্যাট
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রিয়েল এস্টেট সেক্টরে প্রায় সমস্ত রেডি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটের বুকিংও বেড়েছে।'
রিহ্যাবের সদস্য ১,০৩৭টি ডেভেলপার কোম্পানি। ২০১৯ সালে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট বার্ষিক বাজার ছিল ৫৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে সেই বাজারের আকার ১০ শতাংশ বেড়েছে।
সাম্প্রতিক বিক্রির তথ্য তেমন পাওয়া না গেলেও রিহ্যাব সভাপতি বলেন, এ বছর প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হওয়ার কথা।
ভালো বিনিয়োগ
লঙ্কাবাংলার ফাইন্যান্সের রিটেইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের প্রধান খোরশেদ আলম জানান, ব্যাংক আমানত থেকে যেহেতু তেমন মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে না এবং ভর্তুকিযুক্ত জাতীয় সঞ্চয়পত্রগুলোতেও বেশি অর্থ জমানোর উপায় নেই, তাই লোকে এখন অ্যাপার্টমেন্ট কেনাকে ভালো বিনিয়োগ হিসেবে দেখছে। এ বিনিয়োগ থেকে দ্বিগুণ লাভ পাওয়া যায়।
ইডিজিই এএমসি লিমিটেড ও ইডিজিই রিসার্চ অ্যান্ড কনসাল্টিং লিমিটেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা আসিফ খান বলেন, 'ঋণের হার যেহেতু উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে, তাই অনেকের কাছে বাড়ি কেনাটাই এখন বেশি সাশ্রয়ী। কারণ মাসিক কিস্তির পরিমাণ যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে নেমে এসেছে।'
২০১৯ সালের পর থেকে ব্যাংকিং শিল্পে আমানত ও ঋণ দুটোর হারই ৪০০-৫০০ বেসিস পয়েন্ট কমেছে। সঞ্চয়কারীরা এখন তাদের ব্যাংক আমানত থেকে বছরে ৪ শতাংশেরও কম সুদ পান। অন্যদিকে বর্তমানে ৭-৯ শতাংশ সুদেই গৃহঋণ পাওয়া যায়।
বাড়ছে চাহিদা
শীর্ষস্থানীয় লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড এখন প্রতি মাসে ৩৫-৩৭টি লাক্সারি ফ্ল্যাট বিক্রি করছে। মহামারির আগে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে ৩০-৩২টি ফ্ল্যাট বিক্রি করত। প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, বর্তমানে তাদের ৬০টিরও বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণাধীন রয়েছে।
শীর্ষস্থানীয় রিয়েল এস্টেট কোম্পানি কনকর্ড লিমিটেড ইতোমধ্যে তাদের সমস্ত রেডি ফ্ল্যাট বিক্রি করে এখন নতুন প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক আলম জানান, লকডাউনের সময় ছাড়া মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেও গড়পড়তা সময়ের চেয়ে বেশি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে তাদের।
নাভানা রিয়েল এস্টেটের ডেপুটি ম্যানেজার হাসিবুর রহমান জানিয়েছেন, এ বছর তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে। রাজধানীর আফতাবনগর, রামপুরা ও বারিধারা এলাকায় ফ্ল্যাটের বিক্রি মহামারিপূর্ব সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়েছে।
দীর্ঘ মন্দার পর বিক্রি এবং ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ায় হাসি ফুটেছে আবাসন ব্যবসায়ীদের মুখে। বিপুলসংখ্যক ক্রেতা ফ্ল্যাটের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
এ সময় গৃহঋণের জন্য আবেদনের সংখ্যাও বেড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঋণ বিতরণের পরিমাণও।
খোরশেদ জানান, ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় এ বছর গৃহঋণের জন্য কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি আবেদন পেয়েছে লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স। আবাসন খাতে ঋণদাতার সংখ্যা অনেক বেড়ে না গেলে লঙ্কাবাংলায় আবেদনের সংখ্যা আরও বেশি হতো বলে মনে করেন তিনি।
গৃহঋণ খাতে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে যাওয়ায় বন্ধকী ঋণ অনেক সুলভ হয়ে গেছে।
সিটি ব্যাংকের রিটেইল ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান মো. অরূপ হায়দার বলেন, ব্যাংকগুলোর গৃহঋণ বিতরণের পরিমাণ খুব একটা বাড়তে না-ও পারে। কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে একটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে গ্রাহকদের ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়। কিন্তু ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডাউন পেমেন্ট দিতে হয় মাত্র ১০ শতাংশ।
অবশ্য সিটি ব্যাংকের গৃহঋণ বিতরণের পরিমাণ গত জুনে চারগুণ বেড়েছে।
অরূপ হায়দার জানান, সিটি ব্যাংক প্রতি মাসে আবাসন ঋণ বিতরণের পরিমাণ মহামারিপূর্ব সময়ের তুলনায় প্রায় চারগুণ এবং ২০২২ সালে পাঁচগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সীমিত আয়ের মানুষ যেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে, সেজন্য তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকের জন্য অ্যাপার্টমেন্টের ডাউন পেমেন্ট ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার অনুরোধ জানান।
বেসরকারি খাতের বৃহত্তম আবাসন ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিবিএইচ) ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনে ১৪ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণ করেছে।
ডিবিএইচের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিমুল বাতেন জানান, তার প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৮০ শতাংশ অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতাদের কাছে যায়। বাকি ২০ শতাংশ ঋণ নেয় প্রাইভেট হোমবিল্ডাররা, যাদের বেশিরভাগই রাজধানীর বাইরের।
বাজারের অবস্থা
ফ্ল্যাটের দাম ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬-১৭ পর্যন্ত অবিক্রীত অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে ধুঁকছিল রিয়েল এস্টেট খাত।
২০০৭-২০১০ সময়কালে বহু মেয়াদি ঋণ ও সঞ্চয়কে স্পেকুলেটিভ ইনভেস্টমেন্টে পরিণত করার গুজব ওঠায় সে সময় বাংলাদেশে পুঁজিবাজার ও রিয়েল এস্টেটে সম্পদের পরিমাণ হুট করে বেড়ে গিয়েছিল।
মহামারিপূর্ব বছরে রিয়েল এস্টেটের দাম আবার ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। এ শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১৯-এর শেষ থেকে অ্যাপার্টমেন্টের দাম মাঝারিভাবে বাড়তে থাকে।
রিহ্যাব সভাপতি বলেন, অ্যাপার্টমেন্টের দাম এখন সংকটকালের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়েছে।
এ পর্যায়ে অ্যাপার্টমেন্টের দাম যথেষ্ট স্থিতিশীল আছে। কিন্তু মহামারিকালে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এবং নির্মাণকাজ ব্যাহত হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে অ্যাপার্টমেন্টের দাম আরও বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
রিহ্যাব সভাপতি বলেন, খরচ কমাতে না পারলে কোম্পানিগুলোকে তাদের নতুন প্রকল্পের জন্য অ্যাপার্টমেন্টের দাম বাড়াতে হতে পারে।
দ্বিতীয় অ্যাপার্টমেন্ট ও মূলধন লাভের দিকে ঝুঁকছেন অনেকে
এই মুহূর্তে কিছু সঞ্চয়কারী অ্যাপার্টমেন্টে বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভ করতে চাইছেন। লঙ্কাবাংলার খোরশেদ জানান, অ্যাপার্টমেন্ট ঋণের জন্য করা মোট আবেদনের ৫ শতাংশ দ্বিতীয় অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য। কয়েক বছর আগে দ্বিতীয় অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ১ শতাংশ আবেদনও পড়ত না।
অনেক পরিবার এখন ভাড়ার খরচ বাঁচানোর জন্য অথবা আয়ের জন্য ফ্ল্যাট কিনতে চায়। যদিও রিয়েল এস্টেট থেকে কেনা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়ে যে টাকা পাওয়া যায় তার পরিমাণ অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে খরচ করা টাকার চেয়ে অনেক কম।
খোরশেদ বলেন, অ্যাপার্টমেন্টকে এখন অনেকেই মূলধন লাভ হিসেবে দেখছেন।
নতুন রেডি ফ্ল্যাটের সাময়িক ঘাটতির জন্যই হোক অথবা অ্যাপার্টমেন্টকে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করার জন্য হোক, রিয়েল এস্টেটের একটি উদীয়মান সেকেন্ডারি মার্কেট সৃষ্টি হয়েছে। রিহ্যাব সভাপতি বলেন, সরকারের উচিত এই বাজারের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া।
ডিবিএইচের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লক্ষ করেছেন, তিন-চার বছর আগে প্রায় ৯৫ শতাংশ আবেদনই করা হতো নতুন ফ্ল্যাট কেনার জন্য। কিন্তু এখন ২০-২৫ শতাংশ আবেদন পড়ছে পুরনো ফ্ল্যাটের জন্য।
সহায়ক শিল্পের জন্য আশীর্বাদ
২০২০ সালে মহামারির আগে সিমেন্ট শিল্পের ব্যবসা গত দশকে দুই ডিজিট হারে বাড়ছিল।
ক্রাউন সিমেন্টের উপদেষ্টা মাসুদ খান বলেন, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে সিমেন্ট শিল্পের ব্যবসা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ কমে যায়। তবে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে স্থানীয় সিমেন্টের ব্যবসা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালে ছয় মাসে বিক্রির পরিমাণ মহামারিপূর্ব সময়ের প্রথম ছয় মাসের চেয়ে অনেক বেশি।
ইস্পাত নির্মাতাদের ব্যবসাও দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ শিল্পের ব্যবসা বেড়েছে আরও অনেক বেশি।
মাসুদ খান জানান, কোভিডের প্রথম লকডাউনের কারণে তাদের ব্যবসা যে ধাক্কা খেয়েছিল, ২০২০-এর দ্বিতীয়ার্ধে সেই ধাক্কা তারা খুব ভালোমতোই কাটিয়ে উঠেছেন।
তিনি বলেন, তাদের শিল্প সামগ্রীর ৪০ শতাংশ কেনে একক গৃহ নির্মাতারা।
মাসুদ খান আরও জানান, মূলত গ্রামাঞ্চল ও ছোট শহরের আবাসন নির্মাণের চাহিদার ওপর ভর করেই বড় হয়ে উঠেছে সিমেন্ট শিল্প। তবে লকডাউনের সময় খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় নির্মাণ সামগ্রী মূলত সরকারি প্রকল্প ও কর্পোরেট নির্মাণ প্রকল্পে বিক্রি হতো।
টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার বাজারের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান আরএকে সিরামিকসের বিক্রি ও লাভ গত পাঁচ বছরের গড়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অপারেটিং অফিসার ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা সাধন কুমার দে বলেন, গৃহ নির্মাণের চূড়ান্ত পর্যায়ে সিরামিক টাইলস, রান্নাঘর এবং স্যানিটারি সামগ্রী প্রয়োজন পড়ে। তাদের প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা থেকে বোঝা যায় যে, অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি ও গৃহ নির্মাণ বেড়েছে।
সাধন কুমার দে বলেন, তার কোম্পানি আশা করছে এ চাহিদা অব্যাহত থাকবে।