ঘাটতি পূরণে ভোলা থেকে জাহাজে করে গ্যাস আনার পরিকল্পনা
দেশের গ্যাস সংকট নিরসনের মরিয়া উদ্যোগ হিসেবে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে ভোলা গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস– জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
রোববার (২৩ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত 'শিল্পখাতে জ্বালানি সংকটের প্রভাব প্রশমন' শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন তিনি।
তবে ভোলা দ্বীপ থেকে জাতীয় গ্রিডে এই গ্যাস যুক্তের পরিকল্পনা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি পূরণে সামান্য অগ্রগতি করবে।
গ্যাসের এই সংকট দেশের বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে; যা শেষপর্যন্ত স্থানীয় বাজার ও রপ্তানির জন্য উৎপাদনকেও ব্যাহত করছে।
চাহিদা মেটাতে সরকারের প্রতি খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির অনুরোধ করছে গভীরভাবে প্রভাবিত শিল্পগুলো। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হলে, এমনকী বেশি মূল্য দিতেও তৈরি টেক্সটাইল খাত।
কিন্তু, জ্বালানি উপদেষ্টা এই পরামর্শকে সমর্থন করেননি। তিনি বলেন, 'আমরা যদি বর্তমান স্পট মার্কেট রেটে আগামী ছয় মাসের জন্য ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করি, তাহলে দীর্ঘমেয়াদী এলএনজি সরবরাহ মূল্যের থেকে প্রায় ১২০ কোটি ডলার বেশি খরচ হবে। কিন্তু, সরকার এ পরিমাণ বিনিয়োগ করার অবস্থানে নেই'।
বিকল্প সমাধান হিসেবে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ভোলা দ্বীপের অফ-গ্রিড ফিল্ডের গ্যাসকে কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) আকারে গ্যাস বিশেষ বার্জে পরিবহন করা হবে। মূল ভূখণ্ডে আনার পর সিএনজি পুনঃগ্যাসীকরণ করে স্থানীয় উৎপাদন হ্রাস এবং সীমিত এলএনজি আমদানির ফলে ব্যাপক ঘাটতির মধ্যে থাকা জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে।
তবে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি সংস্থা পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, এই মুহূর্তে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুবিধা দেশে নেই। গ্যাস রূপান্তরের জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে এবং ভোলা দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে গ্যাস পরিবহনের জন্য এই ধরনের বিশেষায়িত বার্জের দরকার হবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ' এই ধরনের প্রক্রিয়া রেডিমেড হলেও- তা বাস্তবায়নে কমপক্ষে সাত থেকে আট মাস সময় লাগে। কিন্তু, একেবারে নতুন করে গ্যাস কম্প্রেস করে জাহাজে পরিবহন করতে কমপক্ষে দেড় বছর সময় লাগবে'।
তিনি বলেন, বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিট গ্যাস সংকোচন সুবিধা দানকারী অবকাঠামোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে ভোলা থেকে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে নিয়ে যাওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক আবুল খায়ের মো. আমিনুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান যে, তার বিভাগ এখনও বিষয়টিতে জড়িত হয়নি।
ভোলা গ্যাসক্ষেত্রে সচল কূপগুলির দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ); সে তুলনায়, জেলায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা মাত্র ৬৫ মিলিয়ন ঘনফুট।
কিন্তু, ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি বর্তমানে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। এই সংকটের জরুরি সমাধান চেয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন বিনিয়োগকারীরা।
সংকট লাঘবে খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আংশিকভাবে এলএনজি আমদানি চাইছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো।
কারণ, সরবরাহ বাড়ানোর অন্যান্য বিকল্প এখন নির্ভর করছে– গ্যাসের নতুন মজুদ খুঁজে পাওয়া এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলিতে উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাবনার ওপর।
কারখানা মালিকরা গ্যাসের জন্য বেশি দাম দিতেও প্রস্তুত
আলোচনা সভায়, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্প মালিকরা বলেছেন, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান বাঁচাতে শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, 'স্পট বাজার থেকে এলএনজি ক্রয় বন্ধ হওয়ায়, আমরা প্রতিঘনমিটার গ্যাসের জন্য ১৬ টাকা করে দিচ্ছি'।
'তবে সরকার যদি স্পট মার্কেট থেকে প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিউ) ৩০ ডলার দরে কিনে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করে–তাহলে আমরা টিকে থাকার স্বার্থে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনতে ২২ থেকে ২৮ টাকা পর্যন্ত দিতে পারব'।
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন।
তিনি বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হলো শিল্পোৎপাদন। অথচ বাংলাদেশে শিল্প খাত বিকাশের জন্য দরকারি পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছে না।
'বর্তমানে, শিল্প খাতের গ্যাসের দৈনিক চাহিদা প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট, আর সরবরাহ ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে। যেসব শিল্পে ক্যাপটিভ জেনারেশন আছে, তারা এই ঘাটতির কারণে বিপুল লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে'- যোগ করেন তিনি।
জ্বালানি পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকারের কাছে তিনটি বিকল্প রয়েছে বলে ব্যাখ্যা করেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে গাজীপুর, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি, যার মধ্যে থাকবে ব্যবস্থাপনা। এতে করে এসব এলাকা জাতীয় গ্রিড থেকে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বেশি সরবরাহ পাবে। যা অন্যান্য খাতে দৈনিক মোট সরবরাহের ৫.৭ শতাংশ হবে।
প্রতি এমএমবিটিউ ৩০ ডলার দরে হলেও খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানির পরামর্শও দেন তিনি। এতে প্রতিমাসে অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৯০ থেকে ১৮০ মিলিয়ন ডলার।
একটি স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদী বিকল্প হিসাবে, তিনি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি এমএমবিটিউ এলএনজি ২০ ডলারের নিচে সংগ্রহের উৎস খোঁজার প্রতি তাগিদ দেন সরকারকে। একইসঙ্গে, দেশে গৃহস্থালী ও সিএনজি খাতে নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে গ্যাসের ব্যবহার কমানোর সুপারিশ করেন।
তবে ইজাজ হোসেনের সার উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমানোর পরামর্শের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। এতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আন্তর্জাতিক বাজার দরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, স্থানীয় পর্যায়ে জ্বালানির দাম যৌক্তিকীকরণের আহ্বান জানান।
উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান শিল্প মালিকদের
নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদনের স্বার্থে শিল্পগুলির জন্য পৃথক গ্যাস লাইন স্থাপনের প্রস্তাব দেন বাংলাদেশ চেমার্স অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
দেশের শিল্পগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানান জায়গায় গড়ে উঠেছে, এই ধ্যানধারণার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনেক শিল্প-ক্লাস্টার রয়েছে। সরাসরি গ্যাস সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে এসব এলাকাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
বিসিআই ও এফবিসিসিআই- এর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প-কারখানাগুলি তাদের নৈশকালীন শিফটে মেশিন চালাতে পারছে না।
'রাতের শিফট অলস থাকায় এসব কোম্পানি এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা ভাবছে। কারণ এতে তাদেরও বিপুল লোকসান হচ্ছে'।
এ কে আজাদ আরও বলেন, 'মহামারি চলাকালীন, আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৮ শতাংশ। কিন্তু, গত কয়েক মাসে, আমরা প্রায় ৭.৫% নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছি। এই অবস্থা যদি ছয় মাস বা এক বছর ধরে চলতে থাকে– তাহলে বেকারত্বের হার বাড়বে'।
'তবে রাতের বেলায় শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ মাত্র ৫ শতাংশ বাড়ালে ৫০ শতাংশ উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব, তখন আমাদের কর্মী ছাঁটাই করতে হবে না'- যোগ করেন তিনি।
কোনো শ্রমিক যেন চাকরি না হারায় অথবা কোনো কারখানা বন্ধ যেন বন্ধ না হয়ে যায়– এজন্য গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেন তিনি।
সভায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ বলেন, টেক্সটাইল খাত খুবই বাজে পরিস্থিতির মধ্যে আছে।
'এই খাতটি বন্ধ হলে, প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টিও ক্ষতির মধ্যে পড়বে। আমরা শুধুই টিকে থাকতে চাই'- বলেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি মো. আক্তার হোসেন অপূর্ব বলেন, গত কয়েক মাসে তাদের উৎপাদন ৪০-৬০% কমেছে।
'কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের অভাবে কিছু কোম্পানিকে বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কারখানা চালাতে গিয়ে ৫% অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে'।
আলোচনা সভায় অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় এবং ঢাকার মেট্রোপলিটন চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম-সহ প্রমুখ।
প্রয়োজনে দিনের বেলায় লোডশেডিং
তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকার দেশের কৃষি ও শিল্প খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
এজন্য প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধের মুখোমুখি হতে জনগণকে প্রস্তুত থাকতে বলেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য শুনে জ্বালানি উপদেষ্টা বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে– শিল্প খাতে সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানান।
'আমদানির সুযোগ যেহেতু কম, সেহেতু দেশের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হলে কাউকে না কাউকে ব্যবহার কমাতে হবে। বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ কমানো হলে লোডশেডিং বাড়বে। কিন্তু আমরা অঙ্ক করে দেখেছি, শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হলে সরবরাহ কমানোর খাত হিসেবে বিদ্যুৎ খাত হবে উত্তম জায়গা।'
সংকট সমাধানে সরকারের এসব পদক্ষেপ কতোটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা জ্বালানি উপদেষ্টাকে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেওয়ার অনুরোধ করেন।
জবাবে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, 'আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আমরা সরকার থেকে যা করার দরকার হয় করব, আপনারা সাহস হারাবেন না। যদি প্রয়োজন হয়, আমরা এখানে যারা আছি, তারা সবাই শপথ নেব; দরকার হলে আমরা দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করব না।'