ক্রমাগত কমছে ফ্রেইট চার্জ, লোকসানে শিপিং খাতের ব্যবসায়ীরা
করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন কমে যওয়ায় ক্রমাগত কমছে ফ্রেইট চার্জ (সমুদ্রপথে মাল পরিবহনের জাহাজ ভাড়া)। এতে লোকসানে পড়েছেন শিপিং খাতের ব্যবসায়ীরা।
২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে সমুদ্রপথে কন্টেইনার, খোলাপণ্যবাহী জাহাজ এবং লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহন কমেছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। কার্গো কমে যাওয়ায় অনেক জাহাজ ধারণক্ষমতার চেয়ে কম পণ্য পরিবহন করছে; ভাড়া না পেয়ে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে জাহাজ। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারণে সব ধরনের জাহাজ পরিচালনায় লোকসানে পড়েছেন মালিকরা।
এদিকে, ফ্রেইট চার্জ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপের বিভিন্ন রুটে সম্প্রতি চালু হওয়া সরাসরি জাহাজ সার্ভিস চালু রাখতে হিমশিম খাচ্ছে শিপিং কোম্পানিগুলো। চারটি রুটের মধ্যে গেল বছর মে মাসে শুরু হওয়া চট্টগ্রাম-যুক্তরাজ্য-নেদারল্যান্ডস রুটের শিপিং পরিষেবা চালু ছিল একই বছর অক্টোবর পর্যন্ত।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী ২৩টি জাহাজ পরিচালনাকারী কেএসআরেএম গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার ক্যাপ্টেন মো: দিদারুল আলম বলেন, ফ্রেইট চার্জ কমে যাওয়ায় এই মুহূর্তে শিপিং কোম্পানিগুলোর চাহিদা খুবই কম। এই অবস্থা চলতে থাকে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
সাইফ মেরিটাইম লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার মোঃ আবদুল্লাহ জহির টিবিএসকে বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় শিপিং কোম্পানিগুলো ক্রমাগত পরিবহন ভাড়া কমিয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে কোম্পানিগুলোর জাহাজের অপারেশন বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবেনা।
শিপিং সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কার্গো কমে যাওয়ায় ফ্রেইট চার্জ কমিয়ে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও কাঙ্খিত কার্গো পাওয়া যাচ্ছে।
ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে ইউরোপ আমেরিকা রুটে ফ্রেইট চার্জ অস্বাভাবিক হারে কমেছে। দুই বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া হয়ে ইউরোপে কন্টেইনার প্রতি ফ্রেইট চার্জ ছিল ১৪ থেকে ১৬ হাজার ডলার। এখন সেটি নেমে এসেছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ডলারে। আর মার্কিন রুটের ফ্রেইট চার্জ ১৬ হাজার ডলার থেকে ৩ হাজার ডলারে নেমে এসেছে।
শিপিং খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়ে পড়লে সমুদ্র পথে সরবরাহ চেইন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে; ফ্রেইট চার্জ পৌঁছায় যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক হওয়ার সাথে আবারও কমতে থাকে ফ্রেইট চার্জ। তবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেশকিছু পণ্য আমদানিতে কড়াকডি থাকায় কমেছে বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি। এর ফলে করোনাকালীন সময়ের তুলনায় বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাগামী জাহাজে ফ্রেইট চার্জ ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমেছে।
এ কারণে জাহাজ পরিচালনা ব্যয় তুলে আনতে হিমশিম খাচ্ছে শিপিং কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে, এশিয়া অঞ্চলে চলাচলরত জাহাজগুলোতে লোকসান গুনছেন জাহাজ মালিকরা।
বর্তমানে ফ্রেইট চার্জ করোনা শুরুর আগের পর্যায়ে পৌঁছালেও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ও অন্যান্য পরিচালন ব্যয় আগের তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে এখনো লোকসানেই রয়েছে শিপিং কোম্পানিগুলো।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র পথে মেঘনা গ্রুপ ১৯টি খোলা পণ্যবাহী (বাল্ক ক্যারিয়ার) জাহাজ পরিচালনা করছে। এরমধ্যে ১২টি চলাচল করছে এশিয়া অঞ্চলে, বাকি ৭টি কানাডা এবং আমেরিকা অঞ্চলে।
এশিয়া অঞ্চলে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার প্রতিটি জাহাজের দৈনিক ভাড়া ছিল ২০ হাজার মার্কিন ডলার। এখন সেই ভাড়া নেমে এসেছে ৪ থেকে ৫ হাজার ডলারে। এশীয় অঞ্চলে জাহাজ পরিচালনায় প্রতিদিন ব্যয় হয় নূন্যতম ৫ হাজার ডলার। সেই হিসেবে এ অঞ্চলে জাহাজ পরিচালনায় এখন গুনতে হচ্ছে লোকসান।
একইভাবে ভাড়া কমেছে কানাডা-আমেরিকা অঞ্চলেও। দুই বছর আগে এই অঞ্চলে জাহাজের দৈনিক ভাড়া ছিল ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার ডলার। এখন সেই ভাড়া নেমে এসেছে ২০ থেকে ৩০ হাজার ডলারে।
মেঘনা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মার্কেন্টইাল শিপিং-এর প্রধান প্রকৌশলী মো: আবু তাহের টিবিএসকে বলেন, "আমেরিকা অঞ্চলে লোকসান তুলনামুলক কম হলেও এশীয় অঞ্চলে লোকসান বেশি হচ্ছে। তবে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে চাইনিজ নিউ ইয়ারের ছুটি শেষ হওয়ার পর ফ্রেইট চার্জ বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে।"
বন্ধের পথে ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচল
দেশি-বিদেশি শিপিং কোম্পানির সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫-২০টি প্রধান বৈশ্বিক রুটের সাতটিতে সরাসরি শিপিং পরিষেবা চালু করে।
শিপিং খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে সরাসরি এই জাহাজ সার্ভিস চালু করা হয়। তবে মন্দার কারণে কমতে থাকা কার্গো ভলিউম এবং ফ্রেইট চার্জের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরে লন্ডনভিত্তিক ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অলসিজ গ্লোবাল লজিস্টিকস কোম্পানি গত অক্টোবরেই বন্ধ করে দিয়েছে তাদের সার্ভিস। ওই বছরের ২০ মে থেকে চট্টগ্রাম-লিভারপুল-রটারডাম রুটে সরাসরি ৩টি জাহাজ পরিচালনা সেবা চালু করেছিল কোম্পানিটি।
অলসিজ গ্লোবাল লজিস্টিকসের স্থানীয় প্রতিনিধি ফনিক্স শিপিং লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সৈয়দ সোহেল হাসনাত বলেন, "বর্তমানে আমদানি কার্গো প্রায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে। রপ্তানি কার্গো ভলিউম স্থিতিশীল থাকলেও ফ্রেইট চার্জ কম হওয়ায় আমরা চট্টগ্রাম-লিভারপুল-রটারডাম রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছি।"
তবে, চট্টগ্রাম-ইতালি-তুরস্ক এবং চট্টগ্রাম-নেদারল্যান্ডস-স্পেন রুটে শিপিং এখনও চালু রয়েছে।
কমে গেছে লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহন
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় লাইটার জাহাজগুলোতেও পণ্য পরিবহন কমেছে অন্তত ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে দৈনিক পণ্য খালাস করতো গড়ে ৮০ থেকে ১০০ টি লাইটার জাহাজ। এখন প্রতিদিন পণ্য খালাস করছে মাত্র ২০ থেকে ২৫টি জাহাজ।
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল হক টিবিএসকে বলেন, "আয় কমে যাওয়ায় নাবিকদের বেতন এবং অন্যান্য ব্যয় যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন জাহাজ মালিকরা। ফলে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।"
সারা দেশে প্রায় ৫ হাজার লাইটার জাহাজ চলাচল করে। প্রতিটি জাহাজে গড়ে কাজ করেন ১২ জন করে নাবিক। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে দেশের ৩৪ টি নৌরুটে চলাচল করে প্রায় ২ হাজার ৫০০টি লাইটার জাহাজ।