জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫-১০ টাকা কমানো উচিত: সিপিডি
জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫-১০ টাকা কমানোর জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌহিদুল ইসলাম খান বলেন, "এই মুহুর্তে সরকারের জ্বালানি তেলের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা কমিয়ে দেওয়া উচিত। এছাড়া আগাম কর প্রত্যাহার করা যেতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "মনোপলি বাজার কোনোভাবেই দক্ষ না। বিপিসিকে প্রতিযোগিতামূলক দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে হবে। জ্বালানি তেলে দাম কমানো হলে বিদ্যুতের দাম ও বাজেটের ভর্তুকি কমে আসবে। শুভঙ্করের ফাঁকি আছে ভর্তুকির হিসাবে।"
শনিবার সিপিডি আয়োজিত 'বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২২-২৩: তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা' শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
সিপিডি বলে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের অর্থনীতি সবচেয়ে সংকটময় সময় পার করছে। এরকম পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও ন্যায্য বন্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করায় সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
সামষ্টিক এবং আর্থিক কাঠামোর লক্ষ্যমাত্রা চলমান বাস্তবতা মাথায় রেখে নির্ধারণ করতে হবে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং সাধারণ জনগণের কথা মাথায় রেখে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। আইএমএফের শর্ত শাথায় রেখে জাতীয় স্বার্থ সামনে রেখে সংস্কার করতে হবে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, "বর্তমান অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে আগামী অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া ও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।"
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ও বহিঃখাতের চাপ নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য আইন সংস্কার করতে হবে। এ বিষয়ে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। অবৈধ উপায়ে দেশ থেকে অর্জিত টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এসব টাকা পাচার বন্ধ করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এজন্য কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ দরকার।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, "দেশের অর্থনীতি বাহ্যিক ও অর্থনৈতিক কঠিন কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে উর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি। সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটা এবং অন্তর্নিহিত কাঠামোগত দুর্বলতা, নীতি বাস্তবায়নে দুর্বলতা, সুশাসন ও সংস্কার উদ্যোগের ঘাটতি মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী।"
তিনি বলেন, "সামষ্টিক অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ কম। ফিসক্যাল স্পেস সংকুচিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য ঘাটতি, বহিঃঘাতে ভারসাম্যহীনতা, বৈদেশিক মুদ্রা কমছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে যাতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানো যায়। অর্থনীতি এই পরিস্থিতিতে এমন সময়ে পড়েছে যখন যখন দেশ এলডিসি উন্নয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এসডিজি লক্ষ্য অর্জনের চাপ রয়েছে। পাশাপাশি সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলে শর্ত পরিপালনের এখন হাই টাইম।"
তিনি বলেন, "চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। ৭৫ হাজার কোটি টাকা এনবিআরের ঘাটতি হবে। এনবিআরকে এখন নতুন নতুন উৎসের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ করতে হবে। কর ফাঁকি বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। যেসব কর সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে সেগুলো এখন তুলে দেওয়ার সময় এসেছে। এসব বিষয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ থাকা উচিত।"
সিপিডি বলেছে, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা অর্থনীতির সামগ্রিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় করতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হবে। হঠাৎ করে কোনো ভর্তুকি তুলে নিলে সমাজের সবার ওপর সমান হবে না। এটা বিবেচনা করতে হবে। কৃষির ভর্তুকি তুলে নিলে হবে না। এতে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।
রপ্তানি খাতে দেওয়া ভর্তুকি ধাপে ধাপে তুলে নিতে হবে। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বেশি। অনেকক্ষেত্রে অপচয় হয়। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ আরও যৌক্তিক হতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উৎস চিহ্নিত করা দরকার উল্লেখ করে সিপিডি জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক পণ্যের মূল্য নিম্নমুখী। যেসব পণ্য আমদানি করা নয়, সেগুলোরও দাম বাড়ছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সুযোগের ব্যবহার করছে। যার ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ। বাজারের কাঠামোগত সমস্যা দূর করতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকে সুদহার বাড়ানো দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে সুদহার নির্ধারিত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ কয়েকটি দেশ সুদহার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনেছে। আগামীতে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছে সিপিডি।
রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে সিপিডি বলেছে, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া একটা খারাপ দিক। যে পরিমাণ লোক প্রবাসে কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে, সেই পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে না। এজন্য সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি গভীরভাবে মনিটরিং ও পর্যালোচনা করা দরকার।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রশ্নের জবাবে বলেন, "বর্তমানে অর্থনীতিতে অভুতপূর্ব পরিস্থিতি। করোনার বছর বাদ দিয়ে গত এগারো বছরে সর্বনিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতি গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গত সাত বছরে সবচেয়ে কম। এরকম সময়ে চলতি অর্থবছর শেষ এবং নতুন অর্থবছর শুরু হচ্ছে। এ অবস্থায় বন্টনের ন্যায্যতা ও অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এই দুটোই হওয়া উচিত এবারের বাজেটের মূল দর্শন।"
তিনি বলেন, "বিনিময় হারে মার্কেট এলায়েন সিস্টেমে যেতে হবে। আগামী জুনে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আইএমএফের হিসাব পদ্ধতিতে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে। যার ওপর নির্ভর করবে নভেম্বরর কিস্তি ছাড় হবে কিনা। ফলে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা এখন মূল ইস্যু।"
গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট ব্যাষ্টিক অর্থনীতিকে আঘাত করছে।
তিনি বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থনৈতিক সংস্কার থাকতে হবে। নতুবা সংকট বাড়বে।
তিনি বলেন, "বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট সরকারকে বন্ধ করতে হবে। নতুন চুক্তিতে 'নো ইলেকট্রিসিটি নো পে' এই ধারায় যেতে হবে। যাদের সাথে এই চুক্তি আছে তাদের সাথেও করতে হবে।"