বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বাণিজ্য সংগঠন, এনজিও'র জন্য আরো করের প্রস্তাব
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পাসের জন্য উত্থাপন করা হয় খসড়া আয়কর আইন, ২০২৩। এতে কোম্পানির সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বাণিজ্য সংগঠন ও এনজিওকে কর্পোরেট করের আওতায় আনা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, নতুন সংজ্ঞা অনুসারে, সমবায় সমিতি, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাকেও কোম্পানি হিসেবে গণ্য করা হবে।
এসব প্রতিষ্ঠান বর্তমানে নিম্ন হারে কর দিচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে, নতুন করে সংজ্ঞায়িত কোম্পানিগুলোর আয় থাকলে ২৭.৫ শতাংশ কর দিতে হবে। অন্যদিকে কোনো প্রকার আয় না থাকলে ন্যূনতম কর হিসেবে শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ টার্নওভার কর দিতে হবে।
এছাড়া, এসব প্রতিষ্ঠানকে উৎসে ১০ শতাংশ কর কর্তন করতে হবে। নাহলে আইনভঙ্গের দায়ে ২০ শতাংশ হারে উৎস কর দিয়ে জরিমানা দিতে হবে।
খসড়া আইনে অবশ্য তিনটি পেশাজীবী সংগঠন – ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি), ইনস্টিটিউট অব কস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) এবং ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিয়েট বাংলাদেশ (আইসিএসবি) -কে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, জানায় এনবিআরের সূত্রগুলো।
পেশাদারী প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও, এই তিনটি সংগঠন তাদের সঞ্চয় এবং অন্যান্য আমানত থেকে আয়ের ওপর মাত্র ১০ শতাংশ কর দেবে। খসড়া আয়কর আইনের ষষ্ঠ তফসিল অনুসারে, তারা কর মওকুফের সুবিধাও পাবে।
বর্তমানে আয়কর সংবিধিবদ্ধ আদেশ, বিধিমালা (এসআরও) অনুসারে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো ব্যক্তি করদাতা পর্যায়ের হারে এই কর দেয়, যা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ।
সূত্রগুলো জানায়, স্থায়ী আমানত সুদহার (এফডিআর) থেকে প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই ভালো আয় হয়। প্রস্তাবিত আইন অনুসারে, আমানতের সুদ আয়ের উৎসে তাদের বিদ্যমান ১০ শতাংশের চেয়ে দ্বিগুণ বা ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
খসড়া আয়কর আইনে আরো বলা হয়েছে – লিয়াজোঁ অফিস, প্রতিনিধি অফিস, বা বিদেশী সংস্থার শাখা অফিস; কোনো বিদেশী সত্তা বা ব্যক্তির কোন স্থায়ী স্থাপনা; যে কোনো দেশের আইন দ্বারা বা তার অধীনে নিবন্ধিত এবং বাংলাদেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত কোনো সমিতি বা সংগঠন; ব্যাংক, বিমা, এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান; ফার্ম, ব্যক্তিদের সমিতি, যৌথ উদ্যোগ বা কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কোনো বিদেশী সত্তাকে কোম্পানি হিসেবে গণ্য করা হবে।
কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানিগুলোর লিয়াজোঁ অফিস থেকে কর আদায় করা হলে, সেটা হবে আইনটির সবচেয়ে বড় অর্জন।
তিনি জানান, বিদেশি কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিসকে বর্তমানে কোম্পানি হিসেবে গণ্য করা হলেও, তাদের অধিকাংশই পোশাক খাতের লিয়াজোঁ অফিসকে দেওয়া কর সুবিধাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে করজালের বাইরে থাকছে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ – সিটি করপোরেশন, রাজউক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষ - বর্তমানে ২৫ শতাংশ কর দিচ্ছে। নতুন আইনের অধীনে, কর্পোরেট করের হার অনুযায়ী এটি বেশি হবে, ব্যাখ্যা করেন স্নেহাশীষ।
সংসদে পাস হলে, আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন আইনটি কার্যকর করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
উৎসে কর কর্তন, আয়ের বিবরণী এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম-প্রত্যয়িত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন দাখিল করাসহ কোম্পানি করদাতাদের আইনের অনেক নিয়ম মেনে চলতে হয়, যা ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
বার্ষিক টার্নওভার ২ কোটি টাকার বেশি থাকা কোনো কোম্পানি বা ফার্মকে তাদের আয় বিবরণীর একটি কপি কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্মকে দিয়ে অডিট বা নিরীক্ষা করাতে হয়। সেই নিরীক্ষার সত্যায়িত আর্থিক প্রতিবেদন আয়কর রিটার্নের সাথে জমা দিতে হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, আলোচিত তিনটি চার্টার্ড পেশাদার প্রতিষ্ঠানকে তাদের স্থায়ী আমানত এবং সঞ্চয় থেকে আয়ের ওপর শুধুমাত্র ১০ শতাংশ উৎস কর দিতে হবে, সে তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একই ধরনের আয় থেকে ২০ শতাংশ উৎস কর দিতে হবে।
বাণিজ্য সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন যে, খসড়া আয়কর আইনটি প্রস্তুতের জন্য কিছু হিসাবরক্ষণ পেশাজীবীকে নিযুক্ত করেছিল এনবিআর। তাদের পরামর্শ অনুসারেই, এই তিনটি সংগঠনকে এসব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
এবিষয়ে সাবেক এনবিআর সদস্য (আয়কর নীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, "নতুন আইন সংক্ষেপে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। কিন্তু, এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা দরকার। প্রতিটি সংজ্ঞার অধ্যায়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকা দরকার। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক কোম্পানিকে গণ্য করাটা মোটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। একারণে তাদের কর হারও সমান হওয়া উচিত নয়।"
ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন…
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগামী রবিবার, আয়কর আইনের খসড়াটি বিশ্লেষণ করতে আমাদের নিজস্ব কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য সংগঠন এবং এনজিওকে কোম্পানি হিসেবে গণ্য করা সমর্থনযোগ্য হবে না।"
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার সামির সাত্তার বলেন, "শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির মতো বিবেচনা করা উচিত নয়। সরকারের উচিত যতটা সম্ভব সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করা।"
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে, আয়কর আইন ও কোম্পানি আইনে কোম্পানির সংজ্ঞা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা ছিল। এনবিআর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এসব সংজ্ঞায় পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়, যা খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান- রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাকও বলেন যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কোনো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়।
গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল 'আয়কর বিল ২০২৩' জাতীয় সংসদে তোলেন। পরে বিলটি পাঁচ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা হ্রাসসহ প্রস্তাবিত আইনে আরো কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, কিছুক্ষেত্রে কর হার বৃদ্ধির প্রস্তাবও আছে।
সংসদে পাস হলে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-কে প্রতিস্থাপন করবে নতুন আয়কর আইন।