বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে আমন বীজতলা, দুশ্চিন্তায় কৃষকেরা
প্রচণ্ড তাপদাহ আর বৃষ্টির অভাবে সংকটে এবারের আমন চাষ। আগে প্রাকৃতিকভাবে আমন ধান চাষাবাদ হতো বৃষ্টির পানিতে। কিন্তু এবার ভরা বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টির খোঁজ নেই।
এখন আমন চাষে পানির জন্য হাহাকার। বাধ্য হয়ে কৃষকরা ছুটছেন কৃত্রিম উপায়ে সেচের দিকে। অনেকে আবার আমন চাষাবাদ নিয়েই দোটানায় রয়েছেন।
বৃষ্টির অভাবে আউসের অবস্থাও একেবারেই খারাপ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার উত্তরের ১৬ জেলায়ই সেচ দিয়ে আমন চাষাবাদ করা হচ্ছে।
সেচের মাধ্যমে আমন চাষ করছেন বগুড়ার ধুনটের বেড়েরবাড়ি এলাকার কৃষক আবু সাঈদ। এই কৃষক বলেন, আমন আসলে বর্ষার পানিতে হয়। কিন্তু এবার ভরা মৌসুমেও সেই লক্ষণ নেই।
বগুড়া আঞ্চলিক কৃষি দপ্তর বলছে, পাঁচ বছর আগে বগুড়ায় আমন চাষ হয় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪৮ হেক্টর জমিতে। এবার সেখানে চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। পাঁচ বছরে সিরাজগঞ্জে আমন চাষের পরিমাণ ৮ হাজার ১১৩ হেক্টর বেড়ে ৭৪ হাজার ৭০০ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে জয়পুরহাটে ৬ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে কমে ৬৯ হাজার ৬৫০ হেক্টরে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে পাবনায় ৯ হেক্টর জমি বেড়ে এখন ৫৫ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লক্ষ ৯৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাঁচ বছর আগে জেলায় ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৫০৫ হেক্টরে আমনের চাষাবাদ হয়।
আমন ধানে চাষাবাদ সাধারণত জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়। চলে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এবার উত্তরের অনেক কৃষক এখনো পানির অভাবে জমিই তৈরি করতে পারেন নি।
নওগাঁ সদরের তিলকপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের কৃষক আরিফুল ইসলাম জানান, এবার দুই বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করবেন। আষাঢ় মাসের শুরু থেকেই বীজতলাও প্রস্তুত। তবে বৃষ্টিপাত না থাকায় এখনো ধান রোপণ করা সম্ভব হয়নি। আশেপাশের ডোবা-নালার পানিও শুকিয়ে গেছে। তীব্র তাপদাহে বীজতলা এখন নষ্টের পথে। বাধ্য হয়ে সেচের মাধ্যমে ধান রোপণের উদ্যোগ নেওয়ার হয়েছে। সেচের জন্য বিঘাপ্রতি ১ হাজার টাকা দিতে হবে। এই খরচ অতিরিক্ত। আগে কখনো ছিল না।
একই উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের বাঁচাড়ীগ্রামের কৃষক আহসান হাবীব বলেন, "এমনিতেই তীব্র গরমের কারণে শ্রমিকদের কাজে ধীরগতি। জমিতে হাল, সেচ খরচ ও শ্রমিক খরচ বেশি পড়ছে। বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা না করে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই ৭ বিঘা জমিতে আমন ধান রোপণ করেছি। যেখানে ২০ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৭ হাজার টাকা খরচ গুনতে হয়েছে।"
এবার আমন চাষে বাড়তি খরচের হিসাব বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যেও মিলেছে। জেলায় আমনের জন্য মোট ১০ হাজার ৯৬৯টি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ডিজেলচালিত ৮ হাজার ৬২টি। প্রতি ঘণ্টায় একটি মেশিনে ডিজেল লাগে দেড় লিটার। আমনের জন্য গড়ে দিনে তিন ঘণ্টা করে মেশিন চালাতে হবে। এই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন একটি মেশিনে ডিজেল লাগবে ৫ লিটার। আমনের মৌসুমে ৯০ দিন মেশিন চালাতে ডিজেল প্রয়োজন হবে ৩৬ লাখ ৪১ হাজার ৪০০ লিটারের। প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১০৯ টাকা হলে শুধুমাত্র এ খাতে বগুড়ায় খরচ হবে অন্তত ৩৯ কোটি ৬৯ লাখ ১২ হাজার ৬০০ টাকা।
আট বিঘা জমিতে এবার আমন চাষ করছেন জানিয়ে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ছাতিনগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক জিল্লুর রহমান মামুন বলেন, "চলতি বছরে পানি সরবরাহকারীদের প্রতি বিঘার জন্য ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দিতে হবে। এটি নতুন খরচ, আগে কখনো ছিল না এমন। পানির কারণে ধান রোপণেও দেরি হচ্ছে।"
আমন চাষে পানির সংকটে রয়েছেন আদমদীঘির সান্তাহার ইউনিয়নের কৃষক আমিনুল ইসলাম সোহাগও। ৪০ বিঘা জমিতে তিনি আমন চাষ করবেন। সোহাগ জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষকরা বিদ্যুতের মাধ্যমেও সেচ দিতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সরকারের উচিত কৃষি বাঁচাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা। বৃষ্টির আশায় বসে থেকে আর লাভ নেই।
বগুড়া জেলা আবহাওয়া দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমনের মৌসুমের আগে বিশেষ করে ২০১৯ সালে জুন-জুলাই মাসে জেলায় বৃষ্টিপাত হয় ৭৫৮ মিলিমিটার। ২০২৩ সালে জুন-জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৭৫ মিলিমিটার। অথচ এই দুই মাসে বগুড়ায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার দরকার ৭৫০ মিলিমিটার। অর্থাৎ এবার স্বাভাবিকের চেয়ে জুন-জুলাইয়ে ৪৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত কম হয়েছে।
এই অঞ্চলে গাছপালা কম; পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল, বিল কমে যাওয়া, বায়ুদূষণের কারণে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে বলে জানালেন বগুড়া জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারি আবহওয়াবিদ আব্দুল হান্নান।
বগুড়া আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সরকার শফি উদ্দিন আহমদ বলেন, বগুড়া অঞ্চলের চার জেলায় পৌনে চার লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদ হয়। বেশি বন্যা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণসহ আরও অনেক কিছুর কারণে আমন চাষ কমতে-বাড়তে পারে। তবে বৃষ্টি কম হলে রোগবালাই কম হবে। আমন চাষের জন্য জেলায় বগুড়া অঞ্চলে ৩০ হাজার সেচযন্ত্র মাঠে আছে। এখন আমন চাষে সেচের বিকল্প নেই।
দেশের মধ্যে রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি আমন ধানের চাষাবাদ হয়। এবার চাষ হচ্ছে ৬ লাখ ১৪ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে। গত পাঁচ বছরে ধানের চাষাবাদও বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আফতাব হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে কৃষকদের সেচের মাধ্যমে আমন চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। রংপুর বিভাগে আমনের জন্য ৫০ হাজার সেচযন্ত্র চালু আছে। এর মধ্যে অর্ধেক ডিজেলচালিত। তবে সামনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ভালো, বৃষ্টিপাত হতে পারে।
এর মধ্যে বৃষ্টিপাত না হলে পুরো মৌসুমজুড়ে রংপুরে ডিজেল চালিত সেচযন্ত্র চালু থাকলে অন্তত ১২২ কোটি টাকার উপরে খরচ হবে।
এদিকে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলেও অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে যাচ্ছে আমন বীজতলা।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার উত্তর চর লরেঞ্চ গ্রামের বাদশা মিয়া জানান, তিনি ৬০ শতক জমিতে ব্রি-৫২ জাতের ৬০ কেজি ধানের বীজতলা বসিয়েছেন। চারাও ভালো গজিয়েছে। এখন জমিতে রোপণের সময়। কিন্ত বৃষ্টি না থাকার কারণে বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার বীজতলার চারপাশে কোথাও পানি নেই। বাদশা মিয়ার বীজতলার প্রায় ২৫ ভাগ চারাগাছ পুড়ে গেছে।
তিনি জানান, আবার ধান কিনে বীজ বসানোর মতো সময় এবং অর্থ নেই তার কাছে।
জেলার লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা, রায়পুর, রামগতি এবং কমলনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পানি না থাকায় বেশিরভাগ জমি অনাবাদি হিসেবে পড়ে আছে। বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকদের আমন বীজতলাগুলো প্রখর রোদে হলুদ বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। এসব বীজতলায় চারা রোপণ করলে পর্যাপ্ত ফলন নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
লক্ষ্মীপুর জেলার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন জানান, জেলাব্যাপী এ বছর বৃষ্টির কারণে আমন উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে কৃষকরা। তিনি জানান, "পরিস্থিতি আরো কয়েক দিন পর্যবেক্ষণ করে কৃষি বিভাগের পক্ষে সেচ যন্ত্রগুলো চালুকরণের বিষয়ে আমরা বিএডিসিকে জানাবো। অন্যদিকে খরায় করণীয় বিষয়ে আমরা কৃষকদের জন্য নানা পরামর্শ দেওয়া শুরু করেছি।"