সেপ্টেম্বরে ইমপোর্ট ট্যাক্স প্রবৃদ্ধি মাত্র ৫%, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ২,৫০০ কোটি টাকা
ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের প্রভাব পড়েছে ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায়ে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায়ে ঘাটতি প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৫ শতাংশে।
ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ'র হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ আলোচ্য সময়ে লক্ষ্যমাত্রার এক চতুর্থাংশ ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায় করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া অর্থবছরের তিন মাসে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭.৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগিরই ডলার সংকট কমে আসার সম্ভাবনা কম, এর ফলে আমদানি পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেক্ষেত্রে ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায়ের বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনাও কম।
অবশ্য ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায় কমলেও একই সময়ে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) ও ইনকাম ট্যাক্স আদায় হয়েছে সন্তোষজনক, যা আলোচ্য সময়ে যথাক্রমে ১৭% ও ১৯%।
এনবিআরের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) আমদানি কর প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩.৭%।
গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে গেলে ডলার সংকট শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে বেশকিছু পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণে শুল্ক বাড়িয়ে দেয় সরকার। অন্যদিকে শতভাগ মার্জিন পরিশোধের পর লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) ওপেন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এসবের পরও কনজ্যুমেবল পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের আমদানিতে প্রয়োজনমত ডলার পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে ডলার সংকটের কারণে লোকাল কারেন্সি টাকা ইউএস ডলারের বিপরীতে দেড় বছরে দর হারিয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ফলে অনেক আমদানিকারকও আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানেও এমন তথ্যের সত্যতা মিলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে কনজ্যুমার পণ্য আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।
এনবিআরের সাবেক সদস্য (শুল্ক নীতিমালা) মো. লুৎফর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডলার সংকটের কারণে সবাই এলসি খুলতে পারছে না। আবার ডলারের দামও বেড়েছে। এ কারণে আমদানি কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায়ে।"
"এই সমস্যা হয়তো মিটবে কিন্তু কবে ঠিক হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না," বলেন তিনি।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ১০,৪৬৪ কোটি টাকা ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার কম।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত পূরণ করতে চলতি অর্থবছর যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তা সম্প্রতি কমিয়ে আনার বিষয়ে সম্মত হয়েছে ঢাকা সফররত আইএমএফ দল। তবে কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট মনে করছে, বিদ্যমান আমদানিতে গতি না আসলে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি জানতে বৈঠক করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম। সভায় ভ্যাট আদায়ে গতি থাকলেও ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায় কম হওয়ার কারণ জানতে চান এনবিআর চেয়ারম্যান।
মিটিংয়ে উপস্থিত এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আমদানি কম হওয়ার কারণে ইমপোর্ট ট্যাক্স আদায় কম হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এর কাছে এনবিআরের বিপুল পরিমাণ ইমপোর্ট ট্যাক্স বকেয়া আছে। ওই অর্থ আদায়ের উপায় নিয়েও সভায় আলোচনা হয়েছে।"
ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্সে ভর করে তিন মাসে রাজস্বে প্রবৃদ্ধি ১৪%, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ৮২০০ কোটি টাকা
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ইমপোর্ট ট্যাক্স, ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) ও ইনকাম ট্যাক্স মিলিয়ে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্তোষজনক বলে মনে করছেন ট্যাক্স সংশ্লিষ্টরা।
ইমপোর্ট ট্যাক্স কমা সত্বেও এই প্রবৃদ্ধির পেছনে ভুমিকা রেখেছে ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স। আলোচ্য সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৭৬,৭৩৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯,৬০০ হাজার কোটি টাকা বেশি।
অবশ্য ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সত্বেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৮,২০০ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাট থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে রাজস্ব আদায় হয়েছে।
চলতি অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অতটা সহজ হবে না। গতবারের (৩৭০০০ কোটি টাকা) যে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো, তা অর্জন করাও কঠিন হবে।"