ব্যাংক অফশোর ইউনিটগুলোতে তহবিল পরিচালনা করতে পারবে না
দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে ফান্ড সাপোর্ট বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই ইউনিটে থাকা ব্যাংকগুলোর পুরো ফান্ড সম্পূর্ণরূপে সমন্বয় করতে বলা হয়েছে।
এর আগে ব্যাংকগুলোর তার অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে রেগুলেটরি মূলধনের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ফান্ড স্থানান্তরের সুযোগ ছিল। নতুন এ নীতিমালার ফলে অফশোর ইউনিট ডমেস্টিক ব্যাংকগুলো থেকে কোনো ধরনের ফান্ড সুবিধা পাবে না। অর্থাৎ তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একমাত্র বৈদেশিক উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে।
মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার ইস্যু করে সকল তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর পাঠিয়েছে।
ব্যাংকাররা বলেন, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের প্রায় পুরো ফান্ড শর্ট টার্ম লোন হিসেবে ইনভেস্টমেন্ট করা। এছাড়া নতুন এই নীতিমালায় অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দেবে। ফলে আমাদের ইম্পোর্ট ফাইন্যান্সিং ও বিল ডিসকাউন্টিংয়ে প্রভাব পড়তে পারে।
তারা আরো বলেন, ব্যাংকগুলোর অফশোর ইউনিট নিজস্ব উৎস থেকে ফান্ড সুবিধা না পেলে সাময়িক সংকট দেখা দিতে পারে। যদিও তারা বিদেশি উৎস থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে সংকট কাটাতে পারলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ফ্লো আরও বাড়বে।
অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের অভ্যন্তরে পৃথক এক ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান এবং বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। এখানে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয়। বাংলাদেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর কোনো নিয়ম-নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ে প্রয়োগ হয় না। শুধু মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ৩৫টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত।
বর্তমানে ব্যাংকগুলোর অফশোর ইউনিটে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলারের মতো ব্যাংকগুলোর ফান্ড রয়েছে। অফশোর ইউনিটের ফান্ড সমন্বয় হলে ব্যাংকগুলোর ডমেস্টিক ডলার তারল্যের ফ্লো আরও বাড়বে। যদিও ব্যাংকাররা বলেছেন, এই ফান্ডের বেশিরভাগই বিনিয়োগ করা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যাংকগুলো অফশোর ইউনিটে রেগুলেটরি ক্যাপিটেলের ২০ শতাংম পর্যন্ত মূলধন যোগান দিতে পারত। কোভিডের সময়ে এটা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়।
সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমা বাড়ালেও কিছু কিছু ব্যাংক ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ফান্ড যোগান দিয়ে দেয়। বিষয়টি নজরে এলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলা হয়।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী টিবিএসকে বলেন, 'অফশোর ইউনিট ফান্ড দেশের ব্যাংকিং রেগুলেশনের সম্পূর্ণ আলাদা একটি উৎস। বলা যেতে পারে দেশের অভ্যন্তরে বৈদেশিক ব্যাংক। এতদিন ডমেস্টিক ব্যাংকগুলো ফান্ড সাপোর্ট দিতে পারত। নতুন সার্কুলারে কোনো তহবিলের সুযোগ নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে যেসব ব্যাংকের ফান্ড রয়েছে তারা এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে হবে।'
বর্তমানে অফশোর ইউনিটের বেশিরভাগ ফান্ড বিনিয়োগ করা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'ব্যাংকগুলোর অফশোর ইউনিট শর্ট টার্মে বিনিয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ অফশোর ইউনিটের বিনিয়োগ করা ফান্ড ফেরত এলে তারা ডমেস্টিকে সমন্বয় করে নিতে পারবে।'
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে জানান, কয়েকটি ব্যাংকের অনিয়মের ফলে পুরো ব্যাংকখাতের জন্য নতুন একটি নীতিমালা করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট দুর্বল হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, 'আমরা এই ফান্ড থেকে ইম্পোর্ট ফাইন্যন্সিং, বিল ডিসকাইন্টিং করতে পারতাম। এখন এ উৎসের যোগান কমে আসলে আমাদের দেশের ইম্পোর্ট ফাইন্যন্সিং আরও ব্যহত হতে পারে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল অফশোর ইউনিটে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সীমা বাড়ানো। ২০২২ অর্থবছরে আমাদের আমদানির পরিমাণ ব্যাপক বেড়ে যায়। তখন ব্যাংকগুলো অফশোর ইউনিট থেকে ব্যাপক পরিমাণ শর্ট টার্ম একবছর মেয়াদি লোন হিসেবে বিনিয়োগ করে। অর্থাৎ (বায়ার্স ক্রেডিট ও সাপ্লায়ার ক্রেডিট) বিনিয়োগ করে। যদিও সেই বিনিয়োগের এখনো ব্যাংকগুলো ফিরে পেতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, 'বর্তমানে প্রায় ছয় থেকে আটটি ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে ডিফল্টার অবস্থায় রয়েছে। যার কারণে তারা নতুন ফান্ড কম পাচ্ছে। এছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধি ও ডলার সংকটে ব্যবসায়ীরা তাদের অফশোর ইউনিটের দায় পরিশোধ করতে পারছে না।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২২ সালে ব্যবসায়ীরা শর্ট টার্ম বৈদেশিক লোনের বায়ার্স ক্রেডিটে ৯.৫৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ সুবিধা পেয়েছে। যদিও গত বছরের নভেম্বরের শেষে এই ঋণের বাকির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৪৭ বিলিয়ন ডলার।