১২ বিলিয়ন ডলার অমিলের কারণ স্থানীয় বিক্রয়কে রপ্তানি হিসেবে গণনা, ডলারের হারের পার্থক্য
গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও প্রকৃত চালানের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলারের অমিলের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে অন্তত পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)।
নিয়ম অনুযায়ী, রপ্তানি অঞ্চলে অবস্থিত কারখানাগুলো বন্ডেড গুদাম সুবিধাসহ অন্যদের কাছে কাঁচামাল হিসেবে পণ্য বিক্রি করতে পারে। আর এই জাতীয় লেনদেনগুলো রপ্তানি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইপিবি যেসব কারণ চিহ্নিত করেছে সেগুলো হলো- বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (বেপজা) কর্তৃক দেশের অভ্যন্তরে পণ্য বিক্রিকে রপ্তানি হিসেবে দেখানো, সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলারের রেটের হেরফের, শর্ট শিপমেন্ট, ক্রেতা কর্তৃক আরোপিত ছাড়, বৈদেশিক ব্যাংকের চার্জ ও ফেরত আনা পণ্যকে রপ্তানির অংশ থেকে বাদ না দেওয়া।
ব্যাংকের এলসিতে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা উল্লেখ থাকে, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে কম রপ্তানি হওয়াকে বলা হয় শর্ট শিপমেন্ট।
এছাড়াও কাস্টমসের ডাটাবেজে রপ্তানি পণ্য তালিকাভুক্ত হওয়ার পর সেটি রপ্তানি না হলে বাদ না দেওয়া, পণ্যগুলোকে দু'বার গণনা করা ও রপ্তানি হিসাবের মধ্যে বিনামূল্যে বায়ার কর্তৃক পাঠানো কাঁচামালের অন্তর্ভুক্তিও রপ্তানি ডেটার এই অমিলের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইপিবির সূত্র জানিয়েছে, এ কারণগুলো চিহ্নিত করে ইতোমধ্যেই তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। এর ভিত্তিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা প্রকাশ করবে।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রপ্তানি আয় দেশে প্রত্যাবাসন না করা প্রসঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে, আমরা তার কিছু কারণ চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।'
তিনি বলেন, 'এসব হিসাব আমলে নেওয়া হলে এই বিশাল গ্যাপ অনেকাংশেই কমে যাবে বলে আমরা মনে করছি।'
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রহিম খান বলেন, তিন মাস আগে রপ্তানি ও রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন নিয়ে বিস্তর অমিলের কারণ খুঁজে বের করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গত রবিবার (২১ জানুয়ারি) ইপিবির প্রতিবেদন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, 'চলতি সপ্তাহের মধ্যে আমাদের কমিটির কাজ সম্পন্ন করতে পারব।'
ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য ও সেবা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৩ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আলোচ্য অর্থবছরের এক্সপোর্ট প্রসিড এসেছে ৫০.৯৭ বিলিয়ন ডলার।
বিশাল এই পার্থক্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ মনে করছেন, এর বড় অংশই রপ্তানিকারকরা ইচ্ছা করে দেশে আনছেন না বা পাচার করেছেন। বিশেষত ক্রমাগত ডলারের দর বাড়তে থাকায় কেউ কেউ স্থানীয় মুদ্রায় বাড়তি দর পাওয়ার আশায় দেরি করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষ করে দেশে যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট চলছে, তখন এত বড় পরিমাণ রপ্তানি আয় দেশে না আসা রিজার্ভ সংকট কমানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবেও দেখছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৮ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট রিজার্ভের পরিমাণ (আইএমএফ এর মানদণ্ড অনুযায়ী যা বিপিএমএ৬ হিসেবে পরিচিত) ২০ বিলিয়ন ডলার। অথচ এক বছর আগে এই রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৪ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক্সপোর্ট প্রসিডের বিশাল পার্থক্য থাকার কারণ খুঁজতে রপ্তানিকারকদের সঙ্গে গত ২০ ডিসেম্বর সভা করেছে ইপিবি। সভায় রপ্তানিকারকরা প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে ইপিবি, ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।
রপ্তানিকারকরা ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রায় বাড়তি দর পাওয়ার আশায় এক্সপোর্ট প্রসিড দেরিতে আনছেন কি না- এমন প্রশ্নে ইপিবির সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এমন অভিযোগের যথার্থতা খুঁজে পাইনি।'
তিনি বলেন, 'রপ্তানির এলসিতেই (লেটার অব ক্রেডিট) কতদিনের মধ্যে এক্সপোর্ট প্রসিড আনতে হবে, তা লেখা থাকে। ওই সময়সীমা পেরিয়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক সহজেই দেখতে পারে কাদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে।'
এছাড়া রপ্তানির নামে অর্থপাচারের কারণে এমন পার্থক্য তৈরি হওয়া সংক্রান্ত অভিযোগের সঙ্গেও একমত প্রকাশ করেননি তিনি।
তিনি বলেন, 'কেউ যদি অর্থপাচার করতে চায় চায় তাহলে আন্ডার ইনভয়েসে রপ্তানি করবে। ওই হিসাব তো রপ্তানির মধ্যেই যুক্ত হওয়ার কথা নয়।'
আর এ কারণে হিসাবে পার্থক্য হওয়ার কথা নয় বলেও জানান তিনি।
দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি মুনির হোসেন বলেন, 'এক্সপোর্ট প্রসিড গ্যাপের জন্য ঢালাওভাবে রপ্তানিকারকদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে, যা ঠিক নয়। আমরা ইপিবিকে বলেছি, যাতে সঠিক কারণ অনুসন্ধান করে তা প্রকাশ করা হয়।'
তিনি বলেন, 'সেখানে যদি রপ্তানিকারকের দায় থাকে, তাও প্রকাশ করা হোক।'
তিনি জানান, এই অমিলের বড় কারণ হলো ইপিজেডের অভ্যন্তর থেকে বাইরের কারখানায় বিক্রি করা পণ্য দেশের মধ্যে পেমেন্ট হয়, কিন্তু তা রপ্তানি হিসেবে কাউন্ট হয়। এর পরিমাণ পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মতো হতে পারে।
অবশ্য ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ১.৭ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে এর বাইরে অন্যান্য কারণে কী পরিমাণ গ্যাপ তৈরি হচ্ছে, সেই হিসাব এখনো করা হয়নি বলে জানায় ইপিবির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।