কারসাজি করে ৩,১১৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ গোপন করেছে কৃষি ব্যাংক
দেশের কৃষিখাতের সবচেয়ে বেশি অর্থায়নকারী বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বিরুদ্ধে কারসাজির মাধ্যমে ৩,১১৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ গোপন করাসহ বেশ কিছু অনিয়মের তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ।
কৃষি ব্যাংকের ২০২৩ এর জুন-ভিত্তিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমন অনিয়মের তথ্যগুলো পাওয়া গেছে। কৃষি ব্যাংক মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখিয়েছে ৩ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। কিন্তু, পরিদর্শনে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে তা ৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে প্রকাশ খেলাপি ঋণের পরিমাণ গোপন করে, সরকারের মালিকানাধীন ব্যাংকটি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রভিশনিং এড়িয়ে গেছে, যা তাদের আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়, কৃষি ব্যাংক আর্থিক বিবরণী প্রণয়ণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেনি। বিবরণীতে অনেক ক্ষেত্রে ভুল, অসত্য, আংশিক তথ্য প্রদান করা হয়েছে বা অনেক ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ইচ্ছেকৃতভাবে তথ্য গোপন করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে, ব্যাপকভাবে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানো এবং খারাপ ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে স্বচ্ছতার অভাবের মতোন কৃষি ব্যাংকের অভ্যন্তরে নানান অনিয়মের বিষয় উঠে এসেছে।
এসব বিষয়ে কৃষি ব্যাংকের মৌখিক ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে এবার লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু, তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী জানান, এমডি এব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না।
বরং এবিষয়ে কৃষি ব্যাংকের বিবৃতি নিতে ব্যাংকের গণসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) জামিল আহমেদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে জামিল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ২০২২ এর সেপ্টেম্বরের পুনঃতফসিল নীতিমালা অনুযায়ী অনেক খেলাপি ঋণ রেগুলোর (পুনঃশ্রেণিকৃত) হয়েছে। যদিও এগুলো আমাদের অনলাইন রিপোর্টে আসেনি। ফলে পরিদর্শনের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি আবিষ্কার করেন।"
তিনি বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে জানতে চাওয়ায় আমাদের একটি টিম বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়নি। আমাদের কাছে পুনরায় জানতে চেয়েছেন। আমরা খুব শিগগিরই জবাব দিব।"
নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আমাদের পরিদর্শন টিম তাদের ঋণ, প্রভিশনিং ও খেলাপি ঋণে বেশকিছু বড় ধরনের গড়মিল পেয়েছে। তারা (কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তারা) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসে খুবই অযোক্তিক কিছু তথ্য দিয়েছে। আমরা তাদের তথ্যে সন্তুষ্ট না হওয়ায়– পুনরায় লিখিত জবাব চেয়েছি। এখনো তারা বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাঠায়নি।"
যেসব অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, কৃষি ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে পাওয়া অনিয়মগুলোর মধ্যে– মোট ঋণের পরিমাণ, খেলাপি ঋণ, ঋণের প্রভিশনিং ও কর্মীদের দেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পষ্ট।
প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, কর্মী ঋণ ব্যতিত ২০২৩ সালের জুন শেষে কৃষি ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। যদিও একই সময় ভিত্তিক ব্যাংকের ঋণ শ্রেণিকরণ বিভাগের প্রস্তুতকৃত সিবিএস (কোর ব্যাংকিং সলিউশনস) প্রতিবেদনে ঋণের স্থিতি দেখিয়েছে ২৯ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
ওই সময়ে ব্যাংকের কর্মীদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তথ্য দিয়েছে ১ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪০৩ কোটি টাকা গোপন করছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং সংরক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং পরিদর্শন বিভাগকে অবহিত করতে হবে।
২০২৩ এর জুন পর্যন্ত কৃষি ব্যাংকের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ পরিমাণ ১০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৪৪৪ কোটি টকা।
ঋণ পুনঃতফসিল সংক্রান্ত ব্যাংকের অনিয়ম সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই গ্রাহকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই ঋণ পরিশোধের তারিখ পরিবর্তন করে এ ধরণের ঋণ পুনঃতফসিল দেখানো হয়েছে।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, "কৃষি ব্যাংক তার স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ পুনঃতফসিল করার মাধ্যমে এ ঋণের পোর্টফোলিও'কে এভারগ্রিন করে যাচ্ছে ও এ ঋণসমূহকে রোলওভার করে যাচ্ছে। যা নৈতিকতা ও যথাযথ ব্যাংকিং নিয়মাচারের পরিপন্থী মর্মে প্রতীয়মান হয়।"
এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য রয়েছে যে, কৃষি ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ সুবিধা গ্রহণকারী অধিকাংশ ঋণগ্রহীতার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি)-তে রিপোর্ট করে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক টিবিএস'কে বলেন, কৃষি ব্যাংক ৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ গোপন করেছে। তাদের সিবিএস প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা বলা হলেও– সিবিএস প্রতিবেদনের (ডেটা ইনপুটে) তারা একটি ভুল করেছে। তাঁদের প্রকৃত খেলাপি ঋণের স্থিতি ৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, "খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ গোপন করাসহ ব্যাংকটির নানান অনিয়মের বিষয়ে আমরা একটি লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছি। এখন ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ যদি যৌক্তিক ব্যাখ্যা না দিতে পারে, তাহলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ হারে প্রভিশন করতে হয়। খেলাপি ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ গোপন করে, কৃষি ব্যাংক প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন এড়িয়ে গেছে। এতে আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করা দেশের ব্যাংকগুলোতে একটি কমন প্রাকটিসে পরিণত হয়েছে। অনেক গ্রাহক খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও, ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি ঋণ প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে কম দেখাতে এই ধরণের অনিয়ম করছে।
তিনি বলেন, এসব অনিয়ম ব্যাংকিং খাতের সুশাসনকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে। এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।