উপহার বা দান পাচ্ছেন? তাতেও দিতে হতে পারে কর
অর্থ আইনে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ পরিবর্তনের ফলে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তান ছাড়া দানকারী এবং দানগ্রহীতা উভয়কেই কর দিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এতদিন অবৈধ আয়কে বৈধ করার যে সুযোগ ছিল, সেটি বন্ধ করার পাশাপাশি কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। যদিও এটি বাস্তবায়ন সহজ হবে না বলেও মত দিয়েছেন তারা।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উপহার বা দান হিসেবে যেকোনো পরিমাণ সম্পদ গ্রহণ করলে নিয়মিত হারে আয়কর—৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে—দিতে হবে।
তবে স্বামী, স্ত্রী, পিতা, মাতা ও সন্তানের মধ্যে কেউ দান করলে সেক্ষেত্রে কর দিতে হবে না।
অবৈধ উপার্জন ঠেকাতে দানকারীর ট্যাক্স ফাইলেও ওই অর্থের উৎস সোর্স উল্লেখ করতে হবে।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক স্নেহাশিষ বড়ুয়া বলেন, 'উপহার কর আইন ১৯৯০ অনুযায়ী, দানকারীর জন্য করছাড় পাওয়ার একটি তালিকা রয়েছে। কাজেই দানকারী দানকর প্রদান থেকে অব্যাহতি পেলেও আয়কর আইন ২০২৩-এর আওতায় তাকে কর দিতে হবে।
দানকর আইনের ২(৬) ধারা অনুযায়ী, 'দান' বলতে এক ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোনো ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় অর্থ বা অর্থমূল্যের প্রতিলাভ ছাড়া কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর বোঝাবে।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো আর্থিক বছরে করা ২০ হাজার টাকা মূল্যের দানের ওপর কোনো দানকর ধার্য হবে না। প্রস্তাবিত আইনে শুধু দানকারীই এই কর থেকে অব্যাহতি পাবেন। দানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হবে, যা দানের পরিমাণের ২০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তবে পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দান করা হলে এসব উপহারের ওপরও কোনো কর দিতে হবে না।
অবশ্য এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইনে থাকলেও বাস্তবে দানের বিপরীতে কর আদায়ের নজির খুব একটা নেই।
প্রস্তাবিত অর্থ আইন অনুসারে, ভাইবোন, তৃতীয় পক্ষ এবং প্রতিষ্ঠানসহ যারা দান পাবেন, তাদের সবাইকে করের আওতায় আনা হবে। এর ফলে যিনি দান করবেন তাকে কর পরিশোধ করতে হবে; একইসঙ্গে যিনি দান গ্রহণ করবেন, তাকেও নিয়মিত হারে আয়কর দিতে হবে।
নতুন বাজেটে আনা প্রস্তাব অনুযায়ী, আয়করের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ। ফলে বড় অঙ্কের দান বা অনুদান করা হলে উভয় পক্ষের ওপর স্বাভাবিকভাবেই করের হারও বেশি হবে।
প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম টিবিএসকে বলেন, 'দানের সঙ্গে দুর্নীতির একটি সম্পর্ক আছে। সাধারণত দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয় দানের মাধ্যমে বৈধ করার চেষ্টা করা হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে যিনি দান করছেন, শুধু তাকেই কর দিতে হয়। তবে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, যিনি দান গ্রহণ করবেন, তাকেও কর দিতে হবে।'
এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এই আইনজীবী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ-সংক্রান্ত উদাহরণ টানেন। তিনি বলেন, 'ড. ইউনূস তার ট্রাস্টে দান করার জন্য শেষ পর্যন্ত কর পরিশোধ করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের দানের ক্ষেত্রে দাতা এবং ওই ট্রাস্ট—অর্থাৎ দুজনের ওপরই কর আরোপ হবে।'
বর্তমানে দানকর থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত আলোচ্য ব্যক্তি ছাড়াও অন্য যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দান করতে পারে। তবে আইন অনুযায়ী, যিনি দান করবেন, তার ট্যাক্স ফাইলে ওই সম্পদের ঘোষণা থাকতে হবে এবং যথারীতি দানকর আইন এবং নির্ধারিত হার অনুযায়ী কর আরোপ হবে।
অবশ্য কয়েকজন আয়কর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ে দানকারীর কর ফাইলে ওই সম্পদ আছে কি না, তা যাচাই করা হয় না। আবার আইনে থাকা সত্ত্বেও দান করা হলে ওই দানের ওপর করও আরোপ হয় না।
এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'ড. ইউনূসের বিষয়টি ছাড়া আরো কারও দান করার ওপর কর আরোপের বিষয়টি আমার জানা নেই।'
এনবিআরের আরেকজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, 'অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ দানের মাধ্যমে বৈধ করে নেওয়ার একটি পথ ছিল। নতুন আইনে যিনি দান করবেন এবং যিনি দান গ্রহণ করবেন, উভয়ের ট্যাক্স ফাইলে ওই আয়ের উৎস উল্লেখ থাকতে হবে—এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে।'
'ফলে যে-কেউ অবৈধ উপায়ে আয় করলেই ওই অর্থ যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঘুরিয়ে বৈধ করে নেবেন, সেই সুযোগ কমে আসবে। এমনকি নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও যদি দান করা হয়, সেক্ষেত্রেও ওই আয়ের উৎস উল্লেখ করতে হবে,' যোগ করেন তিনি
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ উদ্যোগকে সমর্থন দিয়ে বলেন, অন্যান্য দেশেও যিনি দান গ্রহণ করবেন, তার ওপর কর আরোপের চর্চা আছে।
তবে তিনি মনে করেন, দান গ্রহণকারীর ওপর কর আরোপের কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন করা কঠিন, বিশেষত সম্পদের ক্ষেত্রে।
তিনি বলেন, 'কেউ সম্পদ দান করলে এর প্রকৃত ভ্যালুয়েশন কীভাবে হবে? কম মূল্য দেখিয়ে সেখানেও কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা থাকতে পারে।'
অন্যদিকে ব্যরিস্টার তানজীব বলেন, 'দানের ওপর কর আদায় এড়াতে অবৈধ টাকার মালিকদের মধ্যে ওই টাকা পাচার করার প্রবণতাও বাড়তে পারে।'
এই উদ্যোগের ফলে দুর্নীতি খুব একটা কমবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।