শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা চীনের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের মসৃণ প্রবেশ নিশ্চিত করবে
সম্প্রতি বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শতভাগ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা দিয়েছে চীন। চীনের এ সুবিধা ও দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা।
বাংলাদেশকে পণ্য রপ্তানিতে শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন। এই সময়ে এটি কেন দিয়েছে তারা?
চীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভোক্তার দেশ। চীনের বাজারে প্রবেশাধিকার যেকোনো দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বড় বড় ব্র্যান্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় পণ্য নিয়ে অন্যান্য দেশে চীনে ভালো করছে। প্রতিযোগিতার পরিবেশ না পাওয়াতে আমরা চীনের বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারিনি।
এ বিষয়টি মাথায় রেখেই চীন আমাদের শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় দেখতে চায় চীন। এজন্য এ সুবিধাকে ৯৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে শতভাগ করা হয়েছে।
পাশাপাশি সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সরাসরি শিপিং লাইন শুরু হয়েছে। এতে পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় কমেছে। ফলে চীনের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশটা মসৃণ হলো।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য আরএমজিনির্ভর। এ শিল্পে চীন বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। আরএমজি ব্যতীত আর কোন পণ্যে এ সুবিধা নিতে পারবে বাংলাদেশ?
চীন বিশ্বের এক নম্বর আরএমজি প্রস্তুতকারক হলেও সেখানে বাংলাদেশের আরএমজি পণ্যের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা চীনে পোশাক রপ্তানি করছেনও।
তবে আমাদেরকে আরএমজির পাশাপাশি অন্য পণ্য, অর্থাৎ চীনে যেসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে তা রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি করার জন্য সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার জায়গা লেদার। বাংলাদেশি ক্যাটেল স্কিনের চাহিদা চীনে অনেক। মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় বছরে বিপুল পরিমাণ চামড়া রপ্তানির সুযোগও রয়েছে আমাদের।
দ্বিতীয় সম্ভাবনার জায়গাটি হলো সামদ্রিক সম্পদ। হিমায়িত মাছ, শৈবালসহ সামদ্রিক নানা সম্পদের চাহিদা চীনে রয়েছে। অন্যদিকে আমাদেরও বিশাল সমুদ্রসীমানা রয়েছে।
বাংলাদেশের এগ্রো প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিরও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া আইসিটি এবং সফটওয়্যারের ক্ষেত্রেও উভয় দেশের অভিজ্ঞতা বিনিয়নের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য রপ্তানির সুযোগও রয়েছে। চীনের ই-কমার্সের বৈশ্বিক উপস্থিতি থাকায় সেখানে প্রবেশের মাধ্যমেও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের।
চীন ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা সেটি কাজে লাগাতে পারেননি। এখন দেওয়া শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা নিতে বাংলাদেশকে কী করতে হবে?
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের দুর্বলতার কারণেই আমরা সুবিধাটি কাজে লাগাতে পারিনি। ভ্যালু এডিশনসহ (মূল্য সংযোজন) চীনের কিছু নিয়মনীতিকে নন-ট্যারিফ বাধার কথা বলে আমাদের রপ্তানিকারকরা এগোয়নি। এখানে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের দুর্বলতাও রয়েছে।
অন্য যেসব দেশ এ সুবিধা পেয়েছে, তাদের সরকার নিজ দেশের নামে চীনে প্যাভিলিয়ন স্থাপন করেছে। নিজেদের পণ্য যেন চীনের মানুষ চেনে, ওখানকার ব্যবসায়ীরা চেনে, সে ব্যবস্থা করেছে। ওইসব দেশের ব্যবসায়ীরাও নিজ উদ্যোগে প্রাইভেট-টু-প্রাইভেট চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের পণ্যের প্রসার ঘটিয়েছেন। আমরা এদিক থেকে পিছিয়ে ছিলাম।
আমাদের রপ্তানিকারকদের আরেকটি বড় বাধা ছিল চীনের ভাষা ও তাদের আইনকানুন না জানা। পাশাপাশি পণ্য বহুমুখীকরণ না করা। এ সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠলে আমাদের সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের ব্যবসায়ীদের চীনের বাজারে প্রবেশ মসৃণ করতে বিসিআইসিসিআই কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে কি?
চীন আমাদের ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরই আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। তবে নানা কারণে তা এগোয়নি।
বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ী বৈচিত্র্যময় পণ্য নিয়ে চীনের বাজারে যেতে চান, আমরা তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। এরইমধ্যে চীনের ভাষা জানার জন্য কোর্স চালু হয়েছে। উদ্যোক্তাদের ফ্রি চীনা ভাষা শেখানো হচ্ছে।
আমরা খুব শিগগিরই বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, ঢাকার চীন দূতাবাস ও রপ্তানি করতে আগ্রহী নতুন উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করব। সেখানে চীনে রপ্তানির নন-ট্যারিফ বাধাগুলো দূর করার কৌশল নিয়ে আলোচনা হবে। ব্যবসায়ীদের সহজ প্রবেশের পথ দেখানো হবে। শুধু এই প্রোগ্রামই নয়, আমরা ভবিষ্যতে সিরিজ প্রোগ্রাম করার উদ্যোগ নিচ্ছি। বাংলাদেশি পণ্যকে পরিচিত করাতে চীনের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে প্যাভিলিয়ন ও স্টল নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি।
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হওয়ায় এখানে চীনের বিনিয়োগ এবং ব্যবসায় কোনো প্রভাব পড়বে কি?
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সাম্প্রতিক বা রাজনৈতিক নয়। ১৯৮০-র দশক থেকেই চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে আসছে। এশিয়ার নিম্ন-আয় ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নে পাশে থেকেছে চীন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা মসৃণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে এখন পর্যন্ত ৮-১০টি মৈত্রী সেতু করে দিয়েছে চীন। বাংলাদেশি পণ্য বৈশ্বিক বাজারে পৌঁছাতে মৈত্রী এক্সিবিশন সেন্টার, কনভেনশন সেন্টারসহ নানা অবকাঠামো উন্নয়নে ভুমিকা রেখেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সড়ক, রেল ও নৌপথে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চীন। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ অনেক মেগা প্রকল্পে কাজ করেছে। বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশেও বৈশ্বিক মানের অবকাঠামো কোম্পানি গড়ে উঠেছে।
প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী চীনে পড়তে গিয়ে প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান নিয়ে আসছেন। এটি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
অবকাঠামোর পাশাপাশি বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে চীন। চীনের ক্যাপিটাল মেশিনারি এবং কাঁচামালের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে আরএমজিসহ দেশের বৃহৎ শিল্প। দুই দশক আগেও যেসব ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করতে অনেক ব্যয় করতে হতো, এখন তা অর্ধেক বা তার চেয়েও কম দামে দিচ্ছে চীন।
বাংলাদেশে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা গ্রিন এনার্জিতে চীনের বিনিয়োগ চেয়েছেন। গ্রিন এনার্জি ছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ করতে চায় চীন। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে এ সম্পর্ক জোরালো করতে চায়। বাংলাদেশকে এশিয়াকেন্দ্রিক একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়।