সুতার দামে বড় সংকটে দেশের বয়নশিল্প
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও জ্বালানি তেলের কারণে পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত তিন মাসে সুতার দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে বিপদে পড়ে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া বা বন্ধ হওয়ার হুমকিতে রয়েছে বহু উইভিং মিল বা বয়ন শিল্পকারখানা।
দেশের সবচেয়ে বেশি উইভিং মিল থাকা নরসিংদীর চৌয়ালা টেক্সটাইল শিল্প মালিক সমিতির সেক্রেটারি মো. নান্নু আলী খান বলেন, তিন মাসে সুতার দাম ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ায় দেশের উইভিং মিলগুলোর সক্ষমতার ৭০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে। চালু থাকা ৯০ শতাংশ কারখানাই দিনে এক শিফটের বেশি কারখানা খোলা রাখছেন না।
অন্যদিকে করোনা ও বন্যার ক্ষতির পর সুতার দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেশা থেকেই দূরে ঠেলে দিচ্ছে স্থানীয় পোশাক উৎপাদনের মূল হাব সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়ার ৮ লাখ তাঁতীকে। সুতার দাম বাড়লেও পোশাকের দাম না বাড়াতে পারায় লোকসানের কারণে অনেকেই উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন কারিগররা।
টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ বলছে দেশে স্থানীয় পোশাকের বাজার আট বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার। বিপুল এ পণ্যের, 70 শতাংশ যোগান দিচ্ছে স্থানীয় উইভিং মিলগুলো। থ্রি পিস, শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, স্কুলড্রেস, শার্ট -প্যান্ট বা এ জাতীয় পোশাকের কাপড়ের মূল বাজার নরসিংদী জেলার মাধবদী এবং বাবুরহাট, রাজধানীর কেরাণীগঞ্জ, ইসলামপুর, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও কুষ্টিয়া।
উইভিং মিলের ৭০ ভাগ সক্ষমতা অব্যবহৃত
উইভিং শিল্পের মূল কেন্দ্রবিন্দু নরসিংদীর মাবধদী, বাবুবাজার এবং নারায়ণগঞ্জর আড়াইহাজার। নরসিংদীর চৌয়ালা এলাকাতেই রয়েছে প্রায় ৩০০ উইভিং মিল, যাতে সরাসরি কাজ করে প্রায় ২৪ হাজার শ্রমিক। কাঁচামাল ইয়ার্ন বা সুতার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে লোকসানে পড়ে উৎপাদন কমিয়ে বা বন্ধের পথে হেটেছেন এখানকার অনেক উদ্যোক্তা।
এদেরই একজন সানজিটা টেক্সটাইলের মালিক মো. নয়ন মিয়া। করোনার প্রকোপ কমে গেলে কারখানা চালু করলেও সক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার করছেন তিনি। সেটাও শুধু রাতের শিফটে।
তিনি বলেন, কেবল আমিই নই এলাকার উইভিং মিলগুলোর ৯০ শতাংশই দিনের বেলায় বন্ধ থাকে। রাতের শিফটে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কাজ চালু থাকে।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ৯ মাস আগেও ৪০ কাউন্টের সুতা প্রতি পাউন্ড আমরা কিনতাম ১১০ টাকা থেকে ১১৫ টাকায়। এখন কিনতে হচ্ছে প্রায় ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। ৯ মাস আগে প্রতি গজ কাপড় বিক্রি করতাম ২৪ টাকায়। এখন প্রতি গজ কাপড় বিক্রি করতে পারি সর্বোচ্চ ৩১ টাকায়। অথচ এতে উৎপাদন খরচ ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা। এই কারণে অনেকে এখন মিল বন্ধ রেখেছে।
গত ২০ বছরে এরকম সংকট আর দেখেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর আগে ২০০০ সালের দিকে একবার সংকট দেখা দিয়েছিল। তবে তখন লাভ না হলেও লোকসান হয়নি। কিন্তু এ বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে।
এখানকার আরেকজন শিল্প মালিক মো. নান্নু আলী খান বলেন, আমার ১০০ পাওয়ার লুমের দুটি কারখানা আছে। এরমধ্যে একটি পুরোপুরি বন্ধ। বাকি একটি কারখানা ফিফটি পার্সেন্ট চালু আছে।
তিনি বলেন একশ পাওয়ার লুমের মেশিনের দাম প্রায় এক কোটি টাকা, এর সঙ্গে অন্যান্য মেশিনসহ ইনভেস্টমেন্ট দেড় কোটি টাকা। মেশিন স্থাপন, বিদ্যুৎ লাইন, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সহ একটি কারখানা চালু করতে সবমিলিয়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। কিন্তু কাপড়ের চাহিদা না থাকায় লোকসান দিয়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
উইভিং মিল মালিকদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম কিছুটা বাড়লেও স্থানীয় স্পিনিং মিল মালিকরা অতি মুনাফার আশায় ইয়ার্নের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছেন। এর সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে তা আরো বেড়েছে।
অবশ্য স্থানীয় বাজারের জন্য সুতার সরবরাহ করা স্পিনিং মিল মালিকদের দাবি, তারা অতি মুনাফা করছেন না। বরং আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারনে সুতার দাম বেড়েছে।
যদিও সুতার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ৭০ শতাংশ উইভিং মিল বন্ধ আছে বলে স্বীকার করেছেন বিটিএমএর ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, বছরের এই সময়টা কিছুটা অফ পিক সিজন হওয়ায় ক্ষমতার পুরোটা চালানো যায় না। কিন্তু কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অস্বাভাবিক।
বিটিএমএর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পরিস্থিতি উন্নয়নে সংগঠনটি কাজ করছে। এই লক্ষ্যে সাবেক পরিচালক খোরশেদ আলমকে প্রধান করে একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।
খোরশেদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অনেক স্পিনিং মিল ইতিমধ্যে মিলরেটে সুতা বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে, এবং বিক্রি শুরুও করেছে।
আবার বন্ধের পথে কেরানীগঞ্জ কারখানা হাব
সারাদেশের লোকাল মার্কেটগুলোতে বিক্রিত শার্ট, প্যান্ট, টি-শার্ট, পাঞ্জাবী, থ্রি-পিচসহ স্থানীয় পোশাকের ৭০ শতাংশের যোগান দেয় ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকার উৎপাদকরা। সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত এ কেরানীগঞ্জের কারখানার মালিকরা বিপাকে পড়েছেন।
এখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার কারণে চারটা ঈদ মিস হওয়ায় মূলধন হারিয়েছেন অন্তত ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী। কারখানা-শো রুমের ভাড়া, শ্রমিকদের বেতন, মেশিনারি ও কাঁচামাল ক্রয় ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে পুরোপুরি ব্যবসা বন্ধ করেছেন কেউ কেউ। যারা কারখানা চালু করেছেন সুতার দাম বৃদ্ধিতে তারাও উৎপাদন করতে পারছেন না।
কেরানীগঞ্জ জেলা পরিষদ মার্কেটে নিজের কারখানার শীতের পোশাক বিক্রি করেন আবির গার্মেন্টেসের মালিক সাইফুল ইসলাম। ২০১৯ সালে প্রায় ৫ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করলেও এবার পোশাক উৎপাদন করেছেন ১ কোটি টাকার। সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় কারখানার এক চতুর্থাংশ চালু করেছেন মাত্র।
সাইফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, গত বছর যে কাপড়ে গজ ৭০ টাকা ছিল এবার তা ১১০ টাকা। এরসঙ্গে সুতা, রঙসহ অন্যান্য ম্যাটেরিয়ালসের দামও ২৫-৩০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু বাজারে চাহিদা না থাকায় কাপড়ের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, এখানকার প্রায় ১০ হাজার ব্যবসায়ী ও ৫ হাজারের বেশি কারখানার মালিক সংকটে ভুগছে। অনেকেই দেউলিয়া হয়েছে। করোনার পর কারখানা চালুই করেনি ২০ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী। আগে চার লাখ মানুষ কাজ করলেও এখন তা দুই থেকে আড়াই লাখ নেমে এসেছে।
বেশি সংকটে তাঁত উৎপাদকরা
দেশের হস্তচালিত পোশাক উৎপাদনে দেশে সবচেয়ে বেশি কারিগর পাবনা-সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে। এই তিন জেলায় শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ দেশীয় পোশাক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৭ লাখ মানুষ। তবে করোনা, বন্যার পানি এবং সুতার দাম বৃদ্ধিতে উৎপাদনে ফিরতে পারেননি ৩৫-৪০ শতাংশ তাঁত ব্যবসায়ী।
তাঁত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নামেন তারা। তবে চাহিদা কম থাকা ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ব্যবসায় নামেননি। করোনার পর বন্যার কারণেও ব্যবসায় নামতে পারেননি কেউ কেউ।
তারা বলছেন, সুতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, নকশা তৈরিসহ তাঁতে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা তৈরিতে যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন থাকায় কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করেছেন। ফলে কারিগর সংকটও রয়েছে মালিকদের।
পাবনার দুই ভাই তাত ঘরের মালিক সোহেল রানা বলেন, লোকসানে রয়েছি। এখন ব্যবসা বাণিজ্য নেই। সুতার দাম বেশি। তাই কাপড়ের দাম বেশি। ক্রেতা এসে ঘুরে যায়। যে কাপড় উৎপাদনে আগে ৩০০ টাকা ব্যয় হতো সেটি এখন ৪৫০ টাকার বেশি লাগছে।
সিরাজগঞ্জ হ্যান্ডলুম এন্ড পাওয়ারলুম অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলুর রহমান তালুকদার বলেন, করোনার কারণে গত বছর হাটবাজার দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় লাখ লাখ টাকার উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি করতে পারেননি কারিগররা। সে ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা। পুঁজি হারিয়ে পথে বসেন অনেকে। আবার ধারদেনা করে কাজ শুরু করলেও সুতা ও শাড়ি তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই কারখানা চালু রাখতে পারছেন না।
থমকে গেছে স্থানীয় হাট-বাজারও
কেবল তাঁতী কিংবা শিল্পোদ্যোক্তা নন, এর শিল্পের উপর ভর করে গড়ে উঠা অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমও থমকে গেছে সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে। নরসিংদীর চৌহালে মো. শরীফ নামে স্থানীয় এক ছোট দোকানের মালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর সঙ্গে আলাপকালে জানান, স্বাভাবিক কার্যক্রম থাকার সময় প্রতিদিন তার গড়ে চার হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হতো। বর্তমানে বিক্রি নেমে এসেছে ১০০০ টাকায়।
পুরো নরসিংদী জেলা থেকে উৎপাদিত গ্রে কাপড়গুলো চলে যায় মাধবদী বাজার। এখান থেকে কাপড় কিনে ডাইং, প্রিন্টিং ফিনিশিং শেষে বিক্রি হয় বাবুরহাট বাজারে। সারাদেশের পাইকাররা এই দুই বাজার থেকেই মূলত কাপড় কেনেন।
৭ দশকের পুরনো মাধবদী বাজারে গিয়ে আগের সেই চিরচেনা ভিড়ভাট্টা দেখা গেল না। ব্যবসায়ীরা জানান কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পাইকাররা এখন এই বাজারে আসা কমিয়ে দিয়েছেন ফলে বিক্রি কমে গেছে।
এই বাজার থেকে কাপড় কিনে প্রিন্টিং ফিনিশিং শেষে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে সাপ্লাই দেয়া এক ব্যবসায়ী বলেন, গাউসিয়া, নিউমার্কেটসহ অন্যান্য মার্কেটের দোকান কর্মীরা দোকান খুলে এখন মোবাইল ফোনে গেম খেলে, কারণ বিক্রি নেই। এখান থেকে কাপড় কিনে ডাইং প্রিন্টিং ফিনিশিং শেষে প্রতি গজ কাপড়ে যে খরচ হয় রাজধানীর মার্কেটগুলোতে ক্রেতারা ওই দামে কিনতে চান না। আবার বাকিতে বিক্রি করলে পার্টি ওই টাকাও দিতে পারেনা, কারণ বিক্রি কমে গেছে।
নরসিংদীর মতোই স্থানীয় বাজারে বেচা-বিক্রি নেই সিরাজগঞ্জ, পাবনা কিংবা টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীকে কেন্দ্র করে ঘরে বাজারগুলোতেও।
টাঙ্গাইলের করটিয়া হাটে প্রায় ৫ হাজার শাড়ির পাইকারি দোকান রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি হাটে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার শাড়ি বিক্রি হয়।
করটিয়ার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাবিব বলেন, যে পণ্য ৩০০ দিয়ে কিনেছি, সেটি ৪৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। ক্রেতাদের বুঝাতে কষ্ট হচ্ছে যে সুতার দাম বেড়েছে। ফলে মানুষ কিনছে না। বিক্রিও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকও নেই।