চাহিদা তুঙ্গে, মদের উৎপাদন বাড়াচ্ছে কেরু
শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে তৈরি একটি সফটওয়্যার ব্যবহার নিয়ে এনবিআর ও বেসরকারি কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউসগুলোর মধ্যে রেষারেষির কারণে কমে গেছে বিদেশি মদের সরবরাহ। এর জেরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে দেশীয় ব্র্যান্ড কেরু অ্যান্ড কোংয়ের মদের চাহিদা।
কেরু কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরে কোম্পানিটির উৎপাদিত মদের বিক্রি ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
মদের বিক্রি বাড়ায় সরকার কোম্পানিটি সম্প্রসারণের কথা ভাবছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল ঘোষণা দিয়েছেন, কেরু অ্যান্ড কোংয়ের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে দর্শনার বর্তমান স্থানে দ্বিতীয় একটি ইউনিট হবে। কারণ মদের পাশাপাশি ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জৈব দ্রাবকের মতো অন্যান্য পণ্যেরও চাহিদা রয়েছে।
দর্শনা চিনিকলে আখ মাড়াই কার্যক্রমের উদ্বোধনকালে শিল্পমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
আগে প্রতি মাসে সাধারণত কেরু অ্যান্ড কোংয়ের মদ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার কেস বিক্রি হত। তবে এ বছরের অক্টোবরে এই সংখ্যা ১৮ হাজার ৫৭৯ কেস এবং নভেম্বরে ১৯ হাজার ৪৪৬ কেসে দাঁড়িয়েছে।
কেরু অ্যান্ড কোংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি আশা করছে এই মাসে বিক্রির পরিমাণ ২০ হাজার কেস ছাড়িয়ে যাবে। কেননা সারা দেশে ১৩টি ওয়্যারহাউস ও তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়তি অর্ডার পেয়েছে।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড—যা মাড়াইকৃত আখ থেকে উপজাত হিসেবে অ্যালকোহল উৎপাদন করে—তাদের দুটি ডিস্টিলারি প্ল্যান্টে উৎপাদন বাড়িয়েছে। কোম্পানিটি তাদের নিজস্ব ওয়্যারহাউস ও বিক্রয়কেন্দ্র থেকে চাহিদা অনুযায়ী মদ উৎপাদন করে।
আগে কোম্পানিটি তাদের বিদ্যমান উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহার করত এবং প্রতি মাসে ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার কেস মদ উৎপাদন করত। তবে এই পরিমাণ ধীরে ধীরে বেড়েছে। এ মাসে প্রতিষ্ঠানটি ২০ হাজার কেসের বেশি মদ উৎপাদন করেছে। কোম্পানিটি দেশের দুই পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় দুটি নতুন বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করছে।
ডিস্টিলারি ইউনিট দীর্ঘদিন ধরে কেরুর আয়ের অন্যতম উৎস। গত কয়েক বছর ধরে মদের বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কেরু শুধুমাত্র মদ থেকেই ১৯৫ কোটি টাকা আয় করেছে।
এখন কেরুর মদের চাহিদা আরও বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটি ভবিষ্যতে আরও লাভের আশা করছে।
টিবিএসের সঙ্গে কথা বলার সময় বেশ কয়েকটি বারের ম্যানেজাররা জানিয়েছেন, বাজারে এখন বিদেশি মদের সংকট চলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বছরের ২ জুলাই থেকে সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। এরপর দেশের বিদ্যমান ছয় ব্যক্তিগত কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউসগুলো ধর্মঘট ডাকে। এর জেরে দেখা দেয় মদের সংকট।
এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি কেরুর মদের বিক্রি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বার ম্যানেজাররা।
কেরুর ডিস্টিলারি ইউনিট
কেরু অ্যান্ড কোংয়ের প্রধান পণ্য চিনি। তবে আখ থেকে চিনি আহরণের পর উপজাত হিসেবে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়। এসব উপজাতের মধ্যে রয়েছে—দেশি মদ, বিদেশি মদ, ভিনেগার, স্পিরিট ও জৈব সার।
কোম্পানিটি কান্ট্রি স্পিরিট (সিএস), রেক্টিফায়েড স্পিরিট (আরএস), ও ডিনেচারড স্পিরিট (ডিএস) এবং মল্টেড ভিনেগার ও হোয়াইট ভিনেগার নামে দু-ধরনের ভিনেগার উৎপাদন করে।
কেরুর সিএস, আরএস ও ডিএসের দুটি ডিস্টিলারি প্ল্যান্টের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ১ দশমিক ৩৫ কোটি প্রুফ লিটার।
এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৫২ দশমিক ৭৬ লাখ প্রুফ লিটার। বাজারের চাহিদা কম থাকায় সক্ষমতার অর্ধেক অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
কেরুর নয়টি ব্র্যান্ডের 'বিদেশি মদ' রয়েছে—ইয়েলো লেভেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, শেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, সারিনা ভদকা, রোসা রাম ও ওল্ড রাম।
কোম্পানিটি ১৮০ মিলিলিটার, ৩৬৫ মিলিলিটার ও ৭৫০ মিলিলিটার বোতলে মদ বাজারজাত করে।
কোম্পানিটির সমস্ত ওয়্যারহাউসে সম্প্রতি মদের চাহিদা বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। ঢাকা ও শ্রীমঙ্গলের ওয়্যারহাউসগুলোতে চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, একটি কেসে ৭৫০ মিলিলিটারের ১২টি, ৪৬৫ মিলিলিটারের ২৪টি এবং ১৮০ মিলিলিটারের মদের ৪৮টি বোতল থাকে।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ
কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।
কোম্পানিটি এখন কক্সবাজার ও পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটায় আরও দুটি বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করছে। প্রতিষ্ঠানটি আরও তিনটি ওয়্যারহাউস স্থাপন করতে আগ্রহী।
সূত্রের তথ্য অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটি ম্যানুয়াল সিস্টেম ব্যবহার না করে অটোমেশনের মাধ্যমে মদের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে।
প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। একবার বাস্তবায়িত হলে এটি উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কেরুর এমডি মোশারফ হোসেন বলেন, 'নতুন মার্কেটিং পরিকল্পনার আওতায় ম্যানেজমেন্ট তিনটি ওয়্যারহাউস ও দুটি বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে আমরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে অনুমতি চেয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর দুটি বিক্রয়কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এখন বিক্রয়কেন্দ্রগুলো পেতে কোম্পানিটি পর্যটন কর্পোরেশনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করবে।'
চিনি ইউনিট লাভজনক করার লক্ষ্য
সরকার কেরু অ্যান্ড কোংয়ের বিএমআরই-র (ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ) জন্য ১০২ দশমিক ২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
২০১২ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চিনির কারখানাটি সংস্কার করা হবে।
ডিস্টিলারি বিভাগ ছাড়া চিনি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সমস্ত ইউনিটে কোম্পানিটি বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে চলেছে।
চিনি ইউনিটের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়ে ৬৪২ দশমিক ৭৯ কোটি টাকা।
বর্তমান লোকসানের প্রবণতার অবসান ঘটিয়ে চিনি ইউনিটকে কীভাবে লাভজনক করা হবে জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'কারখানা সংস্কারের পর উৎপাদন বাড়বে। আশা করছি কোম্পানিটি [সংস্কারের] চার বছরের মধ্যে লাভ করতে পারবে।'