সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা
প্রধান সমুদ্র রুটগুলোতে, বিশেষ করে বাংলাদেশ-চীন রুটে ফ্রেইট চার্জ বা পণ্য পরিবহনের খরচ বৃদ্ধি স্থানীয় ব্যবসাগুলোর জন্য গুরুতর এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কারণ কোভিড-১৯ মহামারিতে বিগত প্রায় দুই বছর ধরে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
বর্ধিত এই চার্জের সঙ্গে চালানে বিলম্ব, কাঁচামাল থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসা সামগ্রীসহ বেশিরভাগ পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে। এভাবে খরচ বাড়তে থাকলে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ-চীন রুটে একটি ৪০-ফুট কন্টেইনারের চালানের খরচ তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ২ হাজার মার্কিন ডলার। ব্যবসায়ীদের এখন ৪০-ফুট লোডেড কন্টেইনারের জন্য ৮ হাজার ডলার গুণতে হবে, যা তিন সপ্তাহ আগেও ছিল মাত্র ৬ হাজার ডলার। গত বছরের তুলনায় পর্যায়ক্রমে এ খরচ বেড়েছে ১৬৭ শতাংশ বা ৫ হাজার ডলার।
ক্ষতির শিকার প্রধান খাতগুলোর মধ্যে পোশাকখাত অন্যতম। কারণ কাঁচামালের জন্য পোশাকখাত অনেকাংশেই চীনের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, "চীন-বাংলাদেশ রুটে ফ্রেইট চার্জের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি সরাসরি আমাদের উৎপাদনকে প্রভাবিত করেছে, খরচ বাড়িয়েছে। কারণ চীন আমাদের কাঁচামালের প্রধান উৎস।"
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে আরও বলেন, "আন্তর্জাতিক ফ্রেইট চার্জ বৃদ্ধি ছাড়াও সাম্প্রতিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে স্থানীয় পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েছে। তাই এখন আমাদের লজিস্টিক খরচ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।"
"প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও নতুন বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কর্মীদের বেতন ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন না", যোগ করেন তিনি।
গত বছরের তুলনায় পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রুটে সামুদ্রিক পণ্য পরিবহনের খরচ ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে, প্রতি ৪০-ফুট লোডেড কন্টেইনারের খরচ ৩ হাজার ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ডলারে। অন্যদিকে, ইউরোপ রুটের খরচ ৪০০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার ডলার।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্পর্কিত সম্মেলন সংস্থা ইউএনসিটিইএডি-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্রেইট চার্জ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি মূলত ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও হ্রাসপ্রাপ্ত যোগান ক্ষমতার ফলাফল। এর পাশাপাশি শ্রমিকের অভাব ও বন্দর অঞ্চলগুলোতে চাপিয়ে দেওয়া করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ তো আছেই।
'রিভিউ অফ মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০২১' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, পণ্য পরিবহনের এই উচ্চ খরচ বা ফ্রেইট চার্জ ২০২৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতির পূর্বাভাস দিয়ে প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, "যদি কন্টেইনার ফ্রেইট চার্জ বাড়তে থাকে, তাহলে বিশ্বব্যাপী আমদানি মূল্যের স্তর এখন থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। সেইসঙ্গে ভোক্তা মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেতে পারে দেড় শতাংশ পর্যন্ত।"
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পণ্য চালানের জন্য স্থানীয় পণ্য পরিবহন ভাড়ার পাশাপাশি অন্যান্য খরচের হারও বৃদ্ধি করেছে।
গত ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিআইসিডিএ) 'কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ' ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে, যেখানে ১৯টি প্রাইভেট ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) বৃদ্ধি করেছে ২৬ শতাংশ। এদিকে লাইটার-ভেসেল অপারেটরদের বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি), সরকার কর্তৃক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর গত ১৫ নভেম্বর ভাড়া বাড়িয়েছে ১৫ শতাংশ।
এই ভাড়া বৃদ্ধি সবার জন্যই একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দরের বাইরের বন্দরগুলোতে নোঙর করা বড় জাহাজ থেকে ছোট বা হালকা জাহাজে করে তাদের পণ্য নিয়ে আসেন। বর্তমানে ডব্লিউটিসি'র অধীনে ১ হাজার ৩০০টি জাহাজ রয়েছে।
এছাড়া, সড়ক-পরিবহনের ভাড়াও ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কারণ গত বছরের নভেম্বরের শুরুতে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বা ১৫ টাকা বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল আজম টিবিএসকে বলেন, "কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য বোঝাই কন্টেইনার পরিবহনের গড় খরচ ছিল ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু সম্প্রতি তা বেড়ে হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।"
বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান-ট্রাক-প্রাইম মুভার গুডস ট্রান্সপোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহমেদ বলেন, "পণ্য পরিবহনের রুটের ভিত্তিতে কোনো নির্দিষ্ট ভাড়া নেই। তবে কিছু কোম্পানির সঙ্গে ভাড়ার চুক্তি রয়েছে আমাদের।"
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বিশ্বজুড়ে ব্যবসাগুলো এখন বর্ধিত পরিবহন ব্যয়ের সাঙ্গে লড়াই করছে। আর বাংলাদেশে কিছু অপরিকল্পিত সরকারি নীতি এই দুর্ভোগকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, "এমন সময়ে ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্ত এসেছে, যখন ব্যবসা-বাণিজ্য মহামারির প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধারের লড়াই করছে।"
এর ফলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
টিবিএসকে তিনি আরও বলেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির জন্য পরিবহন ভাড়া ৬ শতাংশ বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু আইসিডি, লাইটার-ভেসেল ও ট্রাকসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্টরা তাদের ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, "আন্তর্জাতিক সমুদ্র পথে মালবাহী খরচ এবং স্থানীয় পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় পোশাক রপ্তানিকারকদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ। ফলস্বরূপ, রপ্তানিকারকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।"
আরএম ট্রেডার্সের আমদানিকারক ও স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, "শিপমেন্ট সংকট অধিকাংশ ভোগ্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।"
এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।