বন্ধের পথে নোয়াখালীর একমাত্র তাঁতশিল্প
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাদের তৈরি পোশাক বর্জনের অংশ হিসেবে তৎকালীন সময়ে পাক-ভারত উপমহাদেশে হস্তচালিত কাঠের তৈরি চরকা দিয়ে শুরু হয় তাঁত শিল্পের। তাঁতিরা তাতে কাপড় বুনতেন। এসব তাতে তৈরি হতো লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা ও ধুতিসহ বিভিন্ন পোশাক, যা গ্রামীণ জনপদের মানুষের পোশাকের চাহিদা পূরণ করতো। ১৯২১ সালে ভিনদেশে তৈরি কাপড় বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগে আসেন তিনি। সেখানকার তৎকালীন জমিদার ব্যরিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ তার সকল সম্পত্তি গান্ধীজির আর্দশ প্রচার এবং গান্ধীজির স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য দান করেন, প্রতিষ্ঠিত হয় একটি ট্রাস্ট। ট্রাস্টটির নামকরণ করা হয় কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট হিসেবে। ১৯৭৫ সালে তার নাম পরিবর্তন করে করা হয় গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট। ২০০৩ সালে গান্ধী আশ্রমে চালু হয় একটি তাঁতশিল্প।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবছর ওই তাঁতে তৈরি প্রায় অর্ধকোটি টাকার কাপড় বিক্রি হতো, কিন্তু ২০১৯ সালে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উৎপাদন কমতে থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে বিক্রি কমে যাওয়ায় এবং পাইকার না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি প্রায় বন্ধের পথে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ, প্রতিমাসে গুনতে হচ্ছে লোকসান। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এ শিল্পটি আবার তার পুরনো দিন ফিরে পাবে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ২০০৩ সালে প্রথমে ১০ জন নারী শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে তাঁতটি। পরবর্তীতে ২৬টি হস্তচালিত মেশিনে কর্মসংস্থান হয় ৭০ জন নারীর। মজুরি ভিত্তিতে তাঁতটিতে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের আশপাশের ৭০টি পরিবারের নারী সদস্যদের কর্মসংস্থান হওয়ায় তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হতে শুরু করে। এর বাইরে বেতন ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় একজন ম্যানেজারসহ আরও ৯জন। দিনপ্রতি পণ্য তৈরির ওপর মজুরি দেওয়া হতো শ্রমিকদের, দুপুরে খাওয়া বাবদ দেওয়া হতো ৫০ টাকা করে। এখানে তৈরি পাঞ্জাবি, কোটি, শাড়ি, শাল, ওড়না, থ্রি-পিস, টু-পিস, পতুয়া, উত্তরীয়, কাপড়ের পঞ্জিকা, কবি ব্যাগ, গামছা, শিশুদের পোশাক, তোয়ালে, বেডশিট, রুমাল, মাস্ক, থান কাপড় এলাকার চাহিদা পূরণ করে পাইকার ও এজেন্টের মাধ্যমে সারাদেশের বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করা হতো। চলতি বছরের শুরু থেকে কয়েকটি অনলাইন বিক্রেতার মাধ্যমে পণ্য বিক্রি শুরু করা হয়েছে।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনার প্রভাব পড়ে এ তাঁতে। লকডাউনসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধে কমতে থাকে বাইরে থেকে আসা পাইকার। করোনায় সংকটে পড়ে প্রতিদিনই কমতে থাকে বিক্রি, বিক্রি কমে যাওয়ায় উৎপাদনও কমে যায়। ফলে ২০১৯ সালের শেষদিক থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় মাত্র ১৭ জন শ্রমিক রেখে ৫৩ জনকে ছাটাই করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের ২০টি তাঁত মেশিন।
আরও জানা যায়, ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিবছর এ প্রতিষ্ঠানের ২৬টি তাঁত থেকে তৈরি হওয়া প্রায় অর্ধকোটি টাকার পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ও খুচরা মূল্যে বিক্রি করা হতো। তাঁতের নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্রের বাইরে প্রায় প্রতিটি জেলায় পাইকারের মাধ্যমে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হতো। গত ৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে বিক্রি কমেছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। যেখানে ২০১৫ সালে বিক্রি ছিল অর্ধকোটি টাকা যা ২০২০ সালে নেমে আসে সোয়া ৬ লাখ ১০ হাজার টাকায়, ২০২১ সালে ছিল ৬ লাখ টাকা, যা করোনার শুরুতে ২০১৯ এ ছিল সাড়ে ১৬ লাখ টাকা।
তাঁতের চরকা শ্রমিক রুমা আক্তার বলেন, চরকার মাধ্যমে বোভিন, চানা কাটা, তুলা কাটার ও সুতা রংয়ের কাজ করেন তিনি। গত ১০ বছর ধরে এক কাজের বাইরে আর কিছু তার জানা নেই, বর্তমানে তাঁতটির অবস্থা এমন যে কোন মুহুর্তে সেটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর তাতে চাকরি হারিয়ে ফেললে আর কোথাও কাজ পাওয়ার সম্ভবনা নেই তার।
তাঁত শ্রমিক পারভীন বলেন, গত দুই বছর আগেও আমরা যে পরিমাণ কাজ করতাম তাতে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পেতাম। কিন্তু বর্তমানে বিক্রি কমে যাওয়ায় কাপড় তৈরিও কমে গেছে, এখন প্রতিদিন ১৫০-২০০ টাকা মজুরি পেতেও কষ্ট হয়। এভাবে চলতে থাকলে পরিবার ও সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।
মিনতি রানী শীল নামের আরেক তাঁত শ্রমিক জানান, আমাদের এলাকার অনেক গরীব মেয়েরা এ তাঁতে কাজ করতো। কিন্তু করোনার কারণে আমাদের তাঁতটি এখন প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। গরিব মেয়েগুলো কাজ হারিয়ে পরিবার নিয়ে কষ্টে আছে। তাঁতটি পুনরায় চালু হলে সবাই আবার কাজ ফিরে পাবে।
পারভিন লাকী নামের একজন ক্রেতা জানান, তিনিসহ তার দুইজন সহকর্মী ঢাকা থেকে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের জাদুঘরে ঘুরতে এসেছেন। এখানে তাঁতে কাপড় তৈরি হয় বিষয়টি জানতে পেরে আশ্রমের খুচরা বিক্রির কেন্দ্র থেকে একটি পাঞ্জাবি, একটি কোটি ও তিনটি শাল ক্রয় করেছেন। হস্তচালিত তাতে তৈরি হওয়া পণ্যগুলোর গুণগত মান অনেক ভালো বলে জানান এ ক্রেতা।
সোনাইমুড়ি বাজারে কাপড় ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, বাজারে তাঁতে তৈরি পণ্যের চাহিদা প্রচুর ছিলো, গুণগতমান ভালো হওয়ায় বিশেষ করে নারীদের শাড়ি, থ্রি-পিস, টু-পিস, থানকাপড় ও শাল বিক্রি ছিলো লক্ষণীয়। প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার তাঁতের তৈরি পোশাক আমার দোকানে বিক্রি হতো, কিন্তু হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে দোকানের অন্য মালামালের সাথে কাপড় বিক্রিও অনেক কমতে শুরু করে। মানুষের আর্থিক সংকটের কারণে এমন সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করেন তিনি। এ বিক্রেতা আরও জানান, শপিংমল ও বড় দোকানগুলোতে বিক্রি কমলেও ফুটপাতের হকারদের স্টলগুলোতে কিছু ক্রেতা দেখা যায়।
গান্ধী আশ্রম তাঁতের খুচরা বিক্রি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মিরুপা ইয়াছমিন জানান, প্রতিষ্ঠানটির শুরুর পর থেকেই তিনি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। এ বিক্রি কেন্দ্র থেকে প্রতি পিস পাঞ্জাবি ২৫০০ টাকা, কোটি ১২০০ টাকা, কোট ৩০০০ টাকা, শাড়ি ১৪০০ টাকা, শাল ৭৫০টাকা, থ্রি-পিস ২০০০ টাকা, টু-পিস ১৫০০ টাকা, ফতুয়া ৭০০ টাকা, উত্তরীয় ৩০০ টাকা, কবি ব্যাগ ৩৫০ টাকা, গামছা ১৮০, বেডশিট ৯০০ টাকা, তোয়ালে ২০০ টাকা ধরে বিক্রি করা হয়।
আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শুরু থেকে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি ছিলো তার কিছুই এখন নেই। এক করোনার কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি আজ বন্ধের পথে। পাইকার না থাকায় বাজারে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের পরিচালক রাহা নব কুমার জানান, স্থানীয়দের আত্মনির্ভরশীলতার উদ্দেশ্যে এখানে তাঁত শিল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়, কর্মসংস্থান হয় প্রায় শতাধিক নারীর। ঢাকা থেকে সুতা এনে এ তাঁতে ব্যবহার করা হয়, এছাড়া তুলা থেকেও চরকার মাধ্যমে আমরা নিজেরা সুতা তৈরি করে থাকি। প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে আমরা সফলতার সাথে আমাদের পণ্যগুলো দেশের বড় বড় বুটিক হাউজে বিক্রি হয়। প্রায় তিনশত ধরনের কালারসেট আমাদের এখানে তৈরি করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে বুটিক হাউজগুলোর চাহিদা না থাকায় আমাদের প্রাতিষ্ঠানটি প্রায় বন্ধের পথে। তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এছাড়াও শিল্পটিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে তাঁতিদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে লোনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে শ্রমিক, কর্মকর্তা ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির খরচ হচ্ছে দেড় লাখ টাকা, কিন্তু যে পরিমাণ পণ্য তৈরি হচ্ছে তার তুলনায় লোকসানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।