ব্যাংক ও খোলাবাজারে দামের পার্থক্য, ফিরে এসেছে হুন্ডি
ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্যের প্রভাবে মহামারির সময় স্থিমিত হয়ে আসা হুন্ডি চ্যানেলগুলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পর থেকে আবারও বেড়েছে বলে ধারণা করছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদেরা।
দেশে আমদানি প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়াসহ আরও বিভিন্ন কারণে ব্যাংকগুলো বর্তমানে ডলার সংকটে ভুগছে।
ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি হারে ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করছে। খোলা বাজারেও বেড়েছে দাম।
এসব কারণে একজন প্রবাসীর বৈধ ও অবৈধ উপায়ে পাঠানো ডলারের দামের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে অন্তত ৬ টাকা। ফলে বেশি লাভের আশায় টাকা হারানোর আশঙ্কায় থাকলেও প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে।
রেমিটেন্স ও প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের রেমিটেন্সের বাজার মোটামুটি ৪০ বিলিয়ন ডলার, যার অর্ধেকই আসে অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে।
হুন্ডিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারায় দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
রাজধানীর হুন্ডি ব্যবসার নিয়ে ধারণা থাকা এক সূত্র জানান, রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকার একটি শপিং সেন্টারে দেদারসে হুন্ডি ব্যবসা হয়।
বিষয়টি সরেজমিনে দেখতে এই প্রতিবেদক গত মঙ্গলবার সেন্টারটির কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ সেন্টারে ডলার বিক্রেতা সেজে যোগাযোগ করেন। বেশিরভাগ সেন্টারই হুন্ডিতে বিদেশ থেকে টাকা আনা যাবে না বলে দাবি করেন। পরে বেশি পরিমাণ ডলার লেনদেন করা হবে জানালে ভবনটির চতুর্থ তলার একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত কর্মকর্তা নিজে থেকে প্রতি ডলার ৯১ টাকায় হুন্ডিতে লেনদেনের প্রস্তাব দেন।
তবে তিনি ডলার বা টাকা, কোনোটিরই ব্যাংক লেনদেনে আগ্রহী নন। তার শর্ত অনুযায়ী, প্রেরককে তাদের নির্ধারিত ব্যক্তির হাতে ডলার দিতে হবে। ওই ব্যক্তি ডলার বুঝে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তা তার নিজের অফিসেই প্রাপককে রেট অনুযায়ী বাংলাদেশি টাকা দিয়ে দেবেন।
হুন্ডিতে লাভ হয় কীভাবে?
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ৮৬.২০ থেকে ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬.৪৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। তবে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক জানিয়েছে তারা ডলার কিনছে ৮৫.৫০ দরে। সে হিসাবে, একজন প্রবাসী বৈধ চ্যানেলে দেশে ১০০ ডলার পাঠালে ৮৫৫০ টাকা পাওয়ার কথা।
তবে সরকারি ২.৫% প্রণোদনা যোগ ও রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রতিষ্ঠানভেদে ১-২% চার্জ বাদ দেওয়ার পর গ্রাহক পাচ্ছেন ৮৫,৯৩ থেকে ৮,৬৭৮ টাকা।
আলাদা কোনো চার্জ না থাকায় একজন গ্রাহক প্রতি ১০০ ডলারের বিপরীতে হুন্ডিতে ৯১ থেকে ৯২ টাকা দরে পাচ্ছেন ৯১০০ থেকে ৯২০০ টাকা। অর্থাৎ, অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে পাঠালে প্রতি ১০০ ডলারে ৪২২ থেকে ৬০৭ টাকা বেশি পাওয়া যায়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম টিবিএসকে বলেন, হুন্ডিতে রেমিটেন্স পাঠানো হলে ব্যাংকের চেয়ে বেশি টাকা সরাসরি গ্রাহকের বাসায় পৌঁছে যায়। এই সুবিধাটি পেতেই মানুষজন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠায়।
"ডলারের বিনিময় হার কমানো উচিত, ইফেকটিভ এক্সচেঞ্জ রেট অনেক হাই হলেও আমাদের নমিনাল এক্সচেঞ্জ রেট অনেক কম।"
"মূলত আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের বিষয়টিকে মাথায় রেখেই রেট নির্ধারণ করা হয়। এর বাড়া বা কমার সিদ্ধান্তের জন্য রেমিটেন্স বিষয়টিকে একদম পেছনের দিকে বিবেচনা করা হয়। তবে সবদিক বিবেচনা করে মনে হচ্ছে আমাদের টাকার মান সীমিত মাত্রায় অবমূল্যায়নের প্রয়োজন আছে।"
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালকমোঃ আরফান আলী টিবিএসকে বলেন, ডলার ডলার বিনিময় হার বাজারের চাহিদা ও যোগানের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।
"তাহলে বাজারে ভারসাম্য বজায় থাকবে।"
হুন্ডি কেন হয়, ডলার যায় কোথায়
হুন্ডি কেন হয় এবং বাড়ার কারণ নিয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (আরএএমআরইউ) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী টিবিএস-কে বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালদ্বীপ, ইরাকসহ বেশকিছু দেশ থেকে বৈধভাবে রেমিটেন্স পাঠানোর কোনো উপায় নেই।
আবার অনেক প্রবাসী শ্রমিক অবৈধভাবে আছেন, তারাও বৈধভাবে টাকা পাঠাতে পারেন না,বলেন তিনি।
"তাই তাদের বাধ্য হয়েই হুন্ডির আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আবার মালয়েশিয়া থেকে রেমিটেন্সের একটা অংশ সিঙ্গাপুর হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক টাকা হুন্ডি হয়ে দেশে আসে।"
হুন্ডির প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, প্রবাসী শ্রমিকরা যেখানে কাজ করেন, সেখানে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে রাখেন।
ব্যবসায়ীরা একদিকে এজেন্টদের কাছে থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে বাংলাদেশে তাদের চ্যানেলের মাধ্যমে শ্রমিকদের নির্ধারিত লোকের কাছে টাকা পৌঁছে দেন। অন্যদিকে, সংগ্রহ করা সেই মুদ্রা আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ে ব্যবহার করা হয়।
"আমাদের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং করে থাকেন। এরা হুন্ডির বাজার থেকে ডলার কিনে সেটি পূরণ করেন। সোনা পাচার, মাদকদ্রব্য কেনা-বেচাসহ অনেক অবৈধ লেনদেনেও এই হুন্ডির টাকা ব্যবহার করা হয়।"
এছাড়াও অন্য আরো কিছু উপায়ে হুন্ডি ব্যবসা হয়। বিশাল বড় চক্র এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রবাসী অধ্যুষিত সব দেশেই তাদের এজেন্ট আছে।
হুন্ডি বন্ধে এ গবেষক কর নীতিমালা সংশোধনের উপর জোর দিয়ে বলেন, সরকারের উচিত হবে কর নীতিমালা এমনভাবে তৈরি করা, যাতে হুন্ডির চাহিদা কমে আসে। চাহিদা না কমলে হুন্ডি ব্যবসায়কে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও মনে করেন হুন্ডির মাধ্যমে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা অবৈধ কাজে ব্যবহার করা হয়।
তিনি বলেন, করোনার কারণে অবৈধ কাজগুলো কিছুটা নিষ্ক্রিয় ছিল। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এগুলো আবার শুরু হয়েছে। ফলে হুন্ডির বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা অনেক বেড়েছে।
"অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে ডলারের দাম বাড়ার এটি একটি কারণ বলে ধারণা করছি। এ ক্ষেত্রে খুব বেশি উন্নতি না আসলে, তাহলে প্রণোদনা দিয়েও খুব একটা ফল আসবে না।"