১০০ বছরের প্রচেষ্টায় ম্যালেরিয়া টিকা আবিষ্কার, আফ্রিকার শিশুদের জন্য ব্যবহারের অনুমোদন
প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণার পর আবিষ্কৃত হলো ম্যালেরিয়ার টিকা। প্রাণঘাতী এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে শিশুদেরকে এই টিকা দেওয়া হবে।
শত শত বছর ধরে ম্যালেরিয়া মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় ব্যাধিগুলোর মধ্যে একটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশু এবং নবজাতকেরা এই রোগে আক্রন্ত হয়ে মারা যায়।
তবে, এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চেষ্টার পর ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে টিকা আবিষ্কার, চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতম বড় সাফল্যগুলোর মধ্যে একটি।
'আরটিএস,এস' নামক এই টিকা ছয় বছর আগেই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।
এরপর ঘানা, কেনিয়া ও মালাউইতে টিকাদানের পাইলট কর্মসূচি পরিচালনার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, এখন এটি সাব সাহারা আফ্রিকা এবং অন্য অঞ্চলেও মধ্যম থেকে উচ্চ মাত্রার ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে শিশুদের শরীরে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বুধবার টিকার অনুমোদনের পর ডব্লিউএইচও-এর মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম ঘেব্রেইয়েসাস বলেছেন, "এটি এক ঐতিহাসিক মূহুর্ত"।
তিনি বলেন, "দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ম্যালেরিয়া টিকা বিজ্ঞান, শিশু স্বাস্থ্য ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে একটি যুগান্তকারী সাফল্য। এটি প্রতিবছর লাখো শিশুর জীবন রক্ষা করবে।"
মারাত্মক পরজীবী
ম্যালেরিয়া একটি মারাত্মক পরজীবী। এটি আমাদের রক্তকোষে প্রবেশ করে তা ধ্বংস করে দেয় এবং একইসঙ্গে নিজের বংশবিস্তার করে। এই পরজীবী রক্তশোষনকারী মশার কামড়ের মাধ্যমে মানবদেহে ছড়ায়।
পরজীবী মারার ওষুধ, মশারি এবং মশা মারতে কীটনাশক- সবই ম্যালেরিয়া কমাতে সাহায্য করেছে।
কিন্তু আফ্রিকাতে এই রোগের প্রকোপ এতই বেশি যে, শুধু ২০১৯ সালেই আফ্রিকাজুড়ে ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি শিশু ম্যালেরিয়ায় মারা যায়।
ম্যালেরিয়া থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
ডা. কউমি আচিয়ানো, টিকার কার্যকারিতা যাচাইয়ে ঘানায় এই প্রকল্পের পাইলট প্রোজেক্টের অধীনে গণটিকা কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
তিনি বলেন, "এটি আমাদের জন্য একটি উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত, বড় পরিসরে টিকাদান কর্মসূচী চালিয়ে আমরা ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।"
বাচ্চাদের জীবন রক্ষাকারী টিকা
ম্যালেরিয়া পরজীবীর ১০০ টিরও বেশি ধরন রয়েছে। সদ্য আবিষ্কৃত 'আরটিএস, এস' টিকা আফ্রিকার সবচেয়ে মারাত্মক এবং সবচেয়ে সাধারণ একটি ধরন, প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম-কে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে।
২০১৫ সালে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এই টিকা ম্যালেরিয়ার ১০টি কেসের চারটিকে প্রতিরোধের সক্ষমতা রাখে; এবং গুরুত্বর কেসের ক্ষেত্রে ১০ টির মধ্যে তিনটিকে প্রতিরোধ করতে পারে।
তবে, টিকা কার্যকর হওয়ার জন্য চারটি ডোজ প্রয়োজন। প্রথম তিনটি ডোজ এক মাসের ব্যবধানে-পাঁচ, ছয় এবং সাত মাস বয়সে দেওয়া হবে এবং সর্বশেষ বুস্টার ডোজটি দেওয়া হবে ১৮ মাস বয়সে।
বুধবার ডব্লিউএইচও -এর দু'টি বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দল পাইলট প্রোজেক্টের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেন।
২.৩ মিলিয়নেরও বেশি ডোজের ফলাফল দেখায়:
- ভ্যাকসিনটি নিরাপদ ছিল এবং এটি মারাত্মক ম্যালেরিয়াকে ৩০ শতাংশ হ্রাস করতে পেরেছে;
- এটি দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি শিশুদের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে, যাদের মশারির নিচে ঘুমানোর সুযোগ ছিল না;
- অন্যান্য টিকা বা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের অন্যান্য ব্যবস্থায় এটি কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি;
- টিকাটি সাশ্রয়ী ছিল;
ডব্লিউএইচও গ্লোবাল ম্যালেরিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক ড. পেড্রো আলোনসো বলেন, "বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি একটি বিশাল অগ্রগতি; জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি ঐতিহাসিক কীর্তি। আমরা ১০০ বছর ধরে ম্যালেরিয়ার টিকা খুঁজছিলাম, এখন এটি আফ্রিকান শিশুদের জীবন বাঁচাবে এবং রোগ প্রতিরোধ করবে।"
ম্যালেরিয়া মোকাবেলা কেন এত কঠিন?
বছর ঘুরতেই যেখানে কোভিড টিকা আবিষ্কার করে ফেললেন বিজ্ঞানীরা, সেখানে আপনি হয়তো ভাবছেন ম্যালেরিয়া নিয়ে তাহলে এত সময় লাগল কেন?
ম্যালেরিয়া এমন একটি পরজীবীর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়, যা কোভিড সৃষ্টিকারী ভাইরাসের তুলনায় অনেক বেশি ছদ্মবেশী এবং পরিশীলিত। এই দু'টির মাঝে তুলনা অনেকটা একজন 'ব্যক্তি এবং বাঁধাকপির' মাঝে তুলনা করার মতো।
ম্যালেরিয়া পরজীবী আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভেদ করার ক্ষমতা রাখে। তাই সামান্যতম সুরক্ষা পাওয়ার আগেই আপনি বারবার ম্যালেরিয়ায় আক্রন্ত হতে পারেন।
ফলে ম্যালেরিয়ার টিকা আবিষ্কার মোটেই সহজ ছিলনা। মানুষ এবং মশা দুই প্রজাতির জটিল জীবনচক্রকে কেন্দ্র করে এটি তৈরি করা হয়েছে।
মূলত এই কারণেই ভ্যাকসিনটি মাত্র ৪০ শতাংশ কার্যকর। তারপরেও , এখনও এটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য এবং এটি আরও শক্তিশালী টিকা তৈরির পথকে সুগম করবে।
ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট জিএসকে এই টিকা তৈরি করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, টিকা আবিষ্কারের ফলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য ব্যবস্থা যেমন- কীটনাশক, মশারি ইত্যাদিকে এখনই প্রতিস্থাপন করা যাচ্ছে না। ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হার শূন্য লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য টিকার পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিরোধ ব্যবস্থাও চলমান রাখতে হবে।
ম্যালেরিয়া টিকা উদ্যোগ কার্যক্রমের সদস্য ডা. অ্যাশলে বারকেট, ম্যালেরিয়াকে একটি বড় এবং ভীতিকর সমস্যা বলে উল্লেখ করেন।
সেইসঙ্গে তিনি আরও বলেন, "এই টিকার আবিষ্কার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা আফ্রিকান পরিবারগুলোর ম্যালেরিয়া ভীতিকে দূর করবে।"
- সূত্র: বিবিসি