বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি প্রস্তুতকারকরা সবকিছুতেই বিনিয়োগে যাচ্ছে কেন?
মহামারির ক্রমাগত থাবায় বৈশ্বিক সরবরাহ চক্র ব্যাহত হয়েই চলেছে। সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা নিত্যদিনের বিপত্তি। পণ্য ও কাঁচামাল সংগ্রহের খরচ তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঊর্ধ্বগামী। এর গভীর প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক অটোমোবাইল শিল্পে, যার ভবিষ্যৎ হচ্ছে প্রচলিত জ্বালানির দূষণমুক্ত বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি)। কিন্তু, এসব নতুন প্রজন্মের বাহন তৈরির আবশ্যক উপাদানগুলোও সরবরাহ বিচ্ছিন্নতার শিকার। এমনকি সবচেয়ে সহজলভ্য কাঁচামালের দামও বেড়েছে। পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখতেই খনিজ সম্পদ আহরণকারী সংস্থার সাথে চুক্তি ও অংশীদারিত্বে যাচ্ছে ইভি খাতের বড় কোম্পানিগুলো। বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক গাড়ির ভবিষ্যৎ বাজার নিশ্চিতকরণ, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর একের ভেতর অনেক লক্ষ্য অর্জন করতে চায় তারা।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইভি প্রস্তুতকারক টেসলা ইনকর্পোরেশন অস্ট্রেলিয়ার খনি কোম্পানি সিরাহ রিসোর্সেস লিমিটেড- এর সাথে একটি চুক্তি করেছে। এ চুক্তির আওতায় কোম্পানিটির (যুক্তরাষ্ট্রের) লুইজিয়ানায় পরিচালিত খনির আকরিক কিনবে টেসলা। মোজাম্বিক থেকেও আসবে কাঁচামাল।
ব্যাটারি উৎপাদক কোম্পানিগুলোও হাত গুটিয়ে বসে নেই। বাজার চাহিদা মাথায় রেখে এবং সহজে ইভি উৎপাদকদের কাছে কাঁচামাল পৌঁছে দিতে তারাও উদ্যমী।
ইভির ব্যাটারি তৈরির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গ্রাফাইট অ্যানোড, এর সবচেয়ে বড় প্রক্রিয়াজাতকারক দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি- পোসকো। সম্প্রতি কোম্পানিটি চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া সিনো নিউ মেটারিয়াল টেকনোলজি কোং- এর ১৫ শতাংশ অংশীদারিত্ব কিনেছে।
হংকং পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত গ্রাফেক্স গ্রুপ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে তাদের শাখা খুলেছে। সেখানে তারা একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট তৈরির পরিকল্পনাও করছে। কোম্পানিটি জার্মান ফার্ম ডায়েসটেক জিএমবিএইচ এর সাথে ইউরোপে গ্রাফাইট উপাদান প্রক্রিয়াজাত ও বিক্রির জন্য একটি উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তিও করেছে। এভাবে একইসাথে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে সম্প্রসারিত হতে চায় কোম্পানিটি। এই দুটি বাজারেই ইভির রয়েছে বিপুল চাহিদা।
গ্রাফাইট কোনো দুর্লভ খনিজ নয়। সাধারণ হলেও উপাদানটি বিদ্যুৎ সুপরিবাহী গুণের জন্য পরিচিত। আর সেটাই কদর বাড়িয়েছে বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ব্যাটারি উৎপাদকদের কাছে। প্রকৃতিতে সহজলভ্য এই উপাদানের সরবরাহ আগেভাগে আয়ত্তে রাখার চেষ্টাগুলো প্রমাণ করছে যে, শুধু লিথিয়াম ও কোবাল্টের মতো দুর্লভ ও দামি খনিজে নয়; সরবরাহ চক্রে ব্যাঘাত অচিরেই বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পের সব উপকরণে পড়বে।
এই চাপ এমন সময় ধেয়ে আসছে যখন টেসলার মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলো বিক্রি করছে রেকর্ড পরিমাণ বৈদ্যুতিক গাড়ি।
গেল বছর জুড়ে লিথিয়াম কম্পাউন্ড ও স্পোডুমিন থেকে শুরু করে পিভিডিএফসহ সব ধরনের ব্যাটারি তৈরির খনিজের দাম তিনগুণ বেড়েছে। এখন দামের চাপ গ্রাফাইটের মতো উপাদানেও পড়তে শুরু করেছে।
গ্রাফাইট এক ধরনের কার্বন, যা ইভির পাওয়ারপ্যাকে অ্যানোড বা ঋণাত্মক টার্মিনাল তৈরির অপরিহার্য উপাদান। ইস্পাত ও পরমাণু শিল্পেও চাহিদা রয়েছে এটির। গ্রাফাইটের ৯০ শতাংশ উৎপাদন হয় চীনে।
অথচ, বিশ্বের কারখানা হওয়ায় মহামারির অভিঘাতে চীনই সরবরাহ বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে বড় শিকার। দেশটিতে অধিকাংশ গ্রাফাইট উৎপাদন কেন্দ্র থাকায় আগামীতে চালান আসতে সময়ক্ষেপণও বাড়বে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে চীন সরকারের কঠোর নীতি আগামীতে সরবরাহ বিচ্ছিন্নতাকে নতুন মাত্রা দিবে এমন আশঙ্কাও রয়েছে, কারণ দেশটির তিয়ানজিয়ানের মতো শিল্পাঞ্চলে ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
ব্লুমবার্গ-এনইএফ এর তথ্যানুসারে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশটি বেশিরভাগ গ্রাফাইট ইলেকট্রোডেরও উৎপাদক। তারপরেই রয়েছে জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র।
এর আগে বৈদ্যুতিক যানের নতুন প্রজন্মের ব্যাটারির জন্য দরকারি উপাদান ক্যাথোড যৌগ ধাতু, যেমন নিকেল কোবাল্ট ম্যাঙ্গানিজ ও লিথিয়াম আইরন ফসফেট সংগ্রহে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে তুলনায় অ্যানোডের রাসায়নিক মিশ্রণে মনোযোগ দেয়নি অধিকাংশ সংস্থা। তবে গ্রাফাইট ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ইভি বাজারে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে থাকবে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ-এনইএফ।
ইভি বিক্রিবাট্টা জমজমাট থাকায় এবং এই বাণিজ্যের টেকসই ভবিষ্যৎ থাকায় সরবরাহ চক্রের গ্রাফাইট খাতকেও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
গ্রাফাইট প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, আবার কৃত্রিমভাবেও উৎপাদন করা যায়। তবে সহজে পরিবর্তনশীল না হওয়ায়, এটি প্রক্রিয়াতে খরচের চাপ পড়ে। বিগত কয়েক বছরে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত গ্রাফাইটের দাম মানভেদে ৬-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
চীনের উৎপাদকরা গ্রাফাটাইজেশন প্রক্রিয়ার খরচ ১৫-২০ শতাংশ কমিয়ে আনা সত্ত্বেও হয়েছে এই বৃদ্ধি। বাড়তি ব্যয়ের মূল অংশই যাচ্ছে কাঁচামাল সংগ্রহে। এই বাস্তবতায় প্রস্তুতকারকরা উৎপাদন সক্ষমতা সম্প্রসারণের পাশাপাশি মূল্য কম না রাখতে পারলে, ব্যাটারির দামও বাড়তেই থাকবে। যার ধাক্কায় কমতে পারে বৈদ্যুতিক গাড়ির বেচাকেনা।
অটোমোবাইল ও ব্যাটারি প্রস্তুতকারকসহ ইভি বাজারের বড় অংশীদাররা আপাতত দরকারি খনিজ নিশ্চিত করার উদ্যোগে ধীরে-সুস্থেই আসছে। এর অন্যতম কারণ, তারা জানে দরকারি কাঁচামালের সরবরাহ সুলভ মূল্যে পাওয়া না গেলে, আগামীতে তারা বাজার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তাই ভবিষ্যতের অনেকগুলো বছর সামনে রেখে তাদের খনিজ খাতেও বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করতে হবে। নাহলে শুধু নতুন গাড়ির মডেল আর ব্যাটারি প্রযুক্তি আবিষ্কার করে জয় আসবে না বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতিযোগিতায়।
অতীতে গ্রাফাইটের মতো মূল উপাদানের সহজলভ্যতাই স্বাভাবিক ধরে নিয়ে এখাতে বিনিয়োগকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছিল। সেই বিভ্রম ভেঙে দিয়েছে সরবরাহ চক্রের সংকট। বোঝাই যায়, আরো দীর্ঘসময় থাকবে এই বিচ্ছিন্নতা। বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারকদের খনি শিল্পে বিনিয়োগ সেই চিন্তাধারা থেকেই উদ্ভূত টেকসই ব্যবসায়ীক কৌশলের বাস্তব প্রতিফলন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ