সব চাটুকারই মার্সেনারি!
মার্সেনারি ল্যাটিন মার্সেনারিয়াম থেকে উদ্ভূত; এর মানে পয়সাকড়ির বিনিময়ে কাজ করে দেয় এমন কেউ; কেবল বেতনের জন্য, ব্যক্তিগত লাভের জন্য কাজ করে নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন অবান্তর। মার্সেনারি মানে ভাড়াটে গুন্ডা, ভিন্ন কোনো দেশের জন্য ভাড়ায় খাটা যোদ্ধা।
ইংরেজির বিভিন্ন অভিধানে মার্সেনারি ভাড়াটে সৈন্যের বাইরে আরও যেসব পেশা ও মানসিকতা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে অভিযাত্রী, সুযোগসন্ধানী, স্ট্যান্টবাজ, জলদস্যু, বেপরোয়া, জুয়াড়ি, নায়ক ভাবাপন্ন, মুনাফাখোর, নিপীড়ক, চটকদার, অবিশ্বাসী, শোষণকারী, ধাপ্পাবাজ, সন্দেহভাজন, অবিশ্বাসী, অনৈতিক, দ্বিমুখী, বিশ্বাসঘাতক, ছদ্মবেশী, দখলদার, পেটুক, সন্ত্রাসী, ঈর্ষাকাতর, স্বার্থপর, সর্বভুক, লোভী, আক্রমণকারী, যুদ্ধমান, প্রতিযোগী, গ্ল্যাডিয়েটর প্রতিদ্বন্দ্বী, লুটেরা, ঘাতক, ঝগড়াটে, বিভাজন সৃষ্টিকারী, অসৎ, অনৈতিক, ক্ষুদ্রমনা, কুখ্যাত, ঘৃণ্য, দানবিক, ভিলেন, দূষিত, বিকৃত, পাপদগ্ধ, অসম্মানজনক, ক্ষুদ্রমনা, স্বকাজ, লজ্জাজনক, অযোগ্য, অপেশাদার, নির্লজ্জ, পেশাদারী যৌনাচারী ইত্যাদি।
সমাজতন্ত্র কায়েমের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া ভিন্ন দেশে সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা গত শতকের তারুণ্যের হৃদয় হরণ করা চে গুয়েভারাও কি তাহলে মার্সেনারি?
মরিন ও'হারা লিখেছেন, আমি যখন হাভানায় ছিলাম, চে গুয়েভারার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, তিনি খুব সামান্যই মার্সেনারি, অনেক বেশি স্বাধীনতা যোদ্ধা। খেলোয়াড়েরা কি মার্সেনারি? ব্রাজিলের পেলে কিংবা গ্যারিঞ্চা? আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা কিংবা মেসি? উত্তর যতটা হ্যাঁ, তার চেয়ে বেশি না। এটা সত্য, অর্থযোগ এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দেশপ্রেম ও দেশের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্যও তার চেয়ে কম কিছু নয়। ফ্রান্সের বিশ্বাকাপ ফুটবল দলের পরিচিতিই হয়ে গেছে আফ্রিকান টিম: তাদের কারও জন্ম কিংবা কারও মা-বাবার জন্ম আফ্রিকার কোনো দেশে। সেই দেশের বিরুদ্ধে খেলায় আনুগত্য বিসর্জন না দিলে তো আর ফ্রেঞ্চ টিমে টিকে থাকা যাবে না।
মার্সেনারি যে পেশাতেই হোক, তার বেলায় টাকার থলে কথা বলে, আত্মা হয়ে থাকে নির্বাক। ইভান রাইট মার্সেনারিকে যোদ্ধা ভেবেই লিখেছেন: সত্যিকারের সৈনিক অন্যকে সেবা করে, কখনো নিজেকে নয়। আর মার্সেনারি তো বন্দুক হাতে এক গুন্ডা।
ডাচ লেখক জাভিয়ারা হলান্ডার (জন্ম ১৮ জুন ১৯৪৩) তার বেস্টসেলার গ্রন্থ 'দ্য হ্যাপি হুকার, মাই অওন স্টোরি' লিখে বিশ্বখ্যাত। তার জীবনের শুরুটা জাপানি বন্দিশিবিরে। ১৯৬৮ সালে তিনি দেহ ব্যবসায় নামলেন এবং নিউইয়র্কের নামকরা যৌনকর্মীদের একজন হয়ে উঠলেন। তার রেট ছিল রাতপ্রতি ১০০০ ডলার (বর্তমানে প্রায় ৯০০০ ডলার)। তার মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাব ছিল, আরও অধিকসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থানের জন্য ভার্টিকাল হৌর হাউস নামে একটি আকর্ষণীয় পতিতালয় খুলে নিউইয়র্কের একজন প্রভাবশালী ম্যাডাম হয়ে বসলেন। ১৯৭১-এ নিউইয়র্ক পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করে। সে বছরই তিনি লিখলেন 'দ্য হ্যাপি হুকার'; বিক্রি ২ কোটি ছাড়িয়ে গেল। তার কাহিনি নিয়ে তিনটি সিনেমা হলো।
জাভিয়ারা হলান্ডার লিখেছেন: আমার সেরাটা দিই টাকার বিনিময়ে। আমাকে মার্সেনারি বলো আর ম্যাডাম বলো, সমস্যা নেই।
চলচ্চিত্রকার জেমস ফ্রে লিখেছেন, আমি যখন চিত্রনাট্য লিখতাম, আমি মার্সেনারি ছিলাম।
জর্জ হার্বার্টের কথা: মার্সেনারির অন্তর থেকে পুণ্য পালিয়ে যায়।
বিল মায়ার্স একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন: গণতন্ত্র (কথিত) যখন তার নিজের তৈরি করা সমস্যার সমাধান করতে পারে না, তখনই খেলা শেষ। জনতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার নিয়মিত বাহিনীর সাথে হরেক রকম মার্সেনারি বাহিনীও নামাতে শুরু করে। বাংলদেশ, পাকিস্তান ও ভারত এর সাক্ষ্য দেবে।
মার্সেনারি ক্রাইম শুরু হলে জনগণ অসহায় হয়ে পড়ে। ভাড়াটে অপরাধী লালন করতে রাষ্ট্রকে আয়কর বেশি আদায় করতে হয়।
আরেক ধরনের মার্সেনারি আছে, চাটুকার— এরাও সব অর্থে মার্সেনারি। সোজাসুজি চাটুকার মাত্রই মার্সেনারি। তাই যদি হয়, মার্সেনারি সম্পর্কে হাতেকলমে জ্ঞান নেবার উত্তম স্থান বাংলাদেশ! সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নানা সংগঠনের সভা সমিতির বক্তৃতায়, আলোচনায় দু-চারজনের বক্তৃতা শুনলে চাটুকারবৃত্তির চূড়ান্ত রূপ দেখা যাবে নিঃসন্দেহে। অবিশ্বাস্য সব উপমা এবং বিশেষণ ব্যবহারে মন্ত্রী-মিনিস্টার-ব্যবসায়ী-সাংবাদিক কেউই কম যান না। অ্যারিস্টটল মানুষের এই চরিত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বলেই লিখে গেছেন: অষষ ভষধঃঃবৎবৎং ধৎব সবৎপবহধৎু, ধহফ ধষষ ষড়ি সরহফবফ সবহ ধৎব ভষধঃঃবৎবৎং.
সব চাটুকারই মার্সেনারি; সব হীন মানসিকতার মানুষই চাটুকার। সব অপরিমিত বিশেষণ, অবিশ্বাস্য উপমা ব্যবহারকারী মাত্রও মার্সেনারি— এটা নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যায়। এদিক দিয়ে চাটুকারবৃৃত্তিতে বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্যদের চেয়ে সব সময় এগিয়ে থাকবেন। নাট্যকার মলিয়ার এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন: মার্সেনারি স্বার্থের প্রশ্নে তারা অবশ্যই অন্যদের ডিঙিয়ে যাবেন।
মার্সেনারি স্বার্থকে ধর্ম কোন চোখে দেখছে? রবার্ট ব্যারন লিখেছেন: 'বাইবেল সর্বক্ষণ মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছে ঈশ্বরের সাথে যেন মার্সেনারি সম্পর্ক না হয়। ঈশ্বরের সাথে নিজের স্বার্থের কিংবা সুবিধার সম্পর্ক নয়। কেবল আমাদের উপকার হবে, আমরা সান্ত্বনা লাভ করব এ জন্য যেন ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি না করি। লাভের বিষয় বিবেচনায় না এনে আমরা ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কিত হব।
মিখাইল বুখানিন বুর্জোয়া দেশপ্রেমকে বলেছেন মার্সেনারি প্যাট্রিয়টিজম আর ভলতেয়ার যেকোনো ধরনের স্বৈরাচারী শাসককে দেখেছেন মার্সেনারি টাইর্যান্টস হিসেবে।
প্যাট্রিক ও'ব্রায়ানের মতে, মার্সেনারি পেশা হচ্ছে ওকালতি, যে পক্ষ পয়সা দেবে, তার পক্ষেই উকিল দাঁড়াবেন এবং লড়বেন। ব্যতিক্রম কিছু নেই, এমন নয়, কিন্তু ব্যতিক্রম তো মৌলিক চরিত্র বদলে দিতে পারে না।
মার্সেনারি লেখকের কমতি নেই বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যেও। মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কবিতা লিখেছেন: এতে তার প্রাপ্তিযোগ কী ঘটেছে, গবেষণার বিষয়।
মার্সেনারি লেখক এক ধরনের গোলাম লেখকও বটে। কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছিলেন 'পাকিস্তানের অভাব কি'; এটার প্যারোডি হয়েছিল— 'পাকিস্তানের অভাব কি ভাই, পাকিস্তানের অভাব কি, ঢাকায় আছে গোলাম কবি পাকিস্তানের অভাব কি?' গোলাম মোস্তফার কপাল খারাপ, এক কবিতাতেই বড় ধরনের ধরা খেলেন। আবার অন্য এক কবি 'হে মহান নেতা হে মশালধারী হে অমর প্রাণ, নির্ভীক মহাপ্রাণ' নামের অন্তত দু'হালি জিন্নাহ বন্দনা লিখেও ভাগ্যগুণে গোলাম কবি না হয়ে নন্দিত রয়ে গেলেন।
অলিভার মিলার আমেরিকা অন লাইনের (এওএল) ভাড়াটে লেখক ছিলেন। ২০১১ সালে চাকুরিচ্যুত হয়ে 'কনফেশন অব দ্য মার্সেনারি রাইটার' লিখেছেন। বছরের পর বছর ধরে যারা সরকার বন্দনায় দোয়াতের কালি উজাড় করে ফেলেছেন (একালে বলপয়েন্ট কালিশূন্য করেছেন, কি-বোর্ড চেপে প্রশস্তি কাব্য রচনা করছেন), তাদের সকলেই মার্সেনারি লেখক।
বাংলাদেশের কবি রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কাব্যগ্রন্থ 'কণক প্রদীপ জ¦ালো' যখন প্রকাশিত হলো, দুষ্টজনেরা বলাবলি করেছেন কবিতাগুলো লিখেছেন সৈয়দ আলী আহসান আর ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সৈয়দ নাজিমুদ্দিন হাসেম। আমি সৈয়দ আলী আহসানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরশাদের কবিতাগুলো নাকি আপনার লেখা?
তিনি আমাকে কিছুটা প্রশ্রয় দিতেন বলেই এ প্রশ্ন করতে পেরেছি। জবাবে তিনি বলেছেন, 'মূর্খ! ওগুলো কবিতা হয়েছে? আমি লিখলে কবিতা হতো।'
'উত্তম সম্মানীর বিনিময়ে আমিও মার্সেনারি লেখক হতে রাজি আছি'— কয়েক বছর আগে আমার কথাটি পত্রিকায় ছাপা হলেও লেখক যশপ্রত্যাশী কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেননি। নিশ্চয়ই আমার চেয়ে উত্তম কাউকে পেয়ে গেছেন।
বারবারা ফিনম্যান টড প্রেতলেখক বা মার্সেনারি লেখক হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের আত্মজীবনী লেখায় শরিক হয়েছিলেন। কিন্তু বারবারা প্রতিশ্রুত মার্সেনারি-প্রাপ্তির সবটুকু না পাওয়ায় সংবাদমাধ্যমে হিলারিকে ধোলাই করেছেন। একালের মার্সেনারি লেখকও করপোরেট সাংস্কৃতিক চরিত্রের হয়ে থাকেন। আমার 'আইআইপি' (ইন্টেলেকচুয়ালি ইম্পর্টেন্ট পার্সন) নামের প্রকাশিত উপন্যাস এক মার্সেনারি কবিরই বয়ান।
দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে এত যে বড় বড় কথা আমরা বলে থাকি, সার্ধশত বছরেরও বেশি আগে মহান লেখক লেভ তলস্তয় কথিত দেশপ্রেমের কবর দিয়ে লিখে গেছেন; দেশপ্রেম হচ্ছে দাসত্ববৃত্তি। সরকারের মার্সেনারি উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য দেশপ্রেমের ধুয়া তুলে তরুণদের যুদ্ধে ডেকে আনে, মিথ্যার পেছনে ছুটে তারা অকাতরে জীবন বিসর্জন দেয়।