মোল্লার দৌড়
অল্প বয়সে আব্বার কাছে পড়তে বসা ছিল বিভীষিকা। সন্ধ্যের পর আমাদের বাড়িতে সাধারণত অতিথি আসত না। নাটক-সিনেমা না দেখে সন্ধ্যার বিশ্রম্ভ-কাল কঠোর তত্ত্বাবধানে আমাদের পড়াত আব্বা। ইংরেজি-অঙ্ক-হাতের লেখা- বাড়ির কাজ-পরিবেশ পরিচিতি কিছুই বাদ পড়ত না। প্রথমেই আব্বা খুঁজত কী করে আমাদের দুই ভাইবোনকে একচোট ধোলাই দিয়ে নেয়া যায়। আসলে ভাগ্যদোষে আমিই আব্বাকে মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটা গল্প পড়ে শুনিয়েছিলাম। হোজ্জার মেয়ে কুয়োয় ঘটিতে করে পানি তুলতে যাচ্ছে, যাওয়ার আগেই হোজ্জা লাগিয়েছে এক চড়। মেয়ে তো হতবাক, কুয়োয় যায়নি এখনো, ঘটি ফেলে দিয়ে হারিয়েও ফেলেনি, তাহলে কিসের জন্য এমন চড়? হোজ্জা জবাব করেছিল, 'ঘটি হারালে চড় দিয়ে আর কী হবে, আগেভাগে চড় দিয়ে রাখলে ভয়ে তুমি ঘটি হারাবে না!' গল্পটা আব্বার খুব মনঃপূত হয়েছিল, আব্বাও তেমনি রীতিতেই বিশ্বাস করত। ভাই নিচু গলায় আমাকে প্রায়ই বলত, 'আর কোনো গল্প শোনাতে পারলি না?' আজ যা লিখব, সেটা মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে নিয়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতির গল্প, হোজ্জাকে নিয়ে বিশদ গবেষণা এত অল্প পরিসরে সম্ভবও নয়, আমি সে কাজের যোগ্য ব্যক্তিও নই।
আমাদের প্রথম হোজ্জার বইটি কার সংকলিত ছিল, ঠিক মনে নেই; সম্ভবত লেখকের নাম ইফতেখার রসুল জর্জ, নওরোজ সাহিত্য সম্ভার থেকে বের করা বই। প্রাইমারি ক্লাসের দুরবগাহ স্মৃতি থেকে লিখছি, ভুলচুক হলে ক্ষমা-ঘেন্না করে দেবেন। এরপর বাড়িতে এল 'মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প', সেটা সত্যজিৎ রায়ের। গোলাপি প্রচ্ছদে মোল্লা দুহাত বাড়িয়ে ধরেছেন আপামর পৃথিবীর দিকে (তুর্কি, ফার্সি, আলবেনীয়, আর্মেনীয়, আজারবাইজানীয়, আফগান, বসনিয়ান, বুলগেরিয়ান, কুর্দি, রোমানিয়ান, সার্বীয়, রুশ... কত জাতের লোককথার চরিত্র হিসেবে মিশে আছেন তিনি, কতই না উন্মুক্ত তাঁর আলিঙ্গন), নাকটা টিয়েপাখির চঞ্চুর মতো, মুখ টেপা কিংবা ওটা মুচকি হাসি, মাথায় মস্ত পাগড়ি। সত্যজিৎ রায়ের বইটির ফ্ল্যাপে লেখা—'মোল্লা নাসিরুদ্দীন যে ঠিক কেমন লোক ছিলেন সেটা তাঁর গল্প পড়ে বোঝা মুশকিল। এক এক সময় তাঁকে মনে হয় বোকা, আবার এক এক সময় মনে হয় ভারী বিজ্ঞ। তোমাদের কী মনে হয় সেটা তোমরাই বুঝে নিও।' নিলাম। দেশ-এ প্রায়ই মোল্লা নাসিরুদ্দিনের চুটকি বের হতো। ওই পাতাটুকুন পড়বার অনুমতি পেতাম। দূরদর্শনে মোল্লার কাহিনি দেখানো হতো।
তখন তো হাসিরই বয়স, হাসতে ভালোবাসতাম আমরা। ঠগ আর বাটপারের গল্প পড়ে হাসতাম, বাঙালির হাসির গল্প পড়ে হাসতাম। অমর চিত্রকথার বীরবল ভারি চৌকস, গোপাল ভাঁড় বড্ড ভাঁড় আর মাঝেমধ্যে ভারি অশ্লীল, মোল্লা নাসিরুদ্দিন দিব্যোন্মাদ—যেন পাগলা দাশু বয়স্ক হলে এমনটি হবে। দুষ্টুমির ভাঁজে ভাঁজে পাগলামি, পাগলামির তলায় প্রজ্ঞা। শিশুকে যে অ্যাবসার্ড টানে, তার সাক্ষী হোজ্জার প্রতি আমাদের পক্ষপাত। খোদার হাতে হোজ্জা বাড়ি পাহারার সব ভার দিয়ে কোথাও রওনা হয়েছেন, ফিরে এসে দেখলেন বাড়ির সর্বস্ব চুরি গেছে, এমনকি দরজার পাল্লাটা অব্দি খোয়া গেছে। তিনি সোজা চলে গেলেন ইবাদতখানায়, তার দরজা খুলে এনে বাড়িতে লাগালেন। উপরঅলা দায়দায়িত্ব পালন করেননি, তাই তার ঘরের দরজা নিয়ে এসে মোল্লাবাড়িতে লাগানোই সমীচীন। হেসে গড়াগড়ি দিতাম আমি আর ভাই। খোদার সঙ্গে অমন না হলে কি আর খোদা আপন হতে পারেন! মাথার মাপের চেয়ে বড় পাগড়ি, আর গাধার পিঠে উল্টো সওয়ার মোল্লা, আমাদের ছোটবেলার চনমনিয়া স্মৃতির অংশ হয়ে রইলেন।
ভাবুন সেই গল্পটার কথা, বাজার থেকে মোল্লা এক সের গোশত এনে বউকে বলেছেন কাবাব করতে, বেশ পেট পুরে খাবেন তিনি। রান্না করতে করতে খুশবু ছুটেছে খুব, লোভে লোভে হোজ্জার বউ কাবাব চাখতে গিয়ে পুরোটাই খেয়ে ফেলেছেন। হোজ্জা এলে বউ বল্লেন—'বেড়ালটা সব মাংস খেয়ে গেছে।' ডাকো বেড়ালকে! হোজ্জা বেড়ালটাকে পাল্লায় চাপিয়ে দেখলেন বেড়ালের ওজন এক সের (এই গল্পের অলংকরণ দেখে আমরা যে কত হেসেছি!), জিজ্ঞেস করলেন—'এটাই যদি সেই বেড়াল হয়, তবে মাংস কোথায়? আর এটাই যদি সেই মাংস হয়, তবে বেড়াল কোথায়?' সত্তর-শেষ আশির দশকে যারা আমরা একের পর এক স্বৈরশাসকের ছায়ায় বড় হয়েছি, তাদের মনে রাষ্ট্রনায়ক আর রাষ্ট্র নিয়েও এমন হরেক প্রশ্ন উপস্থিত হতো।
এই মোল্লা নাসিরুদ্দিন কিন্তু বাদশাহর ধার ধারেন না। চটেমটে বাদশাহকে তিনি 'অপয়া' বলে বসেন, 'আমায় দেখে আপনি ছাব্বিশটা হরিণ মারলেন, আর আপনাকে দেখে আমি বিশ ঘা চাবুক খেলাম। অপয়া যে কে, সেটা বুঝতে পারলেন না?' সারা দেশে ফরমান জারি হলো, যারা বউকে ডরায় তারা হোজ্জাকে কর দেবে। মোল্লা দেখলেন, সবাই দেয় শুধু বাদশাহ দেন না। হোজ্জা বাদশাহর কাছে এসে গলা চড়িয়ে তুরানদেশের হুরীর বর্ণনা দিতে শুরু করলেন—গোলাপের মতো ঠোঁট, ঝিনুকের মতো কান! বাদশা যতই বলেন, 'আস্তে বলো হোজ্জা', হোজ্জা ততই গলা চড়ান। শেষে বাদশাহ কাতর গলায় বললেন, 'আস্তে বলো হোজ্জা, বেগম শুনতে পেলে সর্বনাশ হবে।' অম্লানবদনে হোজ্জা বললেন—'কাল থেকে আপনি আমায় কর দেবেন।' বাদশাহ তাঁকে পাঠালেন ভাল্লুক শিকারে, শিকারফেরত হোজ্জা বললেন, 'ভারি চমৎকার শিকারের অভিজ্ঞতা হলো।' হোজ্জা না ভাল্লুক মেরেছেন, না ধাওয়া করেছেন, এমনকি একটা ভাল্লুক চর্মচক্ষেও দেখেননি। তাহলে চমৎকার কিসে? 'ভাল্লুক শিকার করতে গিয়ে জানোয়ারের দেখা না পাওয়ার চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে?' কোথাও কোথাও উল্লেখিত রয়েছে, এই বাদশা নাকি স্বয়ং তৈমুর লং।
হোজ্জার গল্পগুলো খুব ছোট ছোট, শেষ হবার পর অনেক সময় শিক্ষণীয় কিছু ছিল কি না, তা বোঝা যায় না। কিন্তু সেই ধাঁধাই যেন পাঠককে ছুটিয়ে নেয়। তুবড়ির ফুলকি যেমন অন্ধকার আকাশে আলপনা এঁকেই নিঃশেষ হয়ে যায়। যেমন ধরুন, গাঁয়ের লোকে ভাবল—হোজ্জাকে শায়েস্তা করবে। মশকরা করবে বলে তারা হোজ্জাকে বলল—'আমাদের কিছু তত্ত্বকথা শোনান।' নির্দিষ্ট দিনে হোজ্জা মসজিদে তত্ত্বকথা শেখাতে হাজির হলেন, জিজ্ঞেস করলেন—'ভাইসকল, তোমাদের আমি কী শেখাব, তোমরা কি তা জানো?' গাঁয়ের লোকে ভান করে বলল—'আমরা তো কিছুই জানি না!'
'এত অজ্ঞ লোককে আমি আর কী শেখাব!' বলে হোজ্জা গটগটিয়ে মসজিদ থেকে ফিরে গেলেন।
গাঁয়ের লোক নাছোড়বান্দা, তারা পরের জুমাবারে আবার ডেকে আনল হোজ্জাকে। হোজ্জা যখন জিজ্ঞেস করলেন—'তোমরা কী শিখবে জানো?' সেয়ানার দল জবাব দিল—'খুব জানি!' হোজ্জা বললেন, 'তবে আর আমার শিখিয়ে কী লাভ!' আবার চলে গেলেন। এইবার গাঁয়ের লোকে আবার ডাকল হোজ্জাকে। হোজ্জা এসে একই প্রশ্ন করলেন, বুদ্ধি খাটিয়ে গ্রামের অর্ধেক লোক জবাব দিল—জানি, অর্ধেক বলল—জানি না! হোজ্জা নিমেষে সমাধা করে দিলেন—'যারা জানো, তারা বাকি যারা জানে না, তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে দাও।' মনে আছে আমাদের সেই হোজ্জা সংকলনে এই গল্পটা পড়ে উত্তরের ঘরে ছোট ফুফু হাসতে হাসতে কুটিকুটি হতো। সাধে কি আর দার্শনিকেরা হোজ্জাকে ডেকেছেন—'অতুলনীয় গুরু'!
একটু বড় হবার পর ভাবতাম, লোকটা কাজির মতো সাংঘাতিক বুদ্ধিমান আবার ভিলেজ ইডিয়টের মতো আকাট বোকা, কী করে এমন সম্ভব? নিজেকে স্বার্থপরের মতো ভালোবাসলে কি আর অমন সেলফ-মকারি সম্ভব? কিপ্টেমির পাশেই অমন সাধুজনোচিত ঔদাসীন্য? স্যাটায়ারের সঙ্গে পাপ-পুণ্যবোধের এমন ঘোরতর মিলমিশ? দুহাত বোঝাই করে কাচের সামগ্রী বয়ে নিয়ে যেতে যেতে হোজ্জা একদিন হোঁচট খেলেন, সব কাচের জিনিস ভেঙে গেল, লোক জড়ো হয়ে গেল তামাশা দেখতে, হোজ্জা রেগে উঠে বললেন—'ওহে, জীবনে তোমরা বেকুব দ্যাখোনি?' উজবেকরা তাঁকে বলে—ওয়াইজ-ফুল, তথা পণ্ডিতমূর্খ, যিনি পণ্ডিত তিনিই মূর্খ। হোজ্জা আসলেই পরস্পরবিরোধী কমপ্লিমেন্টারি রঙের সম্মিলন। এ যেন জীবনানন্দ দাশের সেই 'অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত তিমির'—আলোর ভেতরের প্রগাঢ় ছায়া, জলরঙে আঁকা ফটফটে আলো মানে যেমন আসলে রং না করা ফাঁকা স্থান...ও রকম কিছু।
হোজ্জার অনেক গল্প বীরবলেও আছে, তেনালি রামনেও আছে, শেখ সাদীর গল্পেও আছে, ঈশপের গল্পে আছে। আমার তো ক্যান্টারবেরি টেইলের ছোঁয়াও হোজ্জায় আছে বলে মনে হয়। অহিভূষণ মালিকের অলংকরণে আনন্দমেলায় কিছু চুটকি বের হতো, তার ভেতর বেশ কিছু হোজ্জার গল্পের ছায়া ছিল। ছোটবেলায় আমরা ত্রিশের দশকে পাবলিশড কিছু গ্রামার বই পড়তাম, সেখানে একটি ছোট্ট গল্প পড়েছিলাম, শিরোনাম ছিল—'উইট ক্যান গেইন অ্যান অ্যাপেটাইট'। সেই গল্পের দরিদ্র লোকটির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে হোজ্জার ভারি মিল। তা লোককথা ছড়ায় বলাকার পালকের মতো, বাতাসে ভর করে ছোটে। কে জানে এই হোজ্জা কবেকার, তিনি আসলে কোন দেশের? তুর্কিরা বলে, তিনি সেলজুকদের আমলে তুরস্কের মধ্য আনাতোলিয়ার হোর্তু গাঁয়ে জন্মেছিলেন; চীনারা ভাবে, তিনি উইঘুরের মুসলিম, উজবেকরা বলে, তিনি বুখারার। তা চীনের চা-খানা থেকে হাঙ্গেরি হয়ে সাইবেরিয়া গিয়ে আবার উত্তর আফ্রিকা অব্দি কোথায় তিনি নেই?
কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তা বলেন, হোজ্জা বলে আসলে কেউ ছিল না, তিনি লোককথার সৃষ্ট চরিত্র। আবার কেউ বলেন, তিনি আসলে আহি এভরিন নামক এক ব্যবসায়ী, মোঙ্গল বহিঃশত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আরবরা নাকি বিশ্বাস করে মোল্লার আসল নাম আবু আল গুসন দুজাইন আল ফিজাজি। কেউ বলেন, তিনি নাসির উদ-দীন মাহমুদ আল-খয়ী, হেরাতের কোরআন মুফাসসির ফখর আল-দীন আল-রাজির শিষ্য, বাগদাদের খলিফা তাঁকে মোঙ্গলদের শায়েস্তা করতে আনাতোলিয়ায় পাঠান। তিনি খয়জারিতে কাজি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বৈরুতে লোকে তাঁকে সুফি সাধক হিসেবে মান্য করে, ব্রিটিশ ওরিয়েন্টারলিস্টরা আবার সেই সুফিত্ব স্বীকার করে না।
লোককাহিনির হোজ্জা অবশ্য কখনো দাস, কখনো কাজি, কখনো বাদশাহের মোসাহেব। নির্বিকার নিরুদ্বেগ হোজ্জা কখনো বাজারে গিয়ে তর্ক করছেন, কখনো হাম্মামখানায় শরীর দলাইমলাই করে আসছেন। তাঁর একটা বউ আছে, বউটিকে তিনি ভালোবাসেন—এমন দুর্নাম তাঁকে দেয়া যায় না। বন্ধুর প্রতিও তাঁর যে ভারী স্নেহ রয়েছে, তা-ও নয়, ভারী কিপ্টে লোক—প্রতিবেশীকে গাধা ধার দেয়া দূরে থাক কাপড় শুকোবার দড়িটাও ধার দেন না। আর ছেলেমেয়ের সঙ্গে এই সেলজুক সুফি হোজ্জা কেমন, তা তো শুরুতেই বলেছি। ইদ্রিস শাহ তাঁর নাসিরুদ্দিন হোজ্জা-সংক্রান্ত বইয়ে লিখেছেন, কথিত আছে, বালক হোজ্জা খুব গল্পবলিয়ে ছিলেন, সহপাঠীরা পড়া ফেলে হোজ্জার গল্প শুনত, পড়ার সময় নষ্ট হতো। হোজ্জার ওস্তাদ বিরক্ত হয়ে তাঁকে শাপ দিয়েছিলেন, 'যতই বিজ্ঞ হও না কেন, লোকে তোমায় নিয়ে চিরদিন হাসবে!' হোজ্জার জ্ঞান খানিকটা ওই আলোর পিদিমের মতো, যা তিনি বয়ে চলতেন পথে, কিন্তু চা-খানায় দেমাগ করে বলতেন—আমি আঁধারে দেখতে পাই। তোমরা যদি হোঁচট খাও, তাই আমার আলো বইতে হয়!' জুতো চুরির ভয়ে বিয়েবাড়িতে জোব্বার পকেটে জুতো রেখেছিলেন, লোকে ভেবেছিল—ওটা বই, হোজ্জা যেহেতু জ্ঞানী লোক। জিজ্ঞেস করেছিল—'ওটা কী বই মোল্লা সাহেব?' চোরের ভয়ে পকেটে জুতো বয়ে বেড়াচ্ছেন, এমন কথা স্বীকার করতে হোজ্জার বাধছিল, তিনি বললেন—'ওই বইটার নাম "দূরদর্শিতা"।'
—তা বটে, তা বটে। কোন কিতাবখানায় পেলেন?
—মুচির কাছে।
ওইটাই হোজ্জার বিচক্ষণতার নমুনা, দেখতে দেখায় লুকোনো জুতোর মতো অথবা বইয়ের মতো। চিন্তামগ্ন হোজ্জা পথে চলেছেন, রাস্তার ছোকরারা তাঁকে ঢিল ছুড়ছে; বাজারে হরবোলা ময়নার অত দাম দেখে নিজের দামড়া মোরগটাকে বেচতে গেছেন হোজ্জা—দুটো কথা বলা ময়নার যদি অত দাম হয়, ভাবনায় নিমগ্ন মোরগের দাম তার চেয়ে বেশি হবে না কেন?
আমার দুই তুর্কি বন্ধু ছিল বিলেতে, জলিল আর ওইতুন। ওদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তুর্কি হোজ্জার কথা, বাঙালি ওষ্ঠে হোজ্জার নাম অনেকক্ষণ বুঝতে না পেরে অবশেষে তারা জোকার দিয়ে উঠেছিল—ওজা, ওজা? হোজ্জা যেমন বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুকে ঝোলের ঝোলের ঝোল খাইয়েছিলেন, ওদের ওজা নিশ্চয়ই এমনি করে মুখে মুখে অতি ব্যবহারে আমাদের হোজ্জা হয়েছেন, হয়েছেন মোল্লা, হয়েছেন মধ্য এশীয় 'এফেন্দি', উর্দুসাহিত্যে হয়েছেন খোজা, সিসিলিতে তথা ইতালীয় লোকসাহিত্যে হয়েছেন 'গ্যিওফা', হয়েছেন আরব দেশের চালাক 'জুহা', চীনের জ্ঞানী 'আফান্টি', মিসরের দুষ্ট 'গোহা'। শ্রীলঙ্কার তামিলরা তাঁকে চেনে নাসুদিন মুল্লা নামে, সোয়াহিলি অথবা ইন্দোনেশিয়াতে তিনি আবু-নওয়াজ। শোনা যায়, তিনি জন্মেছিলেন ১২০৮ সনে, সেলজুকদের যুদ্ধবিগ্রহের মাঝে, ইমাম হিসেবে প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন, ১২৮৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। কোনিয়া বিভাগের আকসেহিরে তাঁর কবর হয়। আজো সেখানে প্রতিবছর জুলাই মাসে হোজ্জা উৎসব হয়। বুখারায় তাঁর ভাস্কর্য রয়েছে, রয়েছে শিনজিয়াং-এ, রয়েছে মস্কোতে। আমার মনে হয়, এই লোকচরিত যেন ভূপেন হাজারিকার সেই যাযাবরের মতো বিশ্বজনীন, যে গঙ্গা-মিসিসিপি-ভল্গার রূপ এক করে দেখেছে, ইলোরার রং মেখেছে শিকাগোর গায়ে, মার্ক টোয়েনের সমাধিতে বসে গোর্কির কথা বলেছে। হোজ্জা তো সত্যিই আমেরিকা-সোভিয়েত-সেন্ট্রাল এশিয়া-চীনকে একসূত্রে বেঁধেছেন। কত দুরূহ এমন করে যুযুধান এতগুলো জাতকে সুতোয় বেঁধে এক করে রাখা আর আট শ বছর এভাবে জীবিত থাকা!
হোজ্জা নাকি বলতেন—'মনের আনন্দে থাকো, কিংবা চেষ্টা করো তেমনটি থাকতে, কাউকে না কাউকে তোমার সন্তুষ্টি উত্যক্ত করবেই; আর যদি তা না পারো, তাহলে একজন তো অসন্তুষ্ট হবেই।' ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রিয় হোজ্জার গল্পটা বলছি। মোল্লা নাসরুদ্দিন হোজ্জার বাড়িতে চুরি হয়েছে। ভাবলেশশূন্য হোজ্জা এসে বসে আছে কবরখানায়। লোকে তাকে ডেকে বলছে—'মোল্লা তুমি কবরখানায় কী করছ? চোর ধরতেও বের হলে না! কাজির কাছেও বিচার দিলে না!' মোল্লা নাসরুদ্দিন হোজ্জা হেঁকে বললেন, 'চোরকে তো একদিন মরতেই হবে, তাই এখানে এসে অপেক্ষা করছি।' কেউ আপনার নামে মিথ্যে মোকদ্দমা দিচ্ছে, নাম কালো করছে, আপনার জিনিস চুরি করছে, বকেয়া টাকা দিচ্ছে না বা নিয়ে পালিয়েছে, কবরখানায় গিয়ে হোজ্জার মতো বসে থাকুন। এই নশ্বর জীবনের মানে পরিষ্কার হয়ে আসবে কবরখানার অকুল নির্জনতায়। এই হাজামতের জন্যে হোজ্জাকেও হয়তো মনে মনে একটি ধন্যবাদ দেবেন।