আকাশ অংশত মেঘলা, তবু...
প্রতিদিন ঠিক মেঘ রঙের না হলেও একটা ধূসর রং ধরে আকাশে, তারপর সেটা বহুব্যবহৃত শাদা শার্টের মতো বিবর্ণ হয়ে ঝুলে থাকে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ অথচ বৃষ্টি আসে না, ঝড়ের বাতাসের দমকা দেখা দেয় না। ওটা মেঘ না স্মগ, বলে কেউ কেউ, তীব্র বায়ুদূষণের নমুনা। বাড়ি ফিরবার পর থেকে এইই দেখলাম। মাঝে দুই রাত রিমালের কারণে খুব ঝড়বৃষ্টি হলো, এর ভালো নাম ঘূর্ণবাত বৃষ্টি। জানালা খুলতেই বাতাস যেন সাপের উদ্গত জিভের মতো একবার কাছিয়ে আসে তারপর দূরে যায়, শোঁ শোঁ শব্দ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে সরে যায় আবার এগিয়ে আসে। নুহের নৌকোর মতো দুলছিল নারকেলগাছের মাথাগুলো। জানালার শার্সিতে সেই রাগত সরীসৃপের মতো শব্দ শুনতে শুনতে সে রাতে একটা কথা মনে হলো, আমার স্থপতি বন্ধুরা শুনলাম খুবসে বান্দরবানে নয়, সুন্দরবনে রিসোর্ট ডিজাইন করছে, এ না করলে ও করবে অতএব সবাই কমবেশি করছে—এভাবেই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আর ন্যাচারাল ফরেস্টের অনুপস্থিতি একদিন ঢাকার সুরক্ষা কবচ কেড়ে নেবে, ঘূর্ণিঝড়ের ল্যান্ডফল হবে অনেকটা ইনল্যান্ডে, জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ হবে আরও বিধ্বংসী...নাকি ওসব আমারই কল্পনা! জানি না। তা সুন্দরবন তো আমাদের ভাগের মা, কারও দায় নেই যার জন্য!
দু-তিন দিনে রিমাল ফুরোল। আক্রান্ত এলাকা থেকে শাফিয়া খালা পুঁটুলি কাঁখে চলে এল ঢাকায়, এসে ঘোষণা দিল—তাদের এলাকায় কোনো মানুষ মরেনি, ঝড়টা কিছুই নয় নাকি। আবার প্রতিদিনকার গরম নামল, ঢাকা নগরী ও তার দেবালয় পুড়তে লাগল, যে যার মতো গাছ মুড়োতে এবং কাটতে লাগল, ইমারত গড়তে লাগল, পুকুর বোজাতে লাগল। আমিও আপন অম্লে আপনি ধ্বংস হতে থাকা কোনো প্রাণীর মতো ঘামতে লাগলাম। জৈষ্ঠ্যের শেষ। মাঝে মাঝে দক্ষিণের জানালার কাছে বাবার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে বসে থাকি, সন্ধ্যার দিকে টের পাই—আমাদের সেই গ্রামার বইয়ের ট্র্যান্সলেশন করতে দেয়া বাক্য—'মৃদুমন্দ বাতাস বহিতেছে'। কিন্তু যৎসামান্য বাতাসে নারকেলপাতার ডগাটুকুও শিরশির করে আর কাঁপে না। প্রতিদিন সকাল থেকে অপেক্ষা করে থাকি আজ বৃষ্টি হবে, হয় না।
অবশেষে আর একদিন বৃষ্টি হলো। শহরের শেষ নৈর্চা বসানো তেতলার ছাদে ছেলেমেয়েসহ করুণ কেরাণিও ভিজল সেই বর্ষণে। দেখলাম গলিতে হুড়মুড়িয়ে কালো পানি জমে ছপছপ করছে। বৃষ্টি ধরে এল দ্রুতই, এর জাপানি নাম নাকি উদাইচি, বজ্রদেব রাইজিনের চকিত সান্ধ্য উপহার। একটা পাকা কাঁঠাল ঘাড়ে করে আলগোছে পানি পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে একটা লোক। খুব মেঘ ডাকছে আর বাজ পড়ছে। ও রকম মন্দ্রগভীর মেঘের ডাককে তুচ্ছ করে একটা ভেজা-ওড়নার ঘোমটা দেয়া বউ ভ্যানগাড়ির সবজিওয়ালার সঙ্গে ধুঁদুলের দর নিয়ে চ্যাঁচামেচি করছে, গাজরগুলো যে নির্ঘাত হিমাগারের তাতে সন্দেহ কি, বেগুনগুলো পোকাধরা হবে না তো—হলে বুঝতে হবে কীটনাশক নেইÑতা কীটনাশক না কীট—কূল না শ্যাম? এলোপাতাড়ি বৃষ্টিতে ভিজে সামনের নীল রং করা পুরোনো বাড়িটার রং হয়েছে নীলগোলা ভেজা শার্টের মতো। তার ওপর আকাশটাও সেই শাদা শার্ট...আজকাল ঝুলিয়ে রাখা শার্ট ছাড়া মেটাফরিক্যালি আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না বোধ হয়। বজ্রপাতের শব্দে একটু আগেও দিশেহারা কবুতরের ঝাঁক গলির আকাশে উড়ছিল, এখন তারা নারকেলগাছের মাথায় ঝোপালো ছায়াটুকুতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, আহা আকাশে পেতেছে শয্যা।
বৃষ্টি আবার শুরু হলো, আনাজ কিনে বৌটা পানি কেটে চলে গেছে কখন! কাঁঠাল-কাঁধে লোকটা কি আজই কাঁঠাল ভাঙবে? কাঁঠালের তীব্র-নির্ভান-ভনভনে গন্ধে ভরে যাবে তার মেঘ-অন্ধ ঘরের অন্দর? কাঁঠাল তো চার-ইয়ারি কথা, একত্রে বেঁটে খাওয়ার জিনিস। ওর বাড়িতে কি আজ আরও লোক জমবে? ঈশানী মেঘের মতো? দুধ-ভাতে কাঁঠালের রস মিশিয়ে খাবে নাকি মুড়ি দিয়ে? ছোটবেলায় একটা চুটকি শুনেছিলাম। এক ছাত্র ওমর খৈয়ামের নাম কিছুতেই মনে রাখতে পারে না বলে তার শিক্ষক তাকে শিখিয়ে দিয়েছে—মনে রাখবি 'ও মোর খৈ+আম'। ছাত্র পরীক্ষার হলে যেতে যেতে সেই শিক্ষা গুলে খেয়ে কবির নাম লিখে এসেছে 'ওমর মুড়ি-কাঁঠাল'। কী সব তুচ্ছ রসিকতায় একদা হেসে লুটোপুটি খেতাম। মা এসে জানালা থেকে সরে বসতে বলল, আকাশে এত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে যে মনে হচ্ছে সস্তা মঞ্চসজ্জার পুরোনো নাটকে অভিনয় করছি। যেসব নাটকে জীবন ও পৃথিবীবিষয়ক দু-চারটে দার্শনিক কথা নায়কের সংলাপে শোনা যেতই। ওসব দর্শন-টর্শন থেকে জীবনের নাট্য একেবারে ধুঁদুলের দরে নামিয়ে ফেলেছি! এমন দিনে রেডিওর নাটক নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে বিঘ্নিত হতো। আমার চোখ চমকে দিয়ে সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠল দোকানগুলোয়, আকাশ ফিকে বেগুনি এবং চামচিকেময়। রিকশাগুলো আজকাল আর গলিপথে বিশ্রম্ভগতিতে চলে না, প্রবলবেগে চলে, এতে গলির বাড়িগুলোর জানালা দিয়ে চলতিপথে আমি যত অন্দরমহলের নাট্যদৃশ্য দেখতাম, তার আর কিছুই দেখা হয় না, শহরের বহু অজ্ঞাতনামা লোকের ভয়্যোরিস্টিক কৌতূহলের সমাপ্তি ঘটিয়েছে এখনকার রিকশার গতি। সারা রাত বৃষ্টি হতে পারে এই আশঙ্কায় সবজিওয়ালা তার ভ্যান নিয়ে সরে পড়েছে।
কত রকম বৃষ্টি আর মেঘের নাম শিখিয়েছিল বাবা, শিখিয়েছিল কোদালি মেঘ, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, আইতান-কাইতান বৃষ্টি। জসীমউদ্দীন শিখিয়েছিলেন ধুলোট মেঘা, তুলোট মেঘা, আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি। জীবন চিনিয়েছে সিঁদুরে মেঘ, গায়ে তার গোয়ালপোড়া আগুনের রং। ধুঁদুল আর কাঁঠালের সমাচার সরিয়ে রেখে আমার মাথায় রিমঝিম করছে—তারই সঙ্গে মনে পড়ে মেঘলা দিনের গান—'ও সাজনা, বরখা বাহার আয়ি...।' অতএব, 'এই বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেও না'। আমাদের নাগরিক জীবনে বৃষ্টি মানে ছিল ইস্কুলের 'রেইনি ডে'—সেদিন অনুপস্থিত হলে ক্ষতি নেই, শয়নমন্দিরে কাঁথামুড়ি উৎসব আর কামার্ত যক্ষের সেই দাঁতব্যথার মতো কনকনে বিরহ। আমাদের রান্নাঘরে বন্যার পানি আর ঢুকত কই? বিরক্ত জলঢোঁড়াই বা ভেসে আসত কই? পানিকাদায় মাখামাখি হয়ে জাম্বুরার ফুটবল খেলবার মাঠই বা ছিল কই? ব্যাঙের বিয়া কিংবা বদনা বিয়ার কথা আমরা কেবল বইয়েই পড়েছি। ঢোঁড়াসাপের প্রসঙ্গে মনে পড়ল আমার মায়ের ছোট ফুফুকে। তিন বোনের এক বোন, বড় দুজনের জন্মের সময় বোধ করি পিতামাতার ধৈর্য অব্যাহত ছিল—তাই তাঁদের নাম চেলী আর বেলী, তৃতীয়বার কন্যা জন্মাবার পর অধীর পিতামাতা মেয়ের নাম রাখেন ফেলি (কোথায় ফেলি তাকে!), আম্মার ফেলি ফুফু, আমাদের ফেলি নানি। মনে পড়ে নানারা দুই ভাই মিলে দেখতে গেছে তাদের ফেলি-বোনকে, ফেলি নানি বহুক্ষণ ধরে বারে বারে তার হাতে ঢোঁড়াসাপের কামড় দেখিয়ে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে, শচীন দেববর্মন ওই কান্না শুনলে গান বেঁধে ফেলতেন, ওই কান্না আর কিছু নয় তো—সেই আমার ভাইজানরে কইও নাইওর নিত বইলা! বোনের প্রসঙ্গে মনে পড়ল, আমার নানিরা ছিলেন সাত বোন, আষাঢ় মাসের শুরুতে নাকি ওদের গলাগলি করে কাঁদতে হতো, নইলে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি হয় না। মরতে মরতে সেই সাত বোন থেকে আজ কেবল দুই বোন বাকি, একদিন সব কয়টিতে আকাশের সেভেন সিস্টার্স হয়ে যাবে—আমাদের সপ্তর্ষি। তখন হায় আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের কী হবে!
আমাদের বৃষ্টিঝরা দুপুরে অবধারিত ছিল খিচুড়ি-ডিম ভাজি আর বিকেল বেলায় শুকনো কড়াইয়ে টেলে কড়কড়ে ভাজা কাঁঠালবিচি (আবারও কাঁঠাল)। ছিল টুইনওয়ানে চিন্ময় চাটুজ্জের—তোমার গীতি জাগাল স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া। ছিল দিনমানে অন্ধকার ঘরের কর্ণ বরাবর রশি টাঙিয়ে ঝুলতে দেয়া ভেজা স্যাঁতসেঁতে শাড়ি, জল দাঁড়ানো রাস্তার মোড় অবধি যেতে রিকশার সে কী গুমোর! ছিল বর্ষণক্ষান্ত বিকেলে হারমোনিয়াম টেনে গলা সাধা—বিজলিতে কে দূর বিমানে, সোনার চুড়ির ঝিলিক হানে! বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি—চুপচুপে ভেজা অপর্ণা সেনের হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি। দৃষ্টিসীমা হারিয়ে যাওয়া বৃষ্টির কথা মনে পড়লেই আমার একটা কাঠের পুলের ওপর বৃষ্টির কথা মনে হয়। আমাদের সিপাহি বিপ্লবের কাছাকাছি সময়ে হিরোশিগে তাঁর উডব্লক প্রিন্টে দেখিয়েছিলেন, গভীর বার্লিন ব্লু রঙের সুমিডা নদীর ওপর ওহাশির কাঠের পুল—তার ওপর সহসা ও রকম দুনিয়া আন্ধার করে দেয়া একপশলা বৃষ্টি। যে বৃষ্টি দেখে তিরিশ বছর পর ভ্যানগখের মন আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠেছিল। আচ্ছা হাঁসাড়ার কোনো পুলের ওপর দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসু কি কোনো দিন বৃষ্টি দেখেছিলেন? সেই দৃশ্যের একটা উডকাট কি একটা জলরঙে আঁকা ছবি হতে পারত না? সিনেমার বৃষ্টির কথায় রোটি-কাপড়া-মাকানের জিনাত আমানকে খুব মনে পড়ে যায়, তোর দু-টাকা মাইনের চাকরির জন্য আমার লাখ-টাকার শাওন মাস যায়! কেন শাওন মাসের দাম লাখ টাকা? শ্রাবণ মাসের দিনে-রাতে কি এমন আছে, যা নইলে সমস্ত চাকরি কেবলই আয়ুক্ষয়ী, যার অভাবে সব প্রয়াস ব্যর্থতার অনুভবে বুক ভরে দেয়? আষাঢ় মাসের বিষ্টি রে, ঝমঝমায়া পড়ে রে, বন্ধু আমার রৈলো বৈদেশ গিয়া। কী হবে বিদেশফেরতা বন্ধুকে পেলে? সেই তো শয়নমন্দিরে কাঁথা-উৎসব, এরপর এক-বাড়ি ছেলেপুলের খোরাক কাঁঠাল আর ধুঁদুলের দর গোনাগুন্তির জীবন।
এক দিনের বৃষ্টিতে গরম যায় না। এক মাঘে শীত যেত না শুনতাম, সে রকম কিছু একটা গরমকালের সঙ্গেও ঘটে গেছে নিশ্চয়ই। আবারও বৃষ্টির জন্য কেবল নিষ্ফল প্রতীক্ষা। আবারও—কই গো কই মেঘ উদয় হও। ক্রান্তীয় উষ্ণতায় লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার সেই নেফুদ মরুভূমি পাড়ি দেবার কথা মনে পড়লে বুঝতে হবে বিপদ আসন্ন। মরুর ঝড়ের ভিতর গাড়িতে আটকে পড়া প্রেমিক যেন আমারই চুলে শিরশিরে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে শোনায় বাতাস আর ঝড়বৃষ্টির উপাখ্যান, হেরোডোটাস নাকি বলেছিলেন কোনো হাওয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কুচকাওয়াজ করে সমরসাজে এগিয়ে গেছিল একটি জাতি...হারমাতান নামের একরকম বাতাস ছিল নাকি, রক্তিম বাত্যা, নাবিকরা সেই বাতাসকে ডাকত অন্ধ-সমুদ্র, সেই বাতাসের লাল গাঢ় ধুলো উড়ে আসত বিলাতের দক্ষিণ সৈকতে, এমন আরক্ত বৃষ্টি ঝরাত যে মনে হতো রক্ত ঝরছে। মরুঝড়ের ভিতর মানুষ-মানুষী ভাবছে ঝড়বৃষ্টির কথা ('দ্য ইংলিশ পেশেন্ট')। আমিও ভাবছি। মন মোর মেঘের সঙ্গী!
আবার কবে বৃষ্টি হবে—ভাবতে ভাবতে ছাদে আসি, রুনা লায়লার মতো করে ডাকব—'আয় রে মেঘ আয় রে'! হায় এত গরমের পরেও—এত ডিফরেস্টেশনের পরেও ছাদবাগান কেন করা হচ্ছে—এই নিয়ে কাজিয়া চলছে—অগত্যা নেমে আসি। যে বৃষ্টি সর্বজনীন—তা এ খণ্ডিত শহরে আর আসে না। বৃষ্টির কথা ভাবতে ভাবতে পাড়া-মহল্লা এক চক্কর দিয়ে আসি, পাঁচ মিনিটের মাথায় যেকোনো বাড়ির সামনে দেখতে পাই—পড়ে আছে সদ্য চেরাই করা কাঠ, মৃত গাছের উপাখ্যান। দশ মিনিটের মাথায় জানি সামনে পড়বে এমন শপিং কমপ্লেক্স, যা রচিতই হয়েছে চিরদিন এয়ারকন্ডিশন্ড থাকবে বলে। আমাদের বাঁচাবে কে! গরম বাড়ছে, গরম এভাবে বাড়তে থাকলে ভূপৃষ্ঠ থেকে জলকণা বাষ্পীভূত হবে, জলাশয়ে পানির মাত্রা আর ভূগর্ভস্থ পানির তল আরও নেমে যাবে, ঘন ঘন প্রলয়ংকারী ঝড় হবে, বন্যা আর জলোচ্ছ্বাস হবে, ঝড়জল থেকে দূরে থাকা এলাকায় চলবে খরা। নতুন করে বনায়ন সৃষ্টির মতো পরিবেশ ও আবহাওয়া আর অবশিষ্ট থাকবে না। মনে আছে, খনা বলে গেছিলেন—'সূর্য হেসে বসে পাটে, সেবার শস্য হয় না মোটে'? গত দশ বছরের তাপমাত্রা অতীতের প্রায় দুই শ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, ২০২৩ ছিল সবচেয়ে উত্তপ্ত বছর। গত সাতচল্লিশ বছর ধরে পৃথিবীতে গড় তাপমাত্রার তুলনায় শীতলতর কোনো বছরই আসেনি। পম্পেই জানে আগুন ঝরাবার আগে বহুবার মাটি গর্জায়, আমরা শুনতে পাই না—শুনি না মানি না পাত্তা দিই না। 'ম্যাঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে ম্যাঘ দিব তর ক্যাডা'! আমরাও অতঃপর ঘুমাই।
হয়তো আগেও লিখেছি, আবারও লিখলাম, প্রকৃতিকে ভয় করাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ, খুব স্বাস্থ্যকর ভয় ওটা। সব প্রাণী প্রকৃতির রোষকে ভয় করে, তার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাকে সমঝে চলে। শুধু মানুষ ভাবে, প্রকৃতি লুণ্ঠনের জিনিস, দোহনের জিনিস। ভাবে, তার ব্যক্তিগত কৃতকর্মের দায় সমষ্টিতে বর্তাবে, অন্য কেউ তার হয়ে তার আপন দায়দায়িত্বের ভার লাঘব করে দেবে (পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙার বাগধারাটা মাথায় এসেছিল এখানে)। ভুলে যায় যে হঠকারিতা ব্যক্তিক, তাই সামষ্টিক হয়ে আঘাত হানবে প্রকৃতিকে।
একটিই তো গ্রহ আমাদের, কল্যাণীয়া গৃহ আমাদের, এক মহাদেশের জঙ্গলে দাবানল জ্বলে উঠলে আরেক মহাদেশের আকাশে লাল মেঘ জমে, এক সমুদ্রে বিষ গুললে আরেক সৈকতে মাছ মরে যায়, এক নদীতে বাঁধ দিলে আরেক নদী শুকায়। অনাবৃষ্টি এ গ্রহের রোগের উপসর্গমাত্র, মূল রোগ আরও ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী। তবু ভাবতে ভালো লাগে, আমরা হয়তো এখনো প্রতিকারহীন একটি দুঃখজনক জায়গায় এসে পৌঁছাইনি, যেখান থেকে মরুপথে হারানো ছাড়া আর কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যায় না। দীপেশদা (চক্রবর্তী) একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, একদা যাঁরা ন্যায়ের কথা ভাবতেন, তাঁরা উন্নয়নের কথাও ভাবতেন। সেই সূত্র ধরে বলতে চাই, যাঁরা আজ উন্নয়নের কথা ভাবেন, তাঁদের ন্যায্য এবং টেকসই সমাধানের কথা ভাবতে হবে। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে যদি শহরের কিংবা গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশের দিকে দৃষ্টি দেন, প্রকৃতির প্রতি যদি কিছু একটা কল্যাণকর কাজ করেন, তাহলে আমাদের এই ছোট্ট দেশটা তার বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে বেঁচে যায়। আমাদের এই সব গ্রাম আর শহরকে এখনো প্রাণভিক্ষা দেবার সময় কি হয়নি? ছোট ছোট কাজ জুড়ে নিলেই বড় একটা বাতাবরণ তৈরি হবে, উভয় অর্থে। গাছ লাগান এবং গাছ বাঁচিয়ে রাখুন, জলাশয় সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন, নিজের ঘরে অযথা বাতি, পাখা, এসি, রেডিও চালিয়ে রাখবেন না, অপ্রয়োজনীয়ভাবে মাটির ওপর বাঁধাই চত্বর তৈরি করবেন না, নিজের দেশে উৎপাদিত খাবার খান আর কার্বন ফুটপ্রিন্টের ব্যাপারে সজাগ হোন, বাস্তু সম্পর্কে সচেতন হোন—যেকোনো বন্য প্রাণী পেলেই পিটিয়ে মারবেন না—আপনি জানেন না, এই প্রাণীর কোনো না কোনো কাজের কারণে আমি আপনি সুস্থ হয়ে বেঁচে আছি...এই সব নানান সদুপদেশ অনলাইন ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। মনোভাবের বদলটা সবার আগে জরুরি, প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে তো কেউ নই। চলুন আরও কিছুদিন বেঁধে বেঁধে থাকি, আমাদের পথ নেই আর!