কেরালা: ফুটবল যেখানে নেশা, মেসি-নেইমার যেখানে জীবনের চাইতেও বড়!
চার বছর অপেক্ষার পর এসেছে ফুটবল বিশ্বকাপ, এই মুহূর্তে তাই বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রিকেট দিয়েই বেশি খ্যাতি লাভ করলেও ভারতে ফুটবলপ্রেমীর সংখ্যা কম নয়। বিশ্বকাপ দরজায় কড়া নাড়তেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, শহরে-গ্রামে, অলিগলিতে দেখা গেছে ফেভারিট দলগুলোর পতাকা ও ফুটবল তারকাদের ছবি। বিশ্বকাপকে ঘিরে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ছেলেবুড়ো সবার মধ্যেই তৈরি হয়েছে উত্তেজনা! বিশ্বকাপের ডামাডোলের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় তাদের চিরাচরিত ফুটবল উন্মাদনার জন্য। বিশেষ করে, কেরালা এমনই একটি রাজ্য যেখানে ভক্তদের কাছে মেসি-নেইমার তাদের জীবনের চাইতেও বড়!
আন্তর্জাতিক ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরকে কেন্দ্র করে জোর প্রস্তুতি নিয়েছেন কেরালার কোজিকোরে শহরের ফুটবলভক্তরা। খেলোয়াড়দের বিশাল বিশাল কাট-আউট, পতাকা, ব্যানার লাগানো হয়েছে শহরজুড়ে। শহরের প্রায় প্রতিটি রাস্তায়ই রয়েছে বিশ্বকাপের ছোঁয়া... আর এভাবেই এই শৈল্পিক খেলাটির প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছে কেরালাবাসী।
একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের কাছে ফুটবল মানেই প্রথমে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। অন্য অনেক ইউরোপীয় দলের সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হলেও, লাতিন আমেরিকার দুটি দলই এ অঞ্চলের মানুষদের ফুটবলপ্রীতি ও আবেগের প্রথম জায়গা। কালের পরিক্রমায় খেলার মাঠ থেকে সরে গিয়েছেন পেলে-ম্যারাডোনার মতো কিংবদন্তিরা, কিন্ত বর্তমান প্রজন্মে রয়েছেন মেসি-নেইমাররা। সারাবছর এসব সুপারস্টারদের ক্লাবে খেলতে দেখে অভ্যস্ত ফুটবলপ্রেমীরা বিশ্বকাপ মঞ্চে তাদের পারফরমেন্স দেখতে উদগ্রীব।
ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বরাবরই ভক্তদের দুই ভাগে ভাগ করে দেয়, কেরালাও তার ব্যতিক্রম নয়। নব্বইয়ের দশক থেকে ব্রাজিল সমর্থন করে আসছেন কেরালার ২৮ বছর বয়সী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ বাসিত। তিনি মনে করেন, ১৯৯৮ সালের পর থেকে এ অঞ্চলে ব্রাজিলের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু আর্জেন্টিনার ভক্তকুল এখানে অনেক আগে থেকেই বেশি!
পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করে মোহাম্মদ বাসিত জানান, ১৯৯৮ সালের দিকে তিনি ফুটবল খেলা দেখতে শুরু করেন, সেসময় তার বাবা ছোট্ট একটি রঙিন টেলিভিশন নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে। ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার আগেরদিন সেই রঙিন টেলিভিশন দেখে উল্লসিত হয়ে গিয়েছিলেন তারা।
"ওই টুর্নামেন্টে ব্রাজিলের পারফরমেন্স দেখেই আমি তাদেরকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেই। আমার এখনো মনে আছে, বাবা যেই টিভিটা এনেছিলেন সেটার মধ্যেও ফুটবলের মতো গোলাকৃতির একটা সুইচ ছিল। আমাদের বাড়িতে এখনো সেই টিভিটা সযত্নে রাখা আছে", বলেন মোহাম্মদ বাসিত।
বিশ্বকাপের মৌসুমে কেরালায় গেলেই দেখা যাবে শত শত বাড়ি, দোকানপাট ও ভবনের ছাদে উড়ছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকা। মালাপ্পুরাম জেলায় দুই দলের বর্তমান ও সাবেক কিংবদন্তিদের ছবি সংবলিত বিলবোর্ড শোভা পাচ্ছে এখানে-ওখানে। দিয়েগো ম্যারাডোনাকে এখানে মনে করা হয় ঈশ্বরের মতো, যিনি বর্তমানে লিওনেল স্কালোনির অধীনস্ত আর্জেন্টিনা দলের উপর নজর রাখছেন!
মোহাম্মদ বাসিত বলেন, "তরুণরা অনেকেই ব্রাজিল সমর্থন করে এই কারণে যে আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ সালের পর থেকে আর কোনো বিশ্বকাপ শিরোপাই জিততে পারেনি। কিন্তু আর্জেন্টিনার জন্য ভক্তদের গভীর ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায় সবসময়ই।"
তিনি আরও যোগ করেন, "কেরালায় মানুষ ফুটবল তারকাদের জীবনের চেয়েও বড় হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে, এটা চলচ্চিত্র তারকাদের ক্ষেত্রেও সত্য। কিন্তু ফুটবলারসের সাথে আমাদের সম্পর্কটা অন্য মাত্রার, বিশেষ করে যারা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থক।"
স্ট্রিট ফুটবলের জন্য ভালোবাসা
ফুটবলের প্রতি তীব্র ভালোবাসা থেকেই কেরালায় গড়ে উঠেছে সেভেন-এ-সাইড ফুটবল সংস্কৃতি। কোজিকোরের বিভিন্ন জায়গায়ই রয়েছে খেলার মাঠ, সেই সঙ্গে আর্দ্র আবহাওয়া ও কর্দমাক্ত মাঠ ফুটবল খেলার জন্য এক চমৎকার পরিবেশ তৈরি করেছে। সমাজের একেবারে নিচুতলা থেকে উঠে এসে যেসব ফুটবলাররা কিংবদন্তি হয়েছেন, তাদের জন্য এক বিশেষ আবেগ রয়েছে কেরালাবাসীর হৃদয়ে।
কেরালা ভারতের সবচেয়ে বড় নগরকেন্দ্রিক রাজ্য নয়। তাই পুরো রাজ্যজুড়েই এখানে-সেখানে অনেক খালি জায়গা ও মাঠ রয়েছে; আবার ফসল বোনার আগ পর্যন্তও মাঠগুলো খালি থাকে। আর এগুলোই শিশু-কিশোরদের ফুটবল খেলার মাঠ হিসেবে উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে। বাসিতের ভাষ্যে, "চরম নগরকেন্দ্রিক না হয়ে যাওয়া মানেই হলো লোকজনের হাতে অবসর সময় আছে।"
অনেকেই জানেন, ম্যারাডোনা, লিওনেল মেসি ও নেইমারের মতো তারকারা ছোটবেলায় রাস্তায় রাস্তায় ফুটবল খেলেই বড় হয়েছেন। তাই এই তারকাদের সাথে আত্মার ও আবেগের সম্পর্ক অনুভব করেন কেরালার ফুটবলভক্তরা।
কোজিকোরের আরেক ব্যবসায়ী বিলাল আহমেদ বলেন, "আমাদের এখানে মাঠগুলোতে সকালে আর সন্ধায় খেলা হয়। এ অঞ্চলের অর্থনীতি যেহেতু মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল, তাই দৈনন্দিন কাজের বাইরে ফুটবল খেলার জন্যেও সময় বের করতে পারে মানুষ।"
ফুটবল খেলার উপকরণের সহজলভ্যতা এবং খেলায় জটিলতা না থাকায় মানুষ খুব সহজেই এটি বুঝে নিতে পারে। বিলাল আহমেদ বলেন, "ফুটবল খেলার জন্য আমাদের শুধু একটা বল দরকার। কিমতু ক্রিকেটে অনেক উপকরণের দরকার হয় এবং সময়ও বেশি লাগে। আমাদের এ অঞ্চলে ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত জায়গা বা অবস্থা নেই, কারণ অনেক বেশি কাদা-বালি। কিন্তু সে তুলনায় ফুটবল খেলা খুবই সহজ।"
পানির ওপরেও মেসি-নেইমার!
কোজিকোরের শহরতলীর পুল্লাভুর গ্রাম সম্প্রতি মেসি, নেইমার ও রোনালদোর বিশালাকৃতির কাট-আউট বসিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।
আর্জেন্টিনা পুল্লাভুর ফ্যানস গ্রুপের সদস্য এরশাদ পিকে বলেন, আমরা এটা উপভোগ করি এবং আমরা আর্জেন্টিনা সমর্থন করি কারণ তারা অসাধারণ ফুটবল খেলে। ফুটবল আমাদের জীবনের একটা অংশ।
এরশাদই জানান, মেসির কাট আউট বসানোর কাজটা ছিল খুবই কঠিন এবং এতে কয়েক ঘন্টা সময় লেগেছে। চেরুপুজা নদীর ওপর নেইমারের কাট-আউটটি বসানো হয়েছে মেসিরই কয়েক মিটার সামনে।
তবে আরও সামনে থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আর্জেন্টাইন তারকার কাট-আউটের আশেপাশেই পাচটি ছোট ছোট কাট-আউট রয়েছে যা দিয়ে ব্রাজিলের পাঁচবার বিশ্বকাপ জেতাকে বোঝান হয়েছে।
ফুটবল এবং বিশ্বকাপ কোজিকোরের মানুষদের উপার্জনেরও একটি উৎস। কারণ বিশ্বকাপ আসতেই ভক্তরা নিজ নিজ দলের পতাকা ও জার্সি কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। টিভি বিক্রি ও ব্রডকাস্ট সাবস্ক্রিপশন এবং বিজ্ঞাপনের হারও সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
তবে শুধু লাতিন আমেরিকার দেশই নয়, কোজিকোরের ভেল্লাইল ও বেইপুর এলাকায় স্পেন, জার্মানি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের পতাকাও চোখে পড়বে। পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর পতাকায় পতাকায় ছেয়ে যাওয়া রাস্তা যেন পরিণত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে!
ব্রিটিশরা ফুটবলকে দেখেছেন এমন একটি শক্তি হিসেবে যা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। "অন্যান্য জায়গায় ছেলেমেয়েদের ভিডিও গেমস বা মোবাইল উপহার দেয়া হয়, আর কোজিকোরেতে আমরা বাচ্চাদের ফুটবল উপহার দেই", এভাবেই ফুটবলের প্রতি কেরালার মানুষের গভীর ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলেন মোহাম্মদ বাসিত।
সূত্র: আল-জাজিরা