বিশ্বকাপ ফুটবল ১৯৯৪: বিভীষিকার এক অধ্যায়
ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনা কম-বেশি সব সময়ে ছিল; এখনকার তুলনায় সেটা বরং আগে আরও বেশি ছিল। ক্রিকেটে বিশ্বমানে পৌঁছে যাবার পর থেকে বাংলাদেশে ফুটবল রঙ হারাতে থাকে। ঢাকার ফুটবল লীগ, ফেডারেশন কাপ, ডামফা কাপ, প্রেসিডেন্টস গোল্ড কাপ, আগা খান গোল্ড কাপ অনিয়মিত হতে হতে কোনো কোনোটা একসময় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঢাকার ফুটবল ক্লাব আবাহনী-মোহামেডানের ঐতিহাসিক দ্বৈরথ দর্শক-সমর্থকদের কাছে স্তিমিত হতে হতে একসময় মোটামুটি নাই হয়ে যায়।
নব্বইয়ের দশক থেকে ফুটবলে যে ভাটার টান লাগে, তা আজও কাটেনি। কিন্তু ফুটবল পাগল দর্শক যারা, তাঁরা তো ফুটবল খেলা না দেখে থাকবেন না; তাঁরা ঠিকই বিকল্প খুঁজে নিয়েছেন। আশির দশকে বিটিভিতে দেখানো ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ আর ইতালির সিরি আ'র খেলা দেখা বাংলাদেশের দর্শককুল স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগমনের পরে ইউরোপীয় ফুটবলের দর্শকে পরিণত হন। আস্তে আস্তে তাঁদের মধ্যে ইংলিশ আর ইতালিয় ফুটবল লীগের পাশাপাশি স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ডাচ, পর্তুগীজ লীগের খেলা কম বেশি দেখা, খোঁজখবর রাখা শুরু হয়। স্প্যানিশ ফুটবল লীগ যখন ইউরোপের বাকি সব লীগকে ছায়ায় ঢেকে দিল, তখন এদেশের দর্শকদের মধ্যেও বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের দ্বৈরথ শুরু হয়ে যায়। এখন ইউরোপীয় ফুটবলের বিভিন্ন লীগ ভিত্তিক নানা রকমের ছোট-বড় দ্বৈরথ তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু এসব দ্বৈরথ এখনো আগের সেই আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথের গণউন্মাদনার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেনি।
ইউরোপীয় ফুটবল নিয়ে এদেশে যত উন্মাদনাই হোক না কেন ফুটবলের দুই দলের দ্বৈরথে এদেশে এখন সবচেয়ে বড় উন্মাদনাটি হচ্ছে ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার দ্বৈরথ। এই দ্বৈরথটি এখন আক্ষরিক অর্থে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-বয়স-শ্রেণী-পেশা-অবস্থান সব বিভেদ ছাড়িয়ে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথের তুলনায় এই দ্বৈরথ অনেকটাই বায়বীয়। আগে দর্শকেরা আবাহনী বা মোহামেডানের সব খেলা দেখতেন বা নিয়মিত তার খোঁজ রাখতেন। দুই দলের সব খেলোয়াড়দের নামধাম জানতেন, চেহারা চিনতেন, খেলার স্টাইল জানতেন। এখন চার বছর পর পর ফুটবলের বিশ্বকাপের আসর আসন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই দ্বৈরথের দেখা মেলে না। এই এক-দেড় মাস সময় কালে যারা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পক্ষে জান লড়িয়ে দেন তাদের বড় অংশ আগের সাড়ে তিন বছর সচরাচর এদের খেলা দেখেন না, এসব দলের তিন/চার জনের বেশি খেলোয়াড়ের চেহারা চেনা তো দূরে থাক, নাম পর্যন্ত জানেন না; কার খেলার স্টাইল কী সেসব তো আরও বহু দূরের ব্যাপার। অথচ এখন সব তথ্য সহজলভ্য হয়েছে, চাইলেই খেলার ভিডিও দেখা যায় বা সরাসরি সম্প্রচার দেখা যায়। তাই এখনকার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথে জৌলুস বেড়েছে, কিন্তু সম্পৃক্তি আর প্রাণের ছোঁয়া কমেছে।
সম্ভবত ১৯৮২ সালে এদেশের মানুষ প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশিনে প্রথম স্পেনে অনুষ্ঠিত ফুটবলের বিশ্বকাপের কিছু খেলার সরাসরি সম্প্রচার দেখতে পান। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হলেও সব খেলা দেখানো সম্ভব হয়নি। ১৯৯০ সালে ইতালি বিশ্বকাপ থেকে সব খেলা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০-এই আট বছরে এদেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের দর্শকই কেবল তৈরি হয়নি, বিভিন্ন দলের সমর্থকও তৈরি হয়েছে। ১৯৮৬ সালের আগে এদেশে কতজন ফুটবল দর্শক আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থক ছিলেন সেটা বলা মুশকিল। থাকলেও সেটা খুবই কম হবার কথা।
পেলের কল্যাণে দর্শকদের একাংশ ব্রাজিল ফুটবল দলকে সমর্থন করতেন। ১৯৮৬ সালে দিয়েগো মারাদোনা এই ইতিহাস একেবারে পালটে দেন। তাঁর খেলা, স্টাইল, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় এই দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়। এমনকি অন্য দলের সমর্থকদের মধ্যেও মারাদোনার ভক্তের অভাব হয় না। এভাবে এদেশে বিপুল সংখ্যক ফুটবল দর্শক আর্জেন্টিনার সমর্থক বনে যান এবং ব্রাজিলের সমর্থকদের সাথে এক অবশ্যম্ভাবী দ্বৈরথে জড়িয়ে পড়েন। এই দ্বৈরথ ফুটবলের বিশ্বকাপকেন্দ্রিক এক বিপুল উন্মাদনার জোয়ার সৃষ্টি করে, যা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে পেতে আজকের পর্যায়ে এসেছে। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের বিরাট এক অংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। অর্থাৎ, তাঁরা জীবনে কখনো আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিততে দেখেননি। তবুও আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রতি তাঁদের সমর্থন-ভালোবাসা কম নয়। একই কথা ২০ বছরের কম বয়সী ব্রাজিল ফুটবল দলের সমর্থকদের জন্যও প্রযোজ্য।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে দর্শক-সমর্থকদের এই উন্মাদনা মন্দ কিছু নয়, অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা অন্যের ক্ষতি করছে। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে প্রায়ই দুই দল সমর্থকদের মধ্যে মারামারি বাঁধছে; কখনো কখনো সেটা খুন-জখম-ভাঙচুর পর্যন্তও গড়াচ্ছে। পতাকা বা ব্যানার টানাতে গিয়ে উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গিয়ে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাবার ঘটনাও আছে। খেলা নিয়ে বাজি ধরে শেষে বড় আকারের দলবদ্ধ সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। কখনো বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে না খেলতে পারা একটি দেশের সাধারণ মানুষ যখন হাজার হাজার মাইল দূরের ভিন্ন একটি দেশের ফুটবলকে সমর্থন করতে গিয়ে নিজেদের ক্ষতি করেন, তখন সেটা নিয়ে ক্ষুদ্ধ হওয়া আর আক্ষেপ করা ছাড়া কিছুই করার নেই। বাংলাদেশের নাম বা এই দেশটি কোথায় অবস্থিত সেটি পর্যন্ত না জানা দেশের ফুটবল দলকে সমর্থন করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি করা চরম বোকামী ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে, কেবল দুয়েকজন আবেগপ্রবণ মানুষ বা স্বল্প শিক্ষিত মানুষজন এমনটা করে থাকেন। বাস্তবে শিক্ষিত মানুষদের বড় আকারের দলও এমন মূর্খতা প্রদর্শন করতে পারেন। কী কারণে বা কেনো তাঁরা অমনটা করলেন, তার ব্যাখ্যা হয়তো সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা অথবা মনোবিজ্ঞানীরা দিতে পারবেন; কিন্তু এই প্রকারের উন্মাদনায় যারা ক্ষতিগ্রস্থ হন, কেবল তাঁরাই বলতে পারবেন কিছু মানুষের মূর্খতা কী করে তাঁদের জীবনে স্থায়ী ক্ষতি করে গেছে।
১৯৯৪ সালের জুন মাসে যখন আমেরিকাতে ফুটবলের বিশ্বকাপ শুরু হয়, তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন দুই প্রকার কারিকুলামের শিক্ষার্থী বিদ্যমান। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে নতুন নিয়ম, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে পুরাতন নিয়ম। নতুন নিয়মে বছরে দুটো টার্ম, প্রতিটি টার্মে তিন/চারটি তত্ত্বীয় ও চার/পাঁচটি ব্যবহারিক বিষয় পড়তে হত। ছয় মাসের মধ্যে ঐ সব বিষয়ে ক্লাস শেষ করে,পরীক্ষা দিয়ে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হতো। এক টার্মের জের অন্য টার্মে টানতে হতো না। পুরাতন নিয়মে দুই সেমেস্টার মিলে এক বছর। এই সময়ে আটটি তত্ত্বীয় ও আট /দশটি ব্যবহারিক বিষয় পড়তে হত। তাঁদেরকে বছরে দুটি সেমেস্টার পরীক্ষায় বসতে হতো এবং দুটো মিলিয়ে পাশ করতে হত। কিন্তু কেউ প্রথম সেমেস্টারের একটি পরীক্ষাতেও যদি অনুপস্থিত থাকতেন তাঁকে ফেল বলে গণ্য করা হত। অর্থাৎ, তাঁকে ঐ বর্ষের পুরোটা গোড়া থেকে আবার পড়তে হতো।
আমরা পুরাতন নিয়মের শেষ ব্যাচ বলে আমাদের ব্যাচ থেকে কেউ ফেল করলে তাঁকে নতুন নিয়মে সব কিছু শুরু করতে হতো। পুরাতন নিয়ম থেকে নতুন নিয়মে যাওয়া মানে নাম্বার পদ্ধতি থেকে গ্রেড পদ্ধতিতে যাওয়া, সনাতন পদ্ধতি থেকে ক্রেডিট পদ্ধতিতে যাওয়া। টাকা যেমন একবার ডলারে পরিবর্তন করে আবার টাকাতে পরিণত করলে পরিবর্তনজনিত কারণে তা পরিমাণে কমে যায়, তেমন পুরাতন নিয়ম থেকে নতুন নিয়মে গেলে একজনের ফলাফল আগের তুলনায় খারাপ হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, ক্রেডিটের হিসাবের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে দেখা যেত একই প্রকারের বিষয় তাঁকে আবার পড়তে হচ্ছে। সুতরাং প্রথম বর্ষ থেকেই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল– কোনোভাবে ফেল করা যাবে না।
ঘটনাক্রমে আমেরিকা বিশ্বকাপ যখন শুরু হবে ঠিক ঐ সময়ে আমাদের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের প্রথম সেমেস্টার পরীক্ষা শুরু হবে, এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস চলবে। ইতোপূর্বে আমাদের রমজান মাসে ক্লাস করা বা পরীক্ষা দেবার অভিজ্ঞতা থাকলেও কী কারণে যেন এইবার আমাদের কিছু শিক্ষার্থী দাবি করে বসলেন বিশ্বকাপ চলাকালে সেমেস্টার পরীক্ষা নেওয়া যাবে না, পরীক্ষা পিছাতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ আট দিন সকালে বা দুপুরে পরীক্ষা দিতে হবে যেটা রাতে খেলা থাকলেও কোন সমস্যা নয়। দুটি পরীক্ষার মাঝে তিন/চার দিন করে ছুটি পাওয়া যেত, তাই প্রস্তুতি নেওয়াটাও সমস্যা ছিল না। ব্যাপারটা এমন নয় যে, সবাই রাত জেগে সব খেলা দেখবেন তাই দিনে পরীক্ষা দিতে পারবেন না। বরং অমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতকরা হিসেবে অর্ধেকের চেয়ে অনেক কম হবার কথা।
অন্তত আমাদের সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রীড়া, সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। আবাসিক হলগুলোর ক্রীড়া বা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাতে অংশগ্রহনকারীদের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকমের কম ছিল। কোনো কোনো ইভেন্টে সব মিলিয়ে তিনজন প্রতিযোগী পাওয়া যেত না। আমাদের অডিটোরিয়ামগুলোতে কনসার্ট বা অন্য গানের অনুষ্ঠানে দর্শকদের একটা বড় অংশ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের দর্শক। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সব মিলিয়ে দেড়-দুইশ জন দর্শকও হতো না। খেলার মাঠে কোনো প্রতিযোগিতায় পঞ্চাশ জন দর্শক পাওয়া বিশাল ব্যাপার ছিল। একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় হকির ফাইনালে উঠেছিল। ফাইনালের দিনে মাঠে প্রতিপক্ষ দলের দর্শক সংখ্যা আমাদের কয়েক গুণ ছিল। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খেলাটিতে আমাদের দলকে সমর্থন জানাতে উপস্থিত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে ব্যাপক প্রচারণাও চালিয়েছিলেন। ঐ সময়ে আমাদের মাঠে দুই বার আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে আমাদের দর্শক সংখ্যা অতিথি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দর্শকদের চেয়ে কম ছিল। আন্তঃবিভাগ বা আন্তঃহল পর্যায়ের ক্রীড়া বা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমরা দর্শকশূন্যতায় ভুগতাম।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলা না হলে বিশ্বকাপের অন্য দলগুলোর খেলায় আবাসিক হলের টিভি রুমের অর্ধেকও ভরতো না। তবুও কারো কারো দাবি খেলা দেখার জন্য পরীক্ষা পিছাতে হবে। খুব যৌক্তিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতে রাজি ছিল না। এটা নিয়ে ব্যাপক মিটিং মিছিল হলো, অল্পস্বল্প ভাঙচুর হলো, কিছুদিন ক্লাস বন্ধ থাকলো। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্ন মত ওঠার কোনো উপায় ছিল না। কেন উপায় ছিল না, সেটি যাদের অবিমৃষ্যকারিতার এমন প্রবল উত্থানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই তাঁদেরকে বোঝানো কঠিন। ঐ ঘটনার ২৮ বছর পরে আজ আমি যখন এই লেখা লিখছি তখনও এর প্রতিক্রিয়াতে আমাকে কীসের মুখোমুখি হতে হবে সেটা আমি আঁচ করতে পারি।
শেষ পর্যন্ত আমরা আর প্রথম সেমেস্টার পরীক্ষা দিতে পারিনি। আমাদের এহেন আচরণের প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষকগণ খুবই বিরক্ত ছিলেন। পরীক্ষা ছাড়াই অনতিবিলম্বে আমাদের পরবর্তী সেমেস্টারের ক্লাস শুরু করে দেওয়া হয়। আমাদের নেতারা আমাদেরকে বুঝিয়েছিলেন আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পরীক্ষা নেওয়ানোতে রাজি করা হবে, তাই পরীক্ষা নেওয়ানোর জন্য আন্দোলন শুরু করা হলো।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলন শুরু হতে না হতেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দিলেন। ইতোপূর্বে পুরাতন নিয়মের শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল আগে পরীক্ষা নিতে হবে, তারপরে দ্বিতীয় সেমেস্টার চলাকালীন সময়ে নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় যে দুটো ছাত্র সংগঠন আগের নির্বাচনগুলোতে বেশি আসনে জিতেছিল তারা আগের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে- 'আগে নির্বাচন পরে পরীক্ষা'র পক্ষে অবস্থান নেয়, বাকিরা নির্বাচনে না যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারছিল ঠিক এই মুহূর্তে নির্বাচন ঘোষণা করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটা কৌশলী চাল মাত্র। কারণ নির্বাচন হতে হতে সেমেস্টারের মোট চৌদ্দ সপ্তাহের ক্লাসের মধ্যে সাত/আট সপ্তাহ পার হয়ে যাবে। তখন আগের সেমেস্টারের পরীক্ষা নেবার দাবি হালে পানি পাবে না।
তাছাড়া এত দিন পরে পরীক্ষা হলে আগের পড়াশোনা বিশেষ কিছু মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু নির্বাচনের মূলা ঝুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাফল্যের সাথে ছাত্র আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলতে সক্ষম হয়। নির্বাচন নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে এক সময় সেটা সংঘর্ষের রূপ নেয়। সম্ভবত এই সংঘর্ষের ব্যাপারটি কর্তৃপক্ষের হিসাবে ছিল। তাঁরা নির্বাচন স্থগিত করে দেন। এত দিনে এতোটা সময় পার হয়ে গেছে যে পরীক্ষা নেবার আর কোনো উপায় থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন দুই সেমেস্টারের কোর্স একত্রিত করে প্রতিটি বিষয় তিন ঘণ্টার পরিবর্তে চার ঘণ্টা করে পরীক্ষা দিতে হবে। এই পরীক্ষাটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ডাবল সেমেস্টার' পরীক্ষা নামে কুখ্যাত।
সুদূর অতীতেও একবার নাকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ডাবল সেমেস্টার' পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। সেবার নাকি কেউ কেউ পরীক্ষার আগেই, কেউ কেউ পরীক্ষা দিতে গিয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। সেবার নাকি অনেকে ফেল করেছিলেন। মন দিয়ে পরীক্ষার পড়া পড়তে সেবার কেউ কেউ নাকি বাইখাতা নিয়ে প্রক্ষালন কক্ষেও ঢুকেছিলেন। কেউ কেউ আবার বইখাতা নিয়ে গাছের মগডালে চড়েছিলেন। ডাবল সেমেস্টার পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হবার সাথে সাথে বাজারে এমন সব বিভীষিকার গল্প ভাসতে থাকল। এসব গল্পের সত্যাসত্য জানি না, তবে খোদ আমাদের এই দুই ব্যাচে নানা বিভীষিকার কাহিনী শুরু হয়ে গেল। কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা 'ইয়ার ড্রপ' দেবেন। কয়েকজন অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করলেন। বিপুল পড়ার চাপে, নানা উৎকণ্ঠায় বাকিদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেল।
অবশেষে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে সেই পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষার হলে ঢোকার পরে মনে হতে লাগলো আমরা অনন্ত কাল ধরে পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছি; পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাচ্ছি, কিন্তু পরীক্ষা শেষ হচ্ছে না। দুপুরের পরে পরীক্ষা থাকলে পরীক্ষার হলে অভিনব দৃশ্যের অবতারণা হতো। আসরের নামাজের সময় হচ্ছে, কেউ কেউ লেখা বন্ধ করে হলের ভেতরেই সামনের দিকে নামাজ পড়ে নিচ্ছেন। তার কিছুক্ষণ পরে মাগরেবের নামাজের সময় হচ্ছে, আবার লেখা বন্ধ করে সামনে গিয়ে নামাজ পড়ে নিচ্ছেন। হল সহকারীরা এসে মশার ওষুধ ছিটিয়ে যাচ্ছেন, সম্ভাব্য বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা ভেবে চার্জ লাইট, মোমবাতি-দেশলাই রেখে যাচ্ছেন। হলের এমাথা-ওমাথা হাঁটতে হাঁটতে শিক্ষকগণ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। আর আমরা লিখেই যাচ্ছি, লিখেই যাচ্ছি।
যারা তৃতীয় বর্ষে পড়তেন তাঁদের জন্য এই বর্ষের পরীক্ষা ছিল আগের দুই বছরে ফলাফলে কিছু ঘাটতি থেকে থাকলে তা পূরণের। যারা চতুর্থ বর্ষের ছিলেন তাঁদের জন্য এটাই ছিল শেষ সুযোগ। যখন ফলাফল প্রকাশিত হলো তখন অন্তত আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেখলেন– তিনি যতটুকুর জন্য যোগ্য ছিলেন, তারচেয়ে কম পেয়েছেন। এতো কষ্টের পরেও যারা কৃতকার্য হতে পারলেন না তাদের জন্য এই বিভীষিকার দৈর্ঘ্য সামনের আরও অনির্দিষ্ট কালের জন্য প্রলম্বিত হলো। এভাবে ১৯৯৪ সালের ফুটবলের বিশ্বকাপ আমাদের জীবনে স্থায়ী দাগ রেখে গেল।
নানা কারণে ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ উল্লেখযোগ্য। দুই যুগ পরে সেবার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে ব্রাজিল চতুর্থবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়। সেবার এক যুগ পরে ফাইনালে উঠে ইতালি চ্যাম্পিয়ন হতে ব্যর্থ হয়, এর আরও এক যুগ পরে তারা ফাইনালে উঠতে ও চ্যাম্পিয়ন হতে সমর্থ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া নামের দেশগুলো ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেওয়ায় তাদেরকে আর কখনো বিশ্বকাপে দেখার উপায় থাকে না। নিষিদ্ধ ড্রাগ এফেড্রিন নেবার অপরাধে কিংবদন্তীর ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনাকে দুই ম্যাচ পর টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসবই হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে ঘটা ঘটনা, যার কোনো প্রভাব আমাদের জীবনে পড়ার কথা না। অথচ এই বিশ্বকাপকে উপলক্ষ্য করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যা কিছু হলো তাতে আমাদের দুই ব্যাচের কমপক্ষে ১ হাজার ১২০ জন শিক্ষার্থীর জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। কয়েক জনের স্বাভাবিক জীবন চিরতরে শেষ হয়ে গেলো। অনেকের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্থ হলো। অনেকের ফলাফল খারাপ হলো। এসব ক্ষতির কোনো কিছুই আর কখনো কোনভাবে পূরণ হবার নয়।
জীবন চলার পথে কখন কার কাঁধে নেতৃত্বের ভার চাপে তা বলা কঠিন। তবে যার কাঁধে নেতৃত্বে এসে পড়ে তাঁকে সবার কল্যাণের কথা ভেবে দায়টা নিতে হয়। নেতৃত্ব অযোগ্য, অপদার্থ হলে সে গোটা গোষ্ঠীর সমূহ ক্ষতির কারণ হয়। ফরাসী দার্শনিক জোসেফ দে মাইস্ত্র বলেছিলেন, "প্রতিটি দেশ যেমন সরকার পাবার যোগ্য তারা তেমন সরকারই পায়"; আমরা সম্ভবত অমন নেতৃত্ব পাবার যোগ্য ছিলাম তাই নিজেদের সমূহ ক্ষতি হতে দিয়ে তার দায় মেটালাম।