লিটন-সাকিব দ্যুতিতে বিশাল জয়ে সিরিজ বাংলাদেশের
মোহনীয় সব শটে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ে ঝলমলে ইনিংস খেললেন লিটন কুমার দাস। সঙ্গী রনি তালকুদার খেললেন খুনে ইনিংস। এরপর অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও তাওহিদ হৃদয়ের ব্যাটেও থাকলো ঝড়; বাংলাদেশের ঝুলিতে জমা হয় বিশাল সংগ্রহ। বল হাতে স্বপ্নের শুরু এনে দিলেন তাসকিন আহমেদ, পরে ম্যাচসেরা সাকিবের মায়াবী বিভ্রমে ছন্নছাড়া আয়ারল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপ। এরপর হাসান মাহমুদের তোপে আরও দিশেহারা আইরিশরা। ব্যাটে-বলে উজ্জ্বলতম পারফরম্যান্সে বিশাল জয়ের হাসি উঠলো সাকিবদের মুখে।
বুধবার চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে আয়ারল্যান্ডকে ৭৭ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। নিজেদের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে রানের হিসাবে এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জয়, সবচেয়ে বড় জয় ৮৪ রানে। বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে পাওয়া বিশাল এই জয়ে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতে নিলো বাংলাদেশ। একের বেশি ম্যাচের সিরিজের হিসাবে এটা বাংলাদেশের নবম সিরিজ জয়। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে আইরিশদের বিপক্ষে এটা বাংলাদেশের টানা চতুর্থ জয়।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ। লিটন ও রনির 'হাইলাইটস' এর মতো ব্যাটিংয়ে দুর্বার শুরু পায় বাংলাদেশ। সাগরিকায় ঝড় তুলে আরও কিছুটা সময় দলকে পথ দেখানো এই দুই ব্যাটসম্যানের পর সাকিব ও হৃদয়ের ব্যাটে ১৭ ওভারে (বৃষ্টিতে ওভার কমানো হয়) ৩ উইকেটে ২০২ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে স্বাগতিকরা। জবাবে তাসকিন-সাকিবদের বোলিং তোপের মুখে হ্যারি টেক্টর ও হাফ সেঞ্চুরি করা কার্টিস ক্যাম্ফার ছাড়া কেউ-ই রান করতে পারেননি। ৮ জন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কের ঘরে যেতে ব্যর্থ হওয়া দলটির ইনিংস শেষ হয় ৯ উইকেটে ১২৫ রানে।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা আয়ারল্যান্ডকে শুরুতেই পথ ভুলিয়ে দেন তাসকিন। ইনিংসের প্রথম বলেই অধিনায়ক পল স্টার্লিংকে ফিরিয়ে দেন ডানহাতি এই পেসার। এরপর আইরিশদের চেপে ধরেন জাদুকরী বোলিং করা সাকিব। সফরকারীদের পরের ৫টি উইকেট তুলে নেন তিনি। ৪৩ রানের মধ্যেই ৬ উইকেট হারিয়ে হাবুডুবু খেতে থাকে আয়ারল্যান্ড। কিছুক্ষণ পর হাসান মাহমুদও তোপ দাগেন, তাসকিনও চেপে ধরেন সফরকারীদের।
এর মাঝেও দারুণ এক ইনিংস খেলেন কার্টিস ক্যাম্ফার। ৩০ বলে ৩টি করে চার ও ছক্কায় ৫০ রান করেন তিনি। এ ছাড়া হ্যারি টেক্টর ২২ ও গ্রাহাম হিউম অপরাজিত ২০ রান করেন। এই তিনজনই কেবল দুই অঙ্কের রান করেন। ৪ ওভারে ২২ রানে ৫ উইকেট নেন সাকিব। দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টিতে ৫ উইকেট নেওয়া সাকিবের এটা দ্বিতীয় সেরা বোলিং। এই ৫ উইকেটে টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হয়ে গেছেন তিনি, বাঁহাতি এই স্পিনারের উইকেট এখন ১৩৬টি। তাসকিন ২৭ রানে ৩টি ও হাসান ২ ওভারে ৬ রানে একটি উইকেট পান। বরাবরের মতো অনুজ্জ্বল থেকে যাওয়া মুস্তাফিজ ৩ ওভারে ২১ রান খরচায় উইকেটশূন্য থাকেন।
এর আগে ব্যাটিং করা বাংলাদেশ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাট হাতে শাসন করে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রতিটা ইনিংসই যেন হয়ে উঠেছে হাইলাইটসের মতো। শুরু থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, এটা হাইলাইটস নাকি ইনিংস চলছে। ওয়ানডে সিরিজে দলগত, ব্যক্তিগত অনেক মাইলফলক গড়া বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি সিরিজেও আছে একই ছন্দে। রান পাহাড় গড়ে প্রথম টি-টোয়েন্টি জেতা সাকিব আল হাসানের দল দ্বিতীয় ম্যাচেও সেই ধারায় থাকে। ।
প্রথম টি-টোয়েন্টিতেও ঝড় তুলেছিলেন লিটন ও রনি। উদ্বোধনী জুটিতে ৭.১ ওভারে ৯১ রান তোলেন তারা। এর মাঝে হয়ে যায় নিজেদের সর্বোচ্চ রানের পাওয়ার প্লের রেকর্ড। ১৯.২ ওভারে ৫ উইকেটে ২০৭ রান তোলে বাংলাদেশ। ইনিংসে ছিল ১৭টি চার ও ৯টি ছক্কা। আজ ১৭ ওভারেই ২০০ রান করা বাংলাদেশের ইনিংসে ছিল ১৯টি চার ও ৮টি ছক্কা। ২১ বলে পূর্ণ হয় দলীয় ৫০, যা বাংলাদেশের দ্রুততম। দলীয় ১০০ রান করাতেও আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ, ৪৩ বলেই আসে ১০০ রান।
উইকেটে নেমেই আয়ারল্যান্ডের বোলারদের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দেন লিটন ও রনি। দুজনই খেলতে থাকেন খুন মেজাজে। কয়েকটি শট খেলে উইকেটে মানিয়ে নেওয়া বাংলাদেশের এই ব্যাটসম্যান চোখের পলকে স্কোরকার্ডের চেহারা পাল্টে ফেলেন। পাওয়ার প্লের ৫ ওভার থেকেই ৭৩ রান তোলেন লিটন-রনি। বেশিরভাগ ফিল্ডার ৩০ গজে থাকার সুবিধা কাজে লাগিয়ে মারকুটে ব্যাটিংই করে যেতে থাকেন তারা।
উদ্বোধনী জুটিতে ৫৬ বলে ১২৪ রানের অসাধারণ জুটি গড়েন লিটন-রনি, যা টি-টোয়েন্টিতে শুরুর জুটিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। যেকেনো উইকেটেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই জুটি গড়ার মাঝে মাত্র ১৮ বলে ৫টি চার ও ৩টি ছক্কায় হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন লিটন। যা বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড। দীর্ঘদিন ধরে এই রেকর্ডটি ছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের দখলে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেন সাবেক এই অধিনায়ক। লিটনের হাফ সেঞ্চুরিটি টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে যৌথভাবে সপ্তম দ্রুততম।
বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটি ভাঙে রনির বিদায়ে। বিপিএল দিয়ে প্রায় আট বছর জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়মিত পারফর্ম করে যাওয়া ডানহাতি এই ওপেনার ২৩ বলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কাসহ ১৯১.৩০ স্ট্রাইক রেটে ৪৪ রান করেন। ১৪ রান পরে গিয়ে থামেন লিটন। খুনে ব্যাটিং করার দিনে লিটন থামেন ১২তম ওভারের শেষ বলে।
সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটের দশম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার দিনে ৪১ বলে ১০টি চার ও ৩টি ছক্কাসহ ২০২.৪৩ স্ট্রাইক রেটে ৮৩ রান করের ঝলমলে ইনিংস খেলেন ক্ল্যাসিক এই ব্যাটসম্যান। এটাই তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। তার আগের সর্বোচ্চ ছিল ৭৩ রানের ইনিংস। এরপর বাংলাদেশের স্কোরকার্ড ঝলমলে করে তোলেন সাকিব ও হৃদয়। সাকিব ২৪ বলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ৩৮ রানে অপরাজিত থাকেন। ১৩ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ২৪ রান করেন হৃদয়। আয়ারল্যান্ডের বেন হোয়াইট ২টি ও মার্ক এডেয়ার একটি উইকেট পান।