ফেরার তাড়নায় পরিবর্তনকে সাথী করেছেন নাঈম শেখ
বাংলাদেশের ক্রিকেট মঞ্চে যেভাবে আবির্ভাব ঘটেছিল তার, প্রত্যাশার পারদ উঁচুতে ওঠাটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু নিজেকে এরপর হারিয়েই ফেলেছেন নাঈম শেখ। নিজের খেলা মাত্র তৃতীয় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ভারতের বিপক্ষে নাগপুরে খেলেছেন ৪৮ বলে ৮১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস।
যেই ইনিংসটি তখন বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের খেলা দ্রুততম ৮০ রানের ইনিংস ছিলো। টি-টোয়েন্টিতে ভারতের মাটিতে তাদের বিপক্ষে রান তাড়া করতে নেমে কোনো ওপেনারের দ্রুততম ৮০ রান এখনো নাঈমের সেই ইনিংসই।
অবাক করা ব্যাপার, এরকম বিদ্যুৎগতির ইনিংস খেলা নাঈমের নামের সঙ্গেই কিনা জুড়ে আছে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড। আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর কোনো ব্যাটসম্যান, যিনি কিনা টি-টোয়েন্টিতে ন্যুনতম ৮০০ রান করেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম স্ট্রাইক রেট নাঈমেরই, মাত্র ১০৩.৪!
টি-টোয়েন্টিতে যখন চলছে বল দেখা আর মারার যুগ, তখন নাঈমের এমন স্ট্রাইক রেট নিয়ে দলে টিকে থাকার কথাও নয়। স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়েছেন জাতীয় দল থেকে। অবশ্য নাঈম দাবি করতেই পারেন যে তিনি কখনো টি-টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। জাতীয় দলে তার ডাক পাওয়াটাই যে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে পারফর্ম করে, যা কিনা খেলা হয় ওয়ানডে ফরম্যাটে।
২০১৭-১৮ মৌসুমে নাঈমের অভিষেক ঘটে ডিপিএলে। সেই মৌসুমেই ৪৬ গড়ে ৫৫৬ রান করেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ২০১৯ সালের ডিপিএলে ৫৪ গড়ে করেন ৮০৭ রান। এরপরই 'এ' দল হয়ে জাতীয় দলের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে জায়গা করে নেন নাঈম। অথচ টি-টোয়েন্টি তার শক্তির জায়গাই নয়!
পরিসংখ্যান অনুযায়ীও নাঈমের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ৫০ ওভারের ফরম্যাটই। এখন পর্যন্ত ৭২ টি লিস্ট এ ইনিংস খেলে ৩১ টিতেই পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস আছে নাঈমের। রান করেছেন ৪৯ গড় এবং ৮৭.৭ স্ট্রাইক রেটে। যে কোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই এটি বেশ ভালো সংখ্যা। জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের কথা দেওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এই ফরম্যাটে টানা খেলার সুযোগ পাননি নাঈম!
মাশরাফি বিন মর্তুজার শেষ ওয়ানডে ম্যাচে অভিষেক ঘটে নাঈমের। যদিও ব্যাট করার সুযোগ পাননি, ২০২১ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে একটি ইনিংস খেলার সুযোগ পেয়েছেন, সেটিই ওয়ানডেতে নাঈমের শেষ ইনিংস। তামিম বলেছিলেন, লিটন দাস যেহেতু কিছুটা খারাপ ফর্মের মধ্যে আছেন, নাঈমকে সুযোগ দেওয়া হবে। সেই সুযোগ আর আসেনি।
ক্রিকেটাররা প্রায়ই নিজেদের সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে থাকেন এবং মনে করে থাকেন সেটিই সঠিক। নিজের খেলার ধরণ নিয়ে নাঈমের স্বীকারোক্তি, তিনি বুঝতে পারেননি মিরপুরের ধীরগতির উইকেটে কীভাবে খেলা উচিত, 'আমার অভিষেকের পর থেকেই আমি দ্রুত রান করার চেষ্টা করে গিয়েছি। দেশের বাইরে আমি সফলও হয়েছি। কিন্তু মিরপুরের উইকেটে কীভাবে খেলা উচিত সেটি না বুঝতে পারায় আমার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে। আমার স্ট্রাইক রেট নিয়েও অনেক কথা উঠেছে। আমি এখন শেখার চেষ্টা করছি কীভাবে এই উইকেটেও দ্রুত রান তোলা যায়।' সাক্ষাৎকারে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন নাঈম।
নাঈমের কথার পেছনে যুক্তিও আছে, পরিসংখ্যান বলে- দেশে খেলা টি-টোয়েন্টিতে নাঈমের গড় ২০ এবং স্ট্রাইক রেট ৮৫, যেখানে দেশের বাইরে গড় ২৯ এবং স্ট্রাইক রেট ১১৭ (যদিও এটিও খুব বেশি নয়)। বোলার বান্ধব উইকেটে নিয়মিত খেলে হুট করে গতিময় উইকেটে ধরণ বদলানোটাও কঠিন বলে মনে করেন নাঈম, 'ভারতে আমি যেসব উইকেটে খেলেছি সেগুলোতে গড় রান ছিলো ১৬০ এর মতো। আর এখানে সেটি নেমে এসেছে ১৩০-১৩৫ এর মধ্যে। যে কারণে স্ট্রাইক রেট ভালো রেখে খেলা কিংবা স্ট্রাইক রোটেট করার বিষয়গুলোও কঠিন হয়ে উঠেছিল। এখন আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, সব উইকেটেই ভালো করার।'
স্ট্রাইক বদলানো যে তার সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম সেটি বুঝতে পারেন নাঈম, লম্বা এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান বল বেশ দূরেই পাঠাতে পারেন। এখন তিনি বাড়তি নজর দিচ্ছেন নিজের স্ট্রাইক বদলানোর ওপর।
সর্বশেষ এশিয়া কাপের দলে ছিলেন নাঈম, তবে বিশ্বকাপের টিকিট পাননি। বিপিএলে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ এসেছিল, সেখানে ১৭ গড় আর ১১১ স্ট্রাইক রেট খুব একটা সাহায্য করেনি তাকে।
কিন্তু এবারের ডিপিএলে আবারো সব আলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন নাঈম। আবাহনীর হয়ে ১১ ইনিংসে প্রায় ৯০ গড়ে আর ৯৫.২ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৭১৯ রান। ৮ ইনিংসে করেছেন পঞ্চাশোর্ধ রান, ১১ ইনিংসের ৭ টিতেই তার স্ট্রাইক রেট ছিলো ৮৫'র ওপরে। ছোট লক্ষ্য হওয়ায় দুটি ইনিংসে ব্যাট করেছেন রয়েসয়ে।
এবারের ডিপিএলে ওভারপ্রতি গড় রান ৫.১, অর্থাৎ বেশ ভালো রানই পাচ্ছেন ব্যাটসম্যানরা। নাঈম নিজেকে শামিল করেছেন সেই কাতারে। ন্যুনতম ৪৫০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট তার।
প্রধান নির্বাচক হাবিবুল বাশার জানিয়েছেন, তারা ডিপিএলে ব্যাটসম্যানদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন। নাঈমের বিশ্বাস, নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারবেন তিনি, 'নির্বাচকরা বলেছেন ডিপিএলের ওপর তারা নজর রাখছেন। টুর্নামেন্ট এখনও শেষ হয়নি। আমি মনে করি আমার পারফরম্যান্স দিয়ে দলে ফেরা সম্ভব।'
খেলাধুলায় যে পারফরম্যান্স ব্যতিত দলে থাকা সম্ভব নয় সেটি এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান খুব ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই দলে ফিরতে যা যা করা দরকার সব করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি, 'আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো দলই একজনের জন্য থেমে থাকে না। আপনি পারফর্ম না করলে সুযোগ হারাবেন। আমার লক্ষ্য এখন বিপিএল, ডিপিএলসহ টুর্নামেন্টগুলোতে ভালো খেলা ও জাতীয় দলে ফেরার সুযোগ করে নেওয়া।'